- বইয়ের নামঃ উত্তাল সময়ের ইতিকথা
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ করুণা প্রকাশনী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.১ বিনয় তাকিয়েই আছে
উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়
[এই উপন্যাস ‘কেয়াপাতার নৌকো’ ও ‘শতধারায় বয়ে যায়’- এর পরবর্তী পর্ব। কাহিনির মূল চরিত্র বিনয় পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আন্দামানে চলে এসেছে। দক্ষিণ আন্দামানের দু- প্রান্তে এমন অঞ্চলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে যার চারদিকে গভীর অরণ্য আর সমুদ্র। জঙ্গলে রয়েছে এখানকার আদিম জনগোষ্ঠী জারোয়ারা, সমুদ্রে হিংস্র হাঙরের দল। রয়েছে কালাপনির সাজা নিয়ে যারা ব্রিটিশ আমলে আন্দামানে এসেছিল তাদের ছোট ছোট কলোনি। অরণ্য নির্মূল করে ছিন্নমূল মানুষ অনন্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলছে তাদের নতুন বাসভূমি। বিনয় এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সে জেনেছে ঝিনুক অনেক দূরের মধ্য আন্দামানে। তাকেও খুঁজছে সে। অপরাজেয় মানুষের অনন্য সংগ্রামের কাহিনি ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। এখানে তার একটি অংশ প্রকাশিত হল।]
*
বিনয় তাকিয়েই আছে, তাকিয়েই আছে। পলকহীন। বুঝিবা শত বর্ষ ধরে।
সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়, ছোট বড় মাঝারি-চৌকো, তেকোণা, লম্বাটে, নানা আকারের কত যে দ্বীপ! সবই জনহীন, নিঝুম। একসময় ঝিনুকদের নিয়ে ‘স্টিমশিপ ‘চলুঙ্গা’ একটা দ্বীপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
অগুনতি দ্বীপ, প্রতিটি দ্বীপে উঁচুনিচু পাহাড়। পাহাড়গুলোর গায়ে ডালপালাওয়ালা প্রাচীন মহাবৃক্ষের সারি। আকাশে উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে সি-গাল। এত গাছ, এত পাখি, সমুদ্র থেকে মাথা তুলে থাকা এত দ্বীপ! তবু বিনয়ের মনে হয়, বিশাল সমুদ্র জুড়ে হঠাৎ অপার শূন্যতা নেমে এসেছে। আর সেই শূন্যতা তার বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কতক্ষণ পর খেয়াল নেই, বিনয়ের চোখ চলে যায় পশ্চিমের দিকটায়। উপসাগর, যার নাম সেসোস্ট্রেস বে–তার ওপারে যে পাহাড়টা অন্য সব পাহাড়ের মতোই গাছ-গাছালি ঝোঁপঝাড়ে লতাপাতায় তীব্র সবুজ হয়ে আছে সেটাকে খুব চেনা চেনা হল। আন্দামানের মানচিত্রে এর ছবি দেখেছে বিনয়। নিশ্চয়ই মাউন্ট হ্যারিয়েট। একটা ধবধবে সাদা ক্রস ওটার চুড়োয় সটান দাঁড়িয়ে আছে। আবছাভাবে বিনয়ের মনে পড়ে, আঠারোশো বাহাত্তরে পরাধীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড মেয়ো এই দ্বীপমালায় নির্বাসিত বন্দিরা কী ধরনের দুদর্শা আর নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, স্বচক্ষে দেখার জন্য এখানে এসেছিলেন। এক পাঠান কয়েদি, শের খান, মাউন্ট হ্যারিয়েটের তলদেশে, সমুদ্রের ধারে তাকে হত্যা করে। ক্রসটা বছরের পর বছর নীরবে সেই শোকের বার্তা ঘোষণা করে চলেছে।
এদিকে ‘রস’ দ্বীপের ধার ঘেঁষে উপসাগরের জল ফুঁড়ে ফুঁড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে শ’য়ে শ’য়ে উড়ুক্কু মাছ। রুপোলি ঝিলিকের ম্যাজিক তৈরি করে পনেরো কুড়ি ফিট দূরে ফের সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে। উড়ন্ত মাছেদের এই খেলাটা চলছে অবিরাম। ক্লান্তিবিহীন।
বিনয় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বাঁ ধারে কোনাকুনি উপসাগরের ওপারে চড়াই-উতরাইতে ঢেউ খেলানো শহর পোর্ট ব্লেয়ার। তারই একটা উঁচু টিলার মাথায় সেলুলার জেল। আকাশ-ছোঁওয়া একটা টাওয়ার মাঝখানে রেখে সেটার গা থেকে পাঁচ দিকে পাঁচটা লাল রঙের বিশাল তেতলা উইং বা ইমারত চলে গেছে। এগুলোর প্রতিটি তলায় সেলের পর সেল। মোটামুটি সাত ফিট বা ছফিট মাপের একেকটা খুপরি। উনিশশো পঁয়তাল্লিশের আগে মোট উইং ছিল সাতটা। জাপানি বোমায় দু’টো পুরোপুরি ধংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পরই ইংরেজরা সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারের ভারতীয় কলোনি থেকে চাটিবাটি গুটিয়ে চলে গেছে। দেশ এখন স্বাধীন। তবু আদিগন্ত কালাপানির মাঝখানে দক্ষিণ আন্দামানের রুক্ষ, ভীতিকর, দমবন্ধ করা এই বন্দিশালার দিকে তাকালে বুকের ভেতরটা আমৃল কেঁপে যায়। কুখ্যাত এই জেলখানা ঘিরে হাড় হিম করা নানা ঘটনা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারও জানতে বাকি নেই। ব্রিটিশ রাজত্বের অসীম দম্ভ এবং নির্যাতনের স্মৃতিস্তম্ভ এই সেলুলার জেল। আন্দামান নিয়ে যত বই বেরিয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই এর ছবি চোখে পড়বে। একেকটা শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চোখ ধাঁধানো প্রাচীন কোনও সৌধ বা অন্য কোনও ল্যান্ডমার্ক যা দেখলে লহমায় শহরটাকে চিনে নেওয়া যায়। প্যারিসের যেমন আইফেল টাওয়ার, লন্ডনের বিগ বেন, বম্বের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া বা কলকাতার হাওড়া ব্রিজ। আন্দামানের তেমনি সেলুলার জেল।
জেলখানাটার অনেকটা নিচে, উপসাগরের ধার ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তা ডাইনে এবং বাঁয়ে বহুদূর চলে গেছে। সেখানে কিছু লোকজন চোখে পড়ছে। দূর থেকে ছোট ছোট পুতুলের মতো মনে হয়। যেন মানুষের বনসাই।
উপসাগর থেকে হুহু করে উঠে আসছে তুমুল ঝোড়ো বাতাস; ‘রস’ আইল্যান্ডের সারি সারি নারকেল গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে সমানে ঝাঁকিয়ে চলেছে।
সমুদ্র, পাহাড় এবং হাজার হাজার বছরের মহা অরণ্য দিয়ে সাজানো এই দ্বীপপুঞ্জের চারিদিকে কত অবাক করা দৃশ্য, হাওয়ার। সাঁই সাঁই অবিরল শব্দ–কিছুই শুনতে বা দেখতে পাচ্ছেনা বিনয়। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, পাক খেয়ে খেয়ে নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া অসংখ্য গলিখুঁজির গোলকধাঁধায়, কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে উদ্বাস্তুদের কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে ভোর হতে না হতেই উভ্রান্তের মতো ছুটে গেছে। পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে ঝিনুককে। না, তাকে পাওয়া যায়নি। হতাশ, ব্যর্থ, হা-ক্লান্ত বিনয় ফিরে এসেছে সন্ধের পর। দিনের পর দিন। তারপর ধীরে ধীরে কবে যেন ঝিনুকের মুখ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। তার জন্য সারাক্ষণ যে আবেগে বুকের ভেতরটা উতরোল হয়ে থাকত তার তীব্রতা ক্রমশ জুড়িয়ে এসেছে। যে মেয়ে নিজের। ইচ্ছায় হারিয়ে গেছে তার জন্য কতকাল আর একইরকম ব্যাকুলতা টিকে থাকে? ‘নতুন ভারত’-এ চাকরি নেবার পর সে বিনয়ের জীবনের নতুন পরিধি থেকে দুরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছিল।
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।