- বইয়ের নামঃ নিজেই নায়ক
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. নমস্কার, আমি রাজীব
০১.
নমস্কার, আমি রাজীব–রাজীব সরকার। আপনারা আমাকে চেনেন না, দ্যাখেননি। আমার নামটা আগে কখনও শুনেছেন কি? আপনাদের চোখ-মুখের কুঞ্চন দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে–শোনেননি।
আমি তো জনগনের নেতা অর্থাৎ লিডার-টিডার নই যে আমার নামে দেয়ালে দেয়ালে জাতির মুক্তিসূর্য রাজীব সরকার–যুগ যুগ জীও লেখা থাকবে। আমি আট দশ কি পনেরো লাখ টাকা দামের ফিল্মস্টারও নই বা গ্ল্যামারওলা একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়, অথবা আন্তর্জাতিক চোরা চালানদার। এ সব হতে পারলে খবরের কাগজে আর রঙিন পস ম্যাগাজিনগুলোতে অনবরত ছবি বেরুত। আর ছবি যখন বেরোয় না এবং কেউ যখন রাজীব সরকার জিন্দাবাদ বলে চেঁচিয়ে আকাশ ফাটায় না তখন আমার নামটা আপনাদের শোনবার কোনও কারণই নেই।
লিডার স্মাগলার চিত্রতারকা–এ সবের কিছুই যদি না হই তা হলে আমি কী? আমি যে ঠিক কী, নিজের মুখে আর বলতে চাই না। আমার নানারকম কীর্তিকলাপ দেখে আপনাদের তা বুঝে নিতে হবে।
জানেন, কিছুদিন আগে আমার একবার দারুণ ইচ্ছা হয়েছিল সব গ্রেট ম্যানের মতো নিজের একখানা অটোবায়োগ্রাফি, মানে জীবন-চরিত লিখে ফেলি। শুনে আমার বিজনেস পার্টনার মেরী লতিকা বিশ্বাস বলেছে, তুমি কে হে যে লোকে তোমার বায়োগ্রাফি পড়বে! পিপলের সঙ্গে ইয়ার্কি দিতে যেও না, তার রেজাল্ট বিপজ্জনক। লতিকা বিশ্বাস কে, আমার কি জাতীয় বিজনেসের সে পার্টনার, এসব পরে বলছি, কিন্তু তার কথা শুনবার পর আমি রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম এবং জীবন-চরিত লেখার বাসনাটাকে আপাতত স্থগিতও রেখেছি।
লতিকার মতো আপনারাও হয়তো বলতে পারেন, তোমার সম্বন্ধে আমাদের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তবু পিপলকে মানে আপনাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন, এক কথায় আমাকে নাকচ করে দেবেন না। আপনারা আমার সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলতে থাকুন; দেখবেন এক সময় সামনে অনেকগুলো অচেনা দরজা খুলে গেছে আর আমি আপনাদের এক দারুণ রহস্যময় ওয়ার্ল্ডে পৌঁছে দিয়েছি।
আমার নামটা ইতিমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন। আপনাদের সুবিধার্থে নিজের সম্বন্ধে আরো দু-একটা ছোটখাটো খবর দিয়ে রাখছি।
আমার বয়স ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ। যা বয়স, আমাকে ঠিক তা-ই দেখায়। আমার হাইট পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি; বাঙালিদের পক্ষে এই উচ্চতা খারাপ নয়। ঈষৎ কোঁচকানো চুল নিখুঁতভাবে ব্যাকব্রাশ করা; দাড়ি চমৎকার কামানো। গায়ের রঙ কালো আর ফর্সার মাঝামাঝি; অর্থাৎ বাদামি। চামড়া টান-টান মসৃণ; তাতে পালিশ করা চকচকে ভাব আছে। আমার কপাল বেশ চওড়া, চোখ মাঝারি, মুখ লম্বাটে, ভারী ঠোঁট, নাকটা মোটার দিকে। আমি কিঞ্চিৎ মদ্যপান করে থাকি; সেই সঙ্গে নিয়ম করে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ। সেহেতু আমার চোখের তলায়, থুতনিতে বা পেটে অ্যালকোহল কোনও পলি জমাতে পারেনি। আমার বুকের মাপ প্রায় চল্লিশ ইঞ্চি, সরু কোমর, মাংসল শক্ত পায়ের গোছ। খুব সুন্দর না হলেও আপনারা আমাকে একজন বলিষ্ঠ এবং আকর্ষণীয় পুরুষমানুষ বলতে পারেন।
পোশাক-টোশাকের ব্যাপারে আমি খুব শৌখিন নই। তবু কাজকর্ম বা প্রফেসান–যাই বলুন, তার খাতিরে আমাকে সর্বক্ষণ ফিটফাট থাকতে হয়। আমি দামি ইজিপসিয়ান কটনের শার্ট বা ট্রাউজার পরে থাকি, নতুবা স্মাগল-করা টেরিকটের পোশাক। যে আমেরিকান আর ফ্রেঞ্চ পারফিউম ব্যবহার করি তার গন্ধ আমাকে ঘিরে একশো গজ রেডিয়াসের বাতাসে ভুর ভুর করতে থাকে। কিন্তু এটা আমার বাইরের দিক। আমার একটা ভেতরের দিকও আছে। যাকে ইনার সেল্ফ বলে, তার কথাই বলছি। এই ইনার সেলফ ব্যাপারটা সব মানুষেরই থাকে। সে যা-ই হোক, বাইরের বা ভেতরের কোনও দিক সম্বন্ধেই আমি আর কিছু বলব না। আমার ভূমিকা এখানেই শেষ। এবার জনগণ, অর্থাৎ আপনারা আমার সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলবেন কিনা সেটা আপনাদের বিবেচনার বিষয়। এ নিয়ে আপনারা ভাবতে থাকুন; আমি নিজের কাজ করে যাই।
এই মুহূর্তে ট্যাক্সি থেকে নেমে থিয়েটার রোডের একটা একুশতলা স্কাই-স্ক্রেপারের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার ডান হাতে এটা দামি ব্রিফ কেস। এখন প্রায় দুটো বাজে। ফেব্রুয়ারি মাসের আজ বাইশ তারিখ। অর্থাৎ শীত শেষ হয়ে সময়টা গরমের দিকে গড়াচ্ছে। গড়াচ্ছেই শুধু, গরমটা পুরোপুরি পড়েনি। শীতের ম্যাড়মেড়ে রোদ এখন অনেক ঝলমলে; তবে তাতে ধার নেই। দক্ষিণ দিক থেকে উল্টোপাল্টা হাওয়া দিচ্ছে; যে হাওয়া রীতিমতো আরামদায়ক। আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘও নেই। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশটা নীল আয়নার মতো দিগন্তের ফ্রেমে যেন আটকে আছে।
আস্তে আস্তে পা ফেলে আমি সামনের বাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঢুকলেই ডানদিকে পর পর চারটে লিফটু। এটা লিফট-বক্সে গিয়ে বোতাম টিপতেই সেটা হাউইয়ের মতো ওপরে উঠতে লাগল। আমি যাব এ-বাড়িরই ফোরটিনথ ফ্লোরে। ঝিঁঝির ডাকের মতো অটোমেটিক লিফটের একটানা মসৃণ শব্দ আমার কানে বেজে চলল।
পুরো এক মিনিটও লাগল না, লিফটটা ফোরটিন্থ ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়ে যেতে আপনা থেকেই দরজা খুলে গেল। আমি বাইরের লম্বা প্যাসেজে বেরিয়ে এলাম। প্যাসেজটা সোজা অনেক দূরে চলে গেছে। আর দু-ধারে পর পর অগুনতি ঘর।