- বইয়ের নামঃ আলোর ময়ুর
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সারা গায়ে ভোরের শিশির
আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়
০১.
সারা গায়ে ভোরের শিশির মেখে ট্রেনটা সাহেবগঞ্জ এসে গেল।
রোদ উঠতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। হিমে আর কুয়াশায় চারদিক ঝাপসা হয়ে আছে। সাঁওতাল পরগণার লম্বা পাহাড়ি রেঞ্জটা দূর দিগন্তে অস্পষ্ট আঁচড়ের মতন মনে হচ্ছে। আকাশের এ-কোণে ও-কোণে এখনও দু-চারটে জ্বলজ্বলে তারা চোখে পড়ে।
রেলের টাইম-টেবলে এই ট্রেনটার একটা জমকালো পোশাকি নাম আছে– আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। আজ খুব ভিড়-টিড় ছিল না। ইঞ্জিনের কাছাকাছি একটা সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে তপতী আর সোমা গা ছড়িয়ে বেশ আরামেই আসতে পেরেছে। কামরাটা এত ফাঁকা, ইচ্ছে করলেই ওরা এক সিটে, মাথা, এক সিটে হাত, এক সিটে পা রেখে আসতে পারত।
তপতীর বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মতন। গোলগাল আদুরে মুখ, ভরাট গলা, কণ্ঠার হাড় কোমল মাংসের তলায় ঢাকা। মসৃণ ত্বকে যেন কচি পাতার লাবণ্য। বড় বড় চোখে কাঁচের গুলির মতন উজ্জ্বল মণি। অজস্র চুল একবেণি করে বাঁধা। সারা রাত ট্রেন-জার্নির ফলে বেণিটা ভেঙে রুক্ষ্ম চুল উড়ছে; কপালের সবুজ টিপটা লেপটানো; পরনের শাড়িটা দলা মোচড়া হয়ে আছে।
সোমা তপতীর চাইতে দু-এক বছরের বড়ই হবে। মুখের গড়ন পানপাতার মতন। চোখ-নাক সব যেন কাটা-কাটা, নিখুঁত। গায়ের রঙ টকটকে; প্রতিমার মতন বিশাল চোখ। চুলগুলো খোঁপায় আটকানো। তপতীর মতন তার চোখে-মুখে চেহারায় উজ্জ্বলতা নেই। ঝকঝকে আয়নার ওপর ধুলো বালি জমলে যেমন দেখায় সোমাকে ঘিরে তেমনি এক বিষাদ মাখানো রয়েছে। চোখের তলায়, কপালে, ঘাড়ে কাঁচে শ্যাওলার মতন ছোপ। সেটা ট্রেনে রাত কাটাবার জন্য নয়। সোমার দিকে তাকালেই মনে হবে, তার ভেতরে অনবরত এক যুদ্ধ চলছে।
প্ল্যাটফর্ম থেকে টি-ভেন্ডারদের ঘুমন্ত ভারী গলা ভেসে আসছে, চা গ্রাম (গরম) চা গ্রাম কুলিরা সামনে চেঁচাচ্ছিল, সাহাবগঞ্জ-সাহাবগঞ্জ-চেঁচাতে চেঁচাতে হুড়মুড় করে কামরায় কামরায় ঢুকে পড়ছিল।
তপতী হাই তুলে আর আঙুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে আলস্য কাটিয়ে নিল। এলোমেলো শাড়িটা ঠিক ঠাক করে মুখের ওপর থেকে উড়ন্ত চুলগুলো দুহাতে সরাতে সরাতে সোমাকে বলল, এবার আমাদের নামতে হবে। জিনিসপত্র গোছগাছ করে নে সোমা। দু-এক বছরের বড় হওয়াটাকে আমলই দেয় না তপতী; সোমাকে সে নাম ধরেই ডাকে।
সোমা উঠে পড়ল। জিনিসপত্র আর কী। দুটো হাওয়া ভর্তি বালিশ, একটা চাদর আর একটা কম্বল হোল্ডল থেকে বার করে ওরা পেতে নিয়েছিল। সময় কাটাবার জন্য দুটো সস্তা থিলারও সুটকেশ থেকে বার করা হয়েছিল।
দ্রুত চাদর-টাদর ভাঁজ করতে লাগল সোমা। তপতী বলল, অত তাড়াহুড়ো করতে হবে না; আস্তে আস্তে গোছা। এখানে দশ মিনিটের স্টপেজ। ইঞ্জিন জল-টল নেবে, তারপর ছাড়বে।
সোমা উত্তর দিল না। ভাজ-করা চাদর-কম্বল হোল্ডলে পুরে ফেলল। এদিকে হাওয়া-বালিশের হাওয়া বার করে বেতের বাস্কেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে তপতী; বই দুটো চালান করেছে, সুটকেশের ভেতর। দুজনের আলাদা আলাদা সুটকেশ। কিন্তু হোল্ডল একটাই, বাস্কেটও তাই। ও দুটো ভাগের। সব গোছানো-টোছানো হলে তপতী বলল, আপার ইন্ডিয়া আজ দারুণ এসেছে। দশ বছর এদিকে যাতায়াত করছি। যতবার এসেছি ততবারই দুতিন ঘন্টা লেট। এই প্রথম গাড়িটা রাইট টাইমে এল।
সোমা বলল, তাই নাকি।
তপতী উৎসাহের গলায় বলতে লাগল, আর এসেছিও গ্র্যান্ড। অন্য অন্য বার ভিড়ে দম আটকে আসে; এবার হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পেরেছি।
শুধু বসেই এসেছিস! সোম হাসল, ঘুমটা বুঝি বাদ গেল! যা নাক ডাকছিল! কতবার ঠেলেছি, ডেকেছি, তোর সাড়াই নেই।
তপতীও হেসে ফেলল, যা বলেছিল ভাই। ট্রেনে উঠলে আমার ভীষণ ঘুম পায়। তবে নাক ডাকে না।
নিজের নাক ডাকা কেউ শুনতে পায়?
তপতী বলল, আমি একাই ঘুমিয়েছি, তুই ঘুমোসনি? তুই বুঝি আমার নাক ডাকা শোনাবার জন্য জেগে বসে ছিলি?
সোমা চুপ করে রইল। তার মনে পড়ল কাল নটা দশে শিয়ালদা থেকে আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ছেড়েছিল। দক্ষিণেশ্বর পেরুবার আগেই তপতী ঢুলতে শুরু করেছিল, তারপর আরো দু-এক কিলোমিটার যেতে না যেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ঘুম ভেঙেছিল সাহেবগঞ্জ আসার খানিকটা আগে। সোমা কিন্তু ঘুমোত পারেনি। একেকটা স্টেশন এসেছে–বর্ধমান, বোলপুর, সাঁইথিয়া, তিনপাহাড়, রাজমহল, পাকুড়-সোমা শুধু জানালার বাইরে অন্ধকার আকাশের দিকে চোখ মেলে রেখেছে। মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে ঘুমন্ত তপতীকে দেখতে দেখতে এক ধরনের বিচিত্র ঈর্ষা অনুভব করেছে। তপতী কত সুখী, কত দুশ্চিন্তাহীন! আর সোমা নিজে? কমাস ধরে সে ইনসমনিয়ার রুগী। জীবনের আশ্চর্য এক জটিলতা তার ঘুম বিশ্রাম সুখ ছিনিয়ে নিয়েছে। দিনের বেলাটা তবু মানুষের ভিড়ে, নানারকম হইচই-তে কেটে যায়। কিন্তু রাত্রিবেলা কলকাতা নামে এক মহানগরের সব শব্দ সব হট্টগোল সব ব্যস্ততা যখন থিতিয়ে থিতিয়ে অতলে নামতে থাকে, পৃথিবী যখন ঘুমের আরকে ডুবে যায় সেই সময় ঘরময় হেঁটে বেড়ায় সোমা। সত্তর লক্ষ মানুষের নিদ্রিত শহরে সেই বোধ হয় একা, যার চোখে ঘুম নেই।