- বইয়ের নামঃ মহাভারতের মহারণ্যে
- লেখকের নামঃ প্রতিভা বসু
- প্রকাশনাঃ বিকল্প (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
মহাভারতের মহারণ্যে – ১.১
প্রথম পর্ব
১
মহর্ষি শৌনকের আশ্রমে পুরাণ-কথক সৌতি যেদিন এসে উপস্থিত হলেন, তার মুখ থেকেই ঋষিরা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত মহাভারত কথা শ্রবণ করলেন। এই গ্রন্থ ব্যাসদেবেরই ‘মনঃসাগর-সন্তুত-অমৃত-নির্বিশেষ-গ্ৰন্থ’, যে গ্রন্থ ইতিহাস পুরাণের অনুসরণ ও ভূত ভবিষ্যৎ বতর্মান কালত্রয়ের সম্যক নিরুপণ, এবং জরা মৃত্যু ভয় ব্যাধি ভাব অভাব শুধু নয়, ইতিহাস ভূগোল দশর্ন পুরাণ, এমনকি যুদ্ধকৌশল ভূতত্ত্ব নৃতত্ত্ব ইত্যাদি সকল বিষয়ের বিবরণে সমৃদ্ধ।
তবে দ্বৈপায়ন কিন্তু মূলত একটি বিশেষ রাজত্বের বিশেষ বংশ নিয়েই উপাখ্যানটি রচনা করেছেন। সেই বংশের নাম ভরতবংশ। যে ভরতবংশের ইতিহাস তিনি আমাদের গোচরীভূত করেছেন, তার স্থাপয়িত্রী শকুন্তলা। শকুন্তলা আশ্রমনিবাসিনী ছিলেন। পুণ্যতোয়া মালিনী নদী বেষ্টিত, বহু বৃক্ষ সমাকীর্ণ আশ্রমটি ব্যতীত কিছুই তিনি দেখেননি। তিনি কণ্বমুনির পালিতা অতি সরলা এক কন্যা। রাজা দুমন্ত শিকারে এসে অতি রমণীয় একটি বনে উপস্থিত হলেন। অনেক পশু বধ করে একাই ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে পড়েছিলেন। এই রমণীয় বনের মধ্যেই তিনি অতি মনোরম আশ্রমটি দেখতে পেলেন। আশ্রমটি দেখতে পেয়ে তিনি সেখানে প্রবিষ্ট হলেন এবং কুটিরটির নিকটে এসে উচ্চস্বরে ডেকে বললেন, ‘এখানে কে আছেন?’
লক্ষ্মীর মতো এক সুন্দরী কন্যা বেরিয়ে এসে রাজা দুষ্মন্তকে স্বাগত জানিয়ে অভ্যর্থনা করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী প্রয়োজন বলুন, আমার পিতা কণ্বমুনি ফল আহরণ করতে গেছেন, একটু অপেক্ষা করলেই তিনি এসে যাবেন।‘ রাজা দুষ্মন্ত বললেন, ‘আপনি কণ্বমুনির দুহিতা?’ কিন্তু তিনি তো উর্ধ্বরেতা তপস্বী। শকুন্তলা তখন তাঁকে তার জন্মবৃত্তান্ত বললেন। তারপর বললেন, শরীরদাতা, প্রাণদাতা, অন্নদাতাঁকে শাস্ত্রমতে পিতা বলা হয়। মহারাজ। আমাকে কণ্বমুনির দুহিতা বলেই জানবেন। শকুন্তলা যখন কুটির থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন কোনো কথাবার্তা বলার পূর্বেই তাঁকে দেখে তৎক্ষণাৎ দুষ্মন্তের কামস্থহ প্রজ্বলিত হুতাশনের মতো লেলিহান হয়ে উঠেছিলো। তিনি বললেন, “তোমার লাবণ্যসলিলে আমি আকণ্ঠ মগ্ন। তোমার শরীরের উপর তোমার কর্তৃত্ব, তাই তুমি আত্মসমর্পণ না করলে তোমাকে পেতে পারছি না, তুমি প্রার্থনা পূরণ করো। তখন শকুন্তলার মতো একটি সরল মধুর অপাপবিদ্ধ আশ্রমকন্যার পক্ষে যা নিতান্তই অস্বাভাবিক, দেহ সমর্পণ করার পূর্বে তিনি কিন্তু সেই রকমই একটি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন দুষ্মন্তকে দিয়ে। ঠিক সত্যবতীর মতো বললেন, “আপনার ঔরসে আমার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে, আপনি বিদ্যমানে সে যুবরাজ হবে এবং অবিদ্যমানে রাজা হবে।’
দুষ্মন্ত বললেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’ তারপর গন্ধর্ব মতে বিবাহ করে শকুন্তলার সমর্পিত দেহ নিয়ে সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন করে চলে গেলেন। বলে গেলেন, ‘আমি তোমাকে যোগ্য সমাদরে নিয়ে যাবার জন্য চতুরঙ্গিণী সেনা পাঠাবো, রানীর সম্মানে তুমি রাজভবনে প্রবিষ্ট হবে।’ ব্যাস, সেই যে গেলেন আর কোনো খবর নেই।
ইতিমধ্যে যথাসময়ে শকুন্তলার মহাপরাক্রান্ত, মহাবল, অলৌকিক গুণসম্পন্ন এক পুত্রের জন্ম হলো। এর পরের ঘটনায় আসবার পূর্বে একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করতে বলি। মহাভারতের সমস্ত বিখ্যাত কন্যার জন্মই রূপকথার আচ্ছাদনে আবৃত। ইন্দ্রের নির্দেশে বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ করে তাঁর সঙ্গে সঙ্গমজাত কন্যাকে জন্মানো মাত্রই তার মাতা অপ্সরা মেনকা মালিনী নদীর তীরে হিংস্র জন্তু সমাকীর্ণ নির্জন বনে নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। কণ্বমুনি নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখলেন পক্ষীরা একটি সদ্যোজাত শিশুকে জন্তু জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ঘিরে বসে আছে। মুনি দয়াপরবশ হয়ে কন্যাটিকে এনে স্বীয় আশ্রমে স্বীয় কন্যার মতো পালন করতে লাগলেন। সত্যবতীর জন্মবৃত্তান্ত আরো অদ্ভুত। তিনি জন্মান মাছের পেটে। গল্পটা এই রাজা উপরিচর বসুর মৃগয়ায় গিয়ে বসন্তের শোভা নিরীক্ষণ করতে করতে স্ত্রীর জন্য কামনার উদ্রেক হয়। এবং সেই কারণে তার শুক্র স্থলিত হয়। সেই শুক্র গ্রহণ করে এক মৎসীরূপী অপ্সরা গর্ভবতী হয়। কন্যা জাত হবার পর সেই অঙ্গরা শাপমুক্ত হয়ে আকাশপথে চলে গেলে মৎসীর গর্ভজাত কন্যাকে পালন করেন এক ধীবর। সেই থেকে ধীবরকন্যা রূপেই সত্যবতীর পরিচয় পঞ্চপাণ্ডববধূদ্রৌপদী যজ্ঞবেদী থেকে উত্থিতা। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন এই সব কন্যাদের জন্মবৃত্তান্ত কেন রহস্যাবৃত করেছিলেন, তখনকার সমাজে এই সব কন্যাদের প্রকৃত জন্মবৃত্তান্ত বলায় বাধা ছিলো বলেই কি তিনি অলৌকিকের আশ্রয় নিয়েছিলেন, সে কৌতুহল থেকেই যায়।
শকুন্তলার পুত্রের ছয় বৎসর বয়স হয়ে গেলেও যখন তার পিতা দুষ্মন্ত পত্নীকে সাড়ম্বরে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, কোনো খোঁজই আর নিলেন না, তখন কণ্বমুনি সপুত্র শকুন্তলাকে পতিগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু রাজা তার পত্নী ও পুত্রকে গ্রহণ করলেন না। কটু ভর্ৎসনা করে সম্পর্ক অস্বীকার করলেন। তাঁকে বললেন, ‘স্ত্রীলোকেরা প্রায়ই মিথ্যেকথা বলে। কে তুমি দুষ্ট তাপসী? আমি তোমাকে চিনি না।’