- বইয়ের নামঃ হীরকাঙ্গুরীয়
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. বাইরে ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি
বাইরে ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছিল। কাল মধ্যরাত্রি থেকে বৃষ্টি নেমেছে। বিরামহীন বৃষ্টি। একটানা ঝরছে তো ঝরছেই।
রাস্তাঘাট জলমগ্ন। জলে চারিদিক থৈ থৈ করছে। রাস্তায় কোথাও গোড়ালি জল, কোথাও তার চাইতেও বেশী। সমস্ত আকাশটা মেঘে মেঘে একেবারে মসীবর্ণ। মসীবর্ণ আকাশ মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের ঝলকে ঝলসে ঝলসে উঠছিল। শুধু তো বৃষ্টি নয়, সেই বৃষ্টির সঙ্গে সোঁ সোঁ হাওয়া। এলোমেলো হাওয়া।
বেলা প্রায় দশটা হবে।
অবিশ্রান্ত জল হলেও যানবাহন ও মানুষজনের কিন্তু বিশ্রাম ছিল না—একমাত্র ট্রাম ব্যতীত অন্যান্য সবপ্রকার যানই চলাচল করছিল ঐ প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেই। ছাতি মাথায় মানুষজনও পথে চলছিল।
এই দুর্যোগের মধ্যে কিরীটীর বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার একটুও ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার ডি.সি. মানিক চাটুয্যে তাকে নিষ্কৃতি দেয়নি। আসতেই হবে বলে তাকে বাড়ি থেকে টেনে বের করেছিল। কিরীটী তার গাড়ির পিছনের সিটে চারদিককার কাঁচ তুলে দিয়ে বসে ছিল।
হীরা সিং গাড়ি চালাচ্ছিল। রাস্তাঘাট জলমগ্নতার মধ্যে দিয়ে সন্তর্পণে গাড়ি চালাচ্ছিল হীরা সিং। সারকুলার রোডে ক্রিমেটোরিয়াম ছাড়িয়ে জোড়া গিজার পিছন দিকে একটা বাড়িতে তাকে যেতে হবে। মানিক চাটুয্যে তাকে বলেছে বড় রাস্তার উপরেই পুলিসের জীপ থাকবে, সে তাকে পথ দেখিয়ে আনবে।
কে এক নবাব সাহেবের বাড়িতে তার তৃতীয়া বেগমসাহেব নাকি নিহত হয়েছে, কেন কি বৃত্তান্ত কিছুই ফোনে জানায়নি মানিকবাবু আর কিছুই। কেবল বলেছে, আসুন, এলেই সব জানতে পারবেন, আপনার সাহায্য একান্ত প্রয়োজন।
কিরীটী এড়াবার চেষ্টায় ছিল। বলেছিল, হত্যা, না আত্মহত্যা?
আত্মহত্যা নয়, a pure and simple case of murder. আসুন একবার দয়া করে। আপনি কিছু ভাববেন না। ক্রিমেটোরিয়ামটা ছাড়ালেই জোড়া গিজার আগে বড় রাস্তার উপরে পুলিসের জীপ দেখতে পাবেন।
আসল ব্যাপারটা হচ্ছে কিরীটী ঐ মানিক ছেলেটিকে একটু স্নেহ করে। বয়স বেশী নয়। এখনো ত্রিশ হয়নি। কয়েক বছর মাত্র পুলিসের কাজে ঢুকেছে এবং ইতিমধ্যে ডি.এস.পি-র পদে উন্নীত হয়েছে। বেঁটেখাটো মানুষটা। রোগা পাতলা গড়ন।
বছরখানেক পূর্বে একটা বিচিত্র হত্যা-মামলার ব্যাপারে প্রথম ঐ মানিক চাটুয্যের সঙ্গে কিরীটীর পরিচয় হয়। সেই সময়ই কিরীটী ছেলেটির বুদ্ধি ও বিচারশক্তি দেখে চমৎকৃত হয়েছিল।
সেই মানিক চাটুয্যে যখন ডেকেছে ব্যাপারটার মধ্যে নিশ্চয়ই রহস্যের বৈচিত্র্য কিছু আছে। নচেৎ ঐ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে এমন করে জরুরী তলব দিয়ে বিরক্ত করত না।
সারকুলার রোডের একটা বিশেষত্ব আছে। যত জলই হোক না কেন কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট যতই জলে ড়ুবে যাক না কেন—এ রাস্তায় কখনোতেমন জল জমে না। ক্রিমেটোরিয়াম ছাড়াবার পরই জোড়া গিজার অল্প দূরে দেখা গেল একটা ক্যালকাটা পুলিসের জীপ দাঁড়িয়ে আছে।
কিরীটী আগে থাকতেই হীরা সিংকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল। হীরা সিং সোজা গিয়ে জীপটার পাশে গাড়ির ব্রেক কষল। অতঃপর সেই জীপ গাড়িই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
পূবমুখো রাস্তাটা ধরে কিছু দূরে এগুবার পর একটা বাগান ও গেটওয়ালা পুরাতন বাড়ির মধ্যে ওরা পর পর এসে প্রবেশ করল। অনেকটা জুড়ে বাগান। মধ্যে মধ্যে তার বড় বড় দেবদারু গাছ। বৃষ্টি ও হাওয়ায় ওলটপালট করছিল গাছগুলো।
তিনতলা একটা বিরাট পুরাতন বাড়ি। গাড়িবারান্দার নীচে এসে গাড়ি দুটো আগে পিছে থামল। গাড়িবারান্দায় দুজন লাল পাগড়ি দাঁড়িয়েছিল।
কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই তাদের মধ্যে একজন কিরীটীকে সেলাম দিয়ে বললে, ডি.সি. সাহেব ভিতরে আছেন, যান।
যে সার্জেন্টটি জীপে অপেক্ষা করছিল কিরীটীর জন্য, সে-ই কিরীটীর গাড়ি দেখে জীপ। থেকে নেমে বষতি গায়ে এগিয়ে আসে।
কিরীটী প্রশ্ন করে, কত দূর?
এই কাছেই, চলুন।
অনেককালের পুরনো বাড়ি বলেই মনে হয়। এখানে-ওখানে দেওয়ালের প্লাসটার খসে পড়েছে। প্রথমেই একটা হলঘর। বিরাট আকারের হলঘর। মাথার উপরে সিলিং অনেক উঁচুতে।
সিলিং থেকে দুটি বড় ঝাড়বাতি ঝুলছে। ইলেকট্রিক আলো ও দুটো ফ্যানও আছে। দেওয়ালে বিরাট বিরাট কয়েকটি অয়েল পেনটিং টাঙানো ছিল। জাঁকজমক পোশাক পরা ছবির মানুষগুলো।
মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো কয়েকটি পুরাতন আমলের গদী-মোড়া ভেলভেটের সোফা-সেটও আছে।
হলঘরের মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অন্দরের দরজাপথে মানিক চাটুয্যে এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
এসেছেন মিঃ রায়! আসুন!
মানিক চাটুয্যের পরনে পুলিসের ইউনিফর্ম।
কি ব্যাপার মানিকবাবু?
একটি সুন্দরী মেয়ে নিহত হয়েছে।
কিরীটী মৃদু হাসল। তারপর বললে, খুব সুন্দর বুঝি—
না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না মিঃ রায়, চলুন আগে দেখবেন—
মানিক চাটুয্যে আগে আগে এগিয়ে যায়, কিরীটী তার পিছনে পিছনে অগ্রসর হয়।
হলঘরের পরেই একটা টানা বারান্দা। চারদিক ঘেরা বারান্দাটা।
০২. বারান্দার শেষপ্রান্তে
বারান্দার শেষপ্রান্তে পূর্বদিকে বিরাট চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। সাদা কালো পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি। অদ্ভুত স্তব্ধ যেন বাড়িটা। মনে হয় যেন একটা কবরখানা বুঝি!
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কিরীটী প্রশ্ন করে, এ বাড়ির মালিক কে?
বৃদ্ধ নবাব আসগর আলী সাহেব।
আসগর আলী!
হ্যাঁ—এরা লক্ষ্ণৌর নবাব বংশেরই একটা শাখা। মানিক চাটুয্যে বলে।
কি রকম?
তিন পুরুষ আগে লক্ষ্ণৌ থেকে এরা চলে এসে প্রথমে মেটেবুরুজে বসবাস করেছিল কিছুদিন; তারপর এসে এই মতিমঞ্জিল তৈরী করে—মানে ঐ আলী সাহেবের ঠাকুদা—অবশ্য তারও তখন প্রৌঢ় বয়স।
অনেক বছর আগে নিশ্চয়ই? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ-লর্ড ক্যানিং-এর আমলে সেটা।
হুঁ–তা ঐ নবাব আলী সাহেবের কে কে আছেন?
আপনার বলতে এক ভাগ্নে—আর তিন বেগম—
কোন ছেলেপিলে কিছু নেই? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
ছেলে এক ছিল।
বেঁচে নেই বুঝি?
আছে তবে বাপের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
সম্পর্ক নেই মানে?
হ্যাঁ—সে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে বহুদিন পৃথক হয়ে গিয়েছে।
কোথায় থাকে সে? এই শহরেই কি?
হ্যাঁ—এই শহরেই—মেটেবুরুজে।
বয়স কত তার?
তা শুনেছিলাম ত্রিশ-বত্রিশ হবে রোশন আলী নাম—নামটা হয়ত আপনি শুনে থাকবেন বিখ্যাত সেতারিয়া রোশন আলী।
কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আরে রোশন আলীকে তো আমি খুব ভালভাবে চিনি, অতি চমৎকার সজ্জন ব্যক্তি যেমন চেহারা তেমনি ব্যবহার।
আমি অবিশ্যি তাকে চিনি না।
পরিচয় কোরো—চমৎকার সেতারিয়া। কিরীটী বললে, রোশন সাহেব যাকে বিয়ে করেছেন সেও তো নামকরা শিল্পী
আলী সাহেবের এক বেগমও তো এককালে নামকরা নৃত্যশিল্পী ছিল।
নৃত্যশিল্পী?
হ্যাঁ। নৃত্যশিল্পী মণিকাদেবীর নাম শোনেননি?
হ্যাঁ শুনেছি, কিন্তু সে তো ছিল ব্রাহ্মণের মেয়ে। কিরীটী বলে।
সেই–
ভাল কথা—মণিকাদেবী হঠাৎ বছর কয়েক আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন না?
নিখোঁজ আর কি বম্বেতে পালিয়ে গিয়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে ঐ আলী সাহেবকে বিয়ে করে।
বটে! তা বয়সের তো অনেক তফাৎ হবে দুজনের মধ্যে?
তা তো হবেই—তা সেই বেগমও কি
এখানেই আছে।
আর কে আছে এখানে?
কে আর–তিন বেগম, নবাব সাহেব ও তস্য ভাগ্নে ছাড়া আর কেউ নেই এ বাড়িতে আপনার জন বলতে। আছে চাকরবাকর ড্রাইভার—ভাল কথা, ভুলে গিয়েছিলাম, আরো একজন আছে—দাস-দাসী অবিশ্যি—
আরো একজন?
হ্যাঁ। সৌমেন কুণ্ডু নামে এক ভদ্রলোক—ইয়ং ম্যান বয়স ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে হবে।
তিনি এখানে কি করেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
বলতে পারেন আলী সাহেবের সে-ই সব দেখাশোনা করে সেক্রেটারী—পরামর্শদাতা সব কিছু।
ইতিমধ্যে ওরা কথা বলতে বলতে দীর্ঘ সিঁড়ি অতিক্রম করে দোতলায় পৌঁছে গিয়েছিল।
নীচের তলার মত উপরের তলাতেও একটি প্রশস্ত টানা বারান্দা। একটা দিকে ঘর পর পর—অন্য দিকে কাঠের ঝিলিমিলি বাতাস ও আলো আসার বলতে গেলে কোন পথই নেই। বোধ করি নবাবী আব্রুর জন্যই ঐ সাবধানতা।
বারান্দায় কিছু কিছু শ্বেতপাথরের মূর্তি এখানে-ওখানে দাঁড় করানো।
০৩. বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকায় আলোর অভাবে বারুদাটায় আবছা আলোছায়া যেন কি এক রহস্যে থমথম করছে। বারান্দায় কোন জনপ্রাণীকে দেখা গেল না।
কিরীটী মানিকের সঙ্গে পাশপাশি হেঁটে চলে।
পর পর সব ঘর। ঘরের দরজায় দরজায় সব পুঁতির পদা ঝুলছে।
তৃতীয় দ্বারপথে মানিক চাটুয্যেকে অনুসরণ করে পুঁতির পর্দা সরিয়ে কিরীটী একটা হলঘরের মতই প্রশস্ত ঘরে প্রবেশ করল। ঘরের মেঝেতে কার্পেট বিছানো। পুরনো আমলের ভারী দামী আসবাব। আর বিরাট একটা আরশি—সুদৃশ্য চওড়া সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো—ঘরের পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে একেবারে মুখখামুখি টাঙানো।
যে দরজা-পথে ওরা ঘরে প্রবেশ করেছিল সে দরজা ছাড়াও একটি পশ্চিমমুখী দরজা দেখা গেল ঘরে। তাতেও ঐ একই ধরনের পর্দা ঝুলছে। গোটাচারেক জানলা। সবই দক্ষিণমুখী। জানলাগুলো বন্ধই ছিল একটি বাদে।
কিরীটী প্রশ্ন করে, ডে বডি কোথায়?
ঐ পূব দিককার ঘরে, আসুন না।
কিরীটী মানিক চাটুয্যেকে অনুসরণ করে।
কয়েক পা অগ্রসর হয়েই সহসা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আরশির মসৃণ গাত্রে ওর নজর পড়তেই ও যেন নিজের অজ্ঞাতেই থমকে দাঁড়িয়ে যায় মুহূর্তের জন্য।
একটি নারীর মুখ চকিতে ভেসে উঠেছিল আরশির মসৃণ গাত্রে। বোরখায় আবৃত মুখখানা। কিন্তু মুহূর্তের জন্য বোরখা মুখের উপর থেকে অপসারিত হয়েছিল।
কি সুন্দর কি কমনীয় একখানি নারীর মুখ। টানা জ্ব। টানা টানা দুটি চোখ। আর সেই চোখের তারায় যেন একটা ভীতি একটা সংশয়।
কিরীটী থমকে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই আরশির গা থেকে সে মুখের প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে যায়। কিরীটীকে থামতে দেখে মানিক চাটুয্যে শুধাল, কি হল?
না—কিছু না—চলল।
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সহসা নারীকণ্ঠের একটি হাসির তরঙ্গ যেন সেই স্তব্ধ গৃহের দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়ল।
খিলখিল করে কে হাসছে। হাসির শব্দটা যেন হঠাৎ উঠে হঠাৎই আবার মিলিয়ে গেল।
মিলিয়ে গেল নবাব আলী আসগর সাহেবের জীর্ণ অট্টালিকার দেওয়ালে দেওয়ালে, যেন শুষে নিল সেই হাসির শব্দটা।
বাইরে ঝড়-বৃষ্টি তেমনি চলেছে। সোঁ সোঁ হাওয়ায় ঝাউগাছের কান্না তেমনি শোনা যায়।
কিরীটী মানিক চাটুয্যের দিকে তাকায় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।
মানিক চাটুয্যেও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই হাসির শব্দে।
কে হাসল যেন মনে হল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ শুনলাম, মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় মানিক চাটুয্যে, দেখব খোঁজ নিয়ে?
না থাক, চলো।
কিরীটী কথাটা বলে মানিক চাটুয্যেকে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করে।
কয়েক পা অগ্রসর হতেই দুজনে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
এই ঘরে—
মানিক চাটুয্যে বলে। চলল….
অন্যান্য ঘরের দরজার মত এ ঘরেও পুঁতির পর্দা ঝুলছিল সেই পুঁতির পর্দা সরিয়ে সেই দরজার কবাট ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।
বোঝা গেল দরজাটা ভেজানো ছিল মাত্র।
প্রথমে মানিক চাটুয্যে ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে যায় কিরীটী।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হচ্ছিল থেকে থেকে, সেই সঙ্গে মৃদু একটা টুং টুং শব্দ। ঘরের মধ্যে।
কিরীটী তাকিয়ে দেখল ঘরের একটা জানলা খোলা।
বাতাসের ঝাপটায় সেই জানলার কাঁচের পুরাতন পাল্লা দুটো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলছে তাতেই। হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটা এসে ঘরে ঢুকছে। মাথার উপর শিলিং থেকে ঝুলন্ত বিরাট ঝাড়বাতির বেলোয়ারী কাঁচগুলো হাওয়ায় পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টুং টুং শব্দ করছে, সঙ্গীতের একটা বিলম্বিত সুর যেন।
ঘরের মধ্যে ঝাপসা আলো। রহস্যময় একটা অস্পষ্টতা যেন।
হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হল সঙ্গে সঙ্গে কক্ষটা উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে উঠল। কিরীটী তাকিয়ে দেখল ঝড়ের মধ্যে ইলেকট্রিক বাল্বগুলো একসঙ্গে সব জ্বলে উঠেছে।
সুইচটা টিপে মানিক চাটুয্যেই আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রখর আলোয় ঘরটা যেন এতক্ষণে চোখের সামনে দেখা দিল।
কারো শয়ন বা বসবার ঘর নয় এটা। জলসাঘর। মেঝেতে পুরু গালিচা বিছানোবড় বড় তাকিয়া-তাতে রেশমী ঝালর দেওয়া—চারদিকে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ছড়ানো। সেতার সারেঙ্গী বীণা সরোদ তানপুরা বাঁয়া তবলা ইত্যাদি—আর তারই মাঝখানে একটি নারীদেহ এলিয়ে পড়ে আছে। শুধুমাত্র সুন্দর বললেই বোধ হয় সব বলা হয় না—অতুলনীয় সুন্দর—এবং শুধু সুন্দর নয়, যেন আশ্চর্য!
কিরীটীর মনে হয় এমনটি বুঝি আর সে ইতিপূর্বে দেখেনি।
বয়স কতই বা হবে কুড়ির বেশী হবে না। পরনে দামী রেশমের শালোয়ার ও কাঁচুলী, তার উপর একটি সুক্ষ্ম ওড়না—ডানদিকের বুকে একটা ছোরা আমূল বিদ্ধ।
কাঁচুলীটা রক্তে লাল হয়ে রয়েছে
কানে হীরের কণাভরণ। হাতে দুগাছি করে প্ল্যাটিনামের উপরে হীরের চুড়ি। পায়ে ও হাতের পাতায় মেহেদীর রঙ। মাথায় চুল বেণীবদ্ধতাতে একটি সোনাল ফিতে জড়ানো-এক পাশে বেণীটা সাপের মত এলিয়ে পড়ে আছে।
টানা ভ্রূ। নিমীলিত আঁখিপদ্ম। একটা হাত ছড়ানোঅন্য হাতটা দেহের সঙ্গে লেগে আছে।
ছোরার বাঁটটা সাদা কারুকার্য করা। তরুণীর বক্ষে যদি ছোরাটা আমূল না বিদ্ধ থাকত মনে হত বুঝি সে ঘুমিয়ে আছে।
কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে ভূলুষ্ঠিত প্রাণহীন দেহটার দিকে চেয়ে থাকে।
০৪. মানিক চাটুয্যেই প্রথমে কথা বলে
মানিক চাটুয্যেই প্রথমে কথা বলে।
আলী সাহেবের সর্বকনিষ্ঠা বেগম–জাহানারা।
জাহানারা?
হ্যাঁ। বয়স বেশী বলে তো মনে হচ্ছে না!
না।
হুঁ। ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছেন? কখন ব্যাপারটা ঘটেছে বা কে প্রথম জানতে পারল
মোটামুটি যা জানতে পেরেছি–নাসির হোসেনের কাছে–
নাসির হোসেন?
হ্যাঁ—আলী সাহেবের ভাগ্নে। ওঁর বোনের—সুলতানা বেগমের একমাত্র ছেলে—
নাসির হোসেন সাহেব এখানেই থাকেন তো?
হ্যাঁ।
নাসির হোসেন যা বলেছিল মানিক চাটুয্যেকে, অতঃপর সেই কাহিনী বিবৃত করে মানিক চাটুষ্যে।
আলী সাহেবের তিন বেগম।
রৌশনারা বেগমমাণিক বেগম ও সর্বকনিষ্ঠা জাহানারা বেগম।
বড় বেগম রৌশনারার বয়স বাহান্ন-পঞ্চান্নর উর্ধেই হবে—
মধ্যমা মাণিক বেগম-মুসলমানেরা ঘরের মেয়ে নয়—হিন্দুর কন্যা আগেই বলা হয়েছে।
মুসলিম ধর্ম গ্রহণের পর মণিকার নাম বদলে আলী সাহেব তার নাম রাখেন মাণিক। মাণিক আলী সাহেবের দেওয়া আদরের নাম।
নবাব আলী সাহেবের এক হিন্দু কর্মচারী ছিল যতীন চাটুয্যে—তারই কন্যা ঐ মণিকা।
সর্বকনিষ্ঠা জাহানারাকে আলী সাহেব মাত্র বছর দুই আগে সাদী করেছিলেন।
আসগর আলী সাহেবের বয়স এখন প্রায় বাহাত্তর-তিয়াত্তর হবে। বৃদ্ধ হলেও কিন্তু দেখে সেটা বুঝবার উপায় নেই। দীর্ঘ লম্বা পাতলা চেহারা। টকটকে গৌর গাত্রবর্ণ। এখনো সোজা হয়ে হাঁটা-চলা করেন। মাথার চুল ও দাড়ি পেকে অবশ্য সাদা হয়ে গিয়েছে। খুব আমুদে রাশভারী মানুষ।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, শুধু তাই বলুন শক্তিমান পুরুষও–
মানিক চাটুয্যে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, নচেৎ তৃতীয়বার বেগম সংগ্রহ করেন ঐ বয়সে!
মানিক চাটুয্যেও হাসে।
বলুন তারপর–
জাহানারা গরিবের ঘরের মেয়ে হলেও অত্যন্ত মেধাবী ছিল বলে বি.এ. পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল নিজের চেষ্টায়। এবং সেই সঙ্গে গানবাজনাও। সংগীতে অপূর্ব মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ ছিল তার।
নিজের চেষ্টাতেই গান শিখেছিলো লেখাপড়ার মতই।
জাহানারার সঙ্গে আসগর আলী সাহেবের বিবাহের ব্যাপারটাও নাকি বিচিত্রজাহানারা নাকি ইচ্ছে করেই আসগর আলী সাহেবকে সাদী করেছে।
অনেকেই ব্যাপারটায় যে বিস্মিত হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই।
আসগর আলী সাহেব চিরদিনই একজন সংগীত-রসগ্রাহী। সংগীতকে তিনি বরাবরই ভালবাসতেন বলে প্রায়ই তাঁর গৃহের জলসাঘরে গানের জলসা বসত। বহু গুণী জ্ঞানী সংগীতশিল্পীরা ঐ জলসাঘরে এসে মাইফেলে যোগ দিয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়াও মধ্যে মধ্যে জাহানারা একাই সংগীতের আসর বসাত। এবং সে আসরে শ্রোতা থাকতেন তার স্বামীই—আসগর আলী সাহেব।
গত রাত্রেও তেমনি সংগীতের আসর বসেছিল ঐ জলসাঘরে। দুটি মাত্র প্রাণী।
জাহানারা বেগম ও নবাব আসগর আলী সাহেব।
আলী সাহেবের শরীরটা নাকি গত রাত্রে তেমন ভাল ছিল না—তাই রাত দশটার পর তিনি উঠে চলে যান জলসাঘর থেকে।
তারপর একাই নাকি জাহানারা বেগম বসে বসে জলসাঘরে গান গাইছিল।
জাহানারার নিজস্ব দাসী মোতি—জলসাঘরের দরজার বাইরে বসেছিল—অন্যান্য রাত্রে রাত বারোটার বেশী থাকত না জাহানারা জলসাঘরে।
কিন্তু গত রাত্রে সাড়ে বারোটা বেজে গেল তখনো সংগীতের বিরাম নেই তা ছাড়া বাইরে ঝড়জল বসে থাকতে থাকতে দাসী মোতি একসময় নাকি ঘুমিয়ে পড়ে। এবং কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছিল বলতে পারে না।
হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙে যায়।
সংগীত তখন আর শোনা যাচ্ছে না কেবল ঝড়জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর ঝাউগাছগুলোর সোঁ সোঁ করুণ কান্না।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মোতি।
জলসাঘরের দরজা খোলা-পুঁতির ভারী পদাটা হাওয়ায় দুলছে আর মৃদু ঝিম্ ঝিম্ শব্দ তুলছে।
বেগম সাহেবা কি চলে গেলেন নাকি? কিন্তু তাকে ডাকেন নি কেন? জলসাঘরে আলো জ্বলছে না তো—তবে কি সত্যি চলে গিয়েছেন শয়নঘরে বেগম সাহেবা?
পুঁতির পর্দা সরিয়ে মোতি ঘরের মধ্যে পা দেয়।
ঘরটা অন্ধকার।
একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা—সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে।
কেমন যেন আতঙ্কে সর্বাঙ্গ সিরসির করে ওঠে মোতির।
কয়েকটা মুহূর্ত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
তারপর সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই তার ঐ বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়ে-সঙ্গে সঙ্গে মোতি চিৎকার করে উঁচচিয়ে ওঠে।
ঘর থেকে পাগলের মত ছুটে বের হয়ে যায়।
০৫. মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে
খুন—খুন!
মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে এল। মধ্যরাত্রে বাড়িটার মধ্যে যেন একটা চকিত সাড়া পড়ে যায়। আলী সাহেব—অন্যান্য দুই বেগম ঘুম ভেঙ্গে উঠে আসে। নাসির হোসেন ঐ সময় ফিরে আসে বাড়িতে।
কেন-সে কি বাড়িতে ছিল না? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না। মানিক চাটুয্যে বলে।
কোথায় ছিল তবে?
বেলগাছিয়ায় তার এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল বিকেলেই চলে গিয়েছিল।
তারপর?
সবাই বিহ্বল–সবাই বিমূঢ়–অতঃপর কি কর্তব্য—ঐ সময় নীচ থেকে সৌমেন কুণ্ডুকে আলী সাহেব ডেকে পাঠান।
সৌমেন ঘুমোচ্ছিল, উঠে এসে সব শুনে সে তো বোবা।
অবশেষে সৌমেন কুণ্ডুই থানায় খবর দেয়। থানার ও.সি. সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সংবাদ দেয়—দিয়েই সে চলে আসে।
এ তল্লাটের ও.সি. কে?
সুশীলবাবু—সুশীল মুখার্জী–
তাঁকে দেখছি না যে?
আছে সে।
কোথায়?
আলী সাহেবের ঘরে বসে বোধ হয় জবানবন্দি নিচ্ছে।
কিরীটী আর কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে মৃতদেহের সামনে এগিয়ে যায়।
শব স্পর্শ করে। ঠাণ্ডা—হিম। অন্তত কয়েক ঘন্টা আগে যে মৃত্যু হয়েছে সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।
চেয়ে থাকে মৃতদেহের দিকে কিরীটী। সহসা ডান হাতের অনামিকার প্রতি নজর পড়ে—আঙুলে সুস্পষ্ট অঙ্গুরীর দাগ—অথচ আঙ্গুলে কোন অঙ্গুরী নেই
কিরীটী অতঃপর মৃতদেহের কাছ থেকে সরে এসে ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাল করে দেখতে লাগল।
খোলা জানলাপথে ঠাণ্ডা জলে হাওয়া আসছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্নই ছিল—আবার বোধ হয় বৃষ্টি নামল। এ বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। কিরীটী খোলা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই দেখেছে জানলাটা খোলা ছিল—জানলাটা দিয়ে সারাটা রাত ধরে বেশ বৃষ্টির ছাট এসেছে বোঝা যায়। মেঝের গালিচার অনেকটা পর্যন্ত সেই ছাটে ভিজে গিয়েছে জানলাপথে বাড়ির পশ্চাৎ দিকটা দেখা যায়—ঐটাই দক্ষিণ দিক।
অনেকখানি খোলা জায়গা বাগান—গাছপালা নানা জাতের জানলাটার একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে হাত দুই মাত্র ব্যবধানে একটা স্বর্ণচাঁপা ফুলের গাছ।
বিরাট উঁচু লম্বা গাছটা। হাওয়ায় ডালপালা ও পাতাগুলো যেন ওলট-পালট করছে। জানলার হাততিনেক নীচে চওড়াকার্নিশ। বরাবর আছে কার্নিশটা—অনায়াসেই ঐকার্নিশপথে এই জানলার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে জানলাটা ধরে এই ঘরে উঠে আসা যেতে পারে।
মানিকবাবু—
কিছু বলবেন? মানিক চাটুয্যে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
এই জানলাটা কি খোলাই ছিল?
তা তো বলতে পারি না।
জাহানারার দাসী মোতিকে জিজ্ঞাসা করেননি কথাটা?
না তো–
হুঁ–খুব সম্ভবতঃ জানলাটা খোলাই ছিল—ঐ দরজাটা তো খোলাই ছিল, তাই না?
হ্যাঁ—ভেজানো ছিল। ও.সি.কে সংবাদ দেন থানায় সৌমেন কুণ্ডুই—
হুঁ। কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক হস্তধৃত জ্বলন্ত চুরুটটা ঠোঁটে চেপে ধরে ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
ঘরের মধ্যে গোটা চারেক জানলাসবই বাইরের মানে দক্ষিণমুখী বাগানের দিকে—তিনটি জানলা বন্ধ, একটি মাত্র খোলা। দরজা তিনটে মনে হচ্ছে ওরা একটা দরজা-পথে ঐ ঘরে ঢুকেছে—অন্য দুটো বন্ধ—এবং দরজার গায়ে ভারী পুঁতির পর্দা ঝুলছে। নানা রঙয়ের নানা আকারের পুঁতি।
ঐ দরজাটা বন্ধ দেখছি? কিরীটী মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করে একটা দরজার দিকে তাকিয়ে—
হ্যাঁ-ওটা নাকি বন্ধই থাকে।
ব্যবহার করা হয় না বুঝি?
না—ওটা পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
পাশের ঘরটায় কে থাকে?
কেউ থাকে না—ও ঘরটার মধ্যে পুরাতন জিনিসপত্র থাকে এখন—আগে অবিশ্যি নবাব সাহেবের বৃদ্ধা ফুপু থাকতেন।
ফুপু-মানে পিসি?
হ্যাঁ।
আর ঐ দরজাটা?
ওটা বাথরুমে যাবার দরজা।
ঘরের সঙ্গে বাথরুম আছে?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য—এতদিনকার পুরাতন আমলের বাড়িতে—
কিরীটী কতকটা স্বগতোক্তির মতই মৃদুকণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করে।
মানিক চাটুয্যে জিজ্ঞাসা করে, কিছু বলবেন?
না। আচ্ছা চাটুয্যে সাহেব—
বলুন।
আচ্ছা, আলী সাহেবের বেগমদের কার কত বয়েস জানেন—মানে অনুমান আপনার—আপনি তো সকলেরই জবানবন্দি নিয়েছেন–
হ্যাঁ–রৌশনারার বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্নর কম হবে না—
দ্বিতীয়া—হিন্দু নারী মাণিক বেগমেরতার বয়সও চল্লিশের ঊর্ধ্বে তো হবেই–
দেখতে কেমন? Dont mind-বেগম সাহেবানরা?
রৌশনারা এককালে সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায় তবে দেহে এখন বার্ধক্যের ছাপ পড়ায়—
বুঝেছি—আর মানিক বেগম সাহেবা?
রূপের দিক থেকে তিনি যে খুব একটা—তা কিছু নয় কালো বোগা চেহারা, তবে চোখে মুখে প্রখর একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে দেখলেই বোঝা যায়।
আপনি তো বলছিলেন নবাব সাহেব ও তাঁর বেগম সাহেবরা ছাড়াও এখানে আলীর কে একজন আত্মীয় আছেন
হ্যাঁ–নাসির হোসেন সাহেব–
কে সে?
একটু আগে যে বললাম, নবাব সাহেবের ভাগ্নে—
হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
একটু থেমে আবার কিরীটী প্রশ্ন করে, দাসদাসী এখানে কজন আছে?
পাঁচজন দাসী ও চারজন ভৃত্য—
মোতি তো জাহানারার খাস দাসী ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
বয়স কত, দেখতে কেমন?
বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে–দেখতে তেমন ভালো নয়–তবে মনে হয় খুব চালাক-চতুর আর–
বলুন, থামলেন কেন?
আর একটা দাসী আছে এ বাড়িতে–নাম কুলসম—
কুলসম?
হ্যাঁ।
কার দাসী?
মানিক বেগমের খাস দাসী। অল্প বয়স–কুড়ি-পঁচিশের বেশী হবে না—দেখতে বেশ। কুলসম।
সুন্দর বলুন।
তা বলতে পারেন।
হুঁ–দেখেই মনে হয়েছিল—
কাকে–কাকে দেখে মনে হয়েছিল?
সেকথার জবাব না দিয়ে কিরীটীবলে, চলুন—এ ঘরের্যাদেখবার দেখা হয়ে গিয়েছে—অন্য একটা ঘরে গিয়ে বসা যাক–
বেশ, আলী সাহেবের বসবার ঘরে গিয়ে বসা যাক চলুন—
চলুন—ঐ ঘরে বসেই এ বাড়ির মানুষগুলোকে কিছু কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই।
আলি সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন না?
০৬. প্রয়োজন বুঝলে সবার সঙ্গেই দেখা করব
প্রয়োজন বুঝলে সবার সঙ্গেই দেখা করব—শুধু আলী কেন?
সকলে এসে দোতলাতেই আলী সাহেবের সোবার ঘরের পাশে বসবার ঘরে ঢুকল।
এ ঘরটি কিন্তু আধুনিক আসবাবপত্রে সজ্জিত। রুচি ও পরিচ্ছন্নতার প্রকাশ সর্বত্র যেন।
মানিকবাবু—
কিরীটীর ডাকে নানিক চাটুয্যে ওর মুখের দিকে তাকাল।
কিছু বলছেন?
হ্যাঁ।
কি বলুন?
একবার আপনাদের দাসী কুলসমকে ডাকবেন?
কুলসম?
হ্যাঁ।
মানিক চাটুয্যে বাইরে গিয়ে ঘরের একজনকে ডেকে কুলসমকে ঐ ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলে দিয়ে এল।
একটা বড় সোফায় কিরীটী বসে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল।
এ বাড়ি—এর ঐতিহ্য ও সব কিছুর সঙ্গে যেন এ ঘরের কিছুরই খাপ খায় না—যেন স্বতন্ত্র রীতিমত একটা পার্থক্য আছে।
মিঃ রায়—
বলুন।
আমার কিন্তু মনে হয়—এ হত্যার ব্যাপারটা বাইরের কারোর দ্বারা সংঘটিত হয়নি।
আপনি বলতে চান বাড়ির মধ্যে কেউ—
হ্যাঁ—আপনার কি মনে হয়?
সম্ভবত তাই। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী কথাটা বলে।
নচেৎ কাল সারাটা রাত ধরে যে ঝড় চলেছে—ঐ দুর্যোগের মধ্যেও কারও—মানে কোন বাইরের কারও এখানে এসে–
কিরীটী কথাটা শেষ করে, হত্যা করে যাওয়াটা তো অসুবিধা নয় বরং আরো সুবিধাই ছিল। মনে করুন—ঐ দুর্যোগের মধ্যে কেউ এসে হত্যা করে গেলে তার আসা-যাওয়ার সময় চট করে কারো নজরে পড়ত না।
কিন্তু–
তাছাড়া বাইরে থেকে জলসাঘরের যে জানলাটা খোলা আছে দেখে এলাম—সেই জানলা পথে ভেতরে প্রবেশ করাটাও খুব সহজ। বাইরে ঐ সময় পদশব্দ শোনা গেল। বৃদ্ধ ভৃত্য দেলোয়ারের সঙ্গে কুলসম এসেছে। মানিক চাটুয্যে ঘরের বাইরে গিয়ে কুলসমকে ভিতরে নিয়ে এল সঙ্গে করে। কিরীটী তাকাল। বোরখা নেই মুখে।
মেয়েটি সুন্দরী সন্দেহ নেই কিন্তু আরশিতে দেখা চকিত সেই মুখখানি নয়। চোখের তারা দুটোতে বুদ্ধির দীপ্তি।
তোমার নাম কুলসম? কিরীটী প্রশ্ন করে।
জী হাঁ।
মাণিক বেগমের দাসী তুমি?
জী হাঁ।
জাহানারা বেগমের ফাইফরমাস কখনও তুমি খাটতে না?
জী না তো! কেন?
ছোট বেগম সাহেবারও দাসী আছে একজন—
কে সে? কি নাম তার?
কেন মোতি!
হুঁ—আচ্ছা কুলসম, এ বাড়িতে তুমি কতদিন কাজ করছ?
কমসে কম দশ সাল তো হবেই।
তবে তো অনেক দিন!
জী হাঁ—
তোমার মনিবান মানে মাণিক বেগম সাহেবাকে ছাড়া এ বাড়িতে সব চাইতে বেশী কাকে তোমার ভালো লাগত?
সে যদি বলেন তোজাহানারা বেগম সাহেবাকেই কথাটা বলতে বলতে গলার স্বরটা যেন কুলসমের রুদ্ধ হয়ে আসে। খুব ভালো ছিলেন বুঝি বেগম সাহেবা?
জী—অমন দিলদরিয়া মানুষ বড় একটা চোখে পড়ে না—তাকে যে কোন্ দুশমন এমন করে খুন করল!
এ বাড়ির সবাই তাকে ভালোবাসত, তাই না?
জী, তাকে ভাল না বেসে কেউ থাকতে পারত না। যেমন দিলদরিয়া তেমনি হাসিখুশি ছিল মানুষটা। কাউকে কখনো একটা চোখ রাঙিয়ে কথাও বলেনি হাসি যেন সর্বক্ষণ বেগম সাহেবার মুখে লেগেই থাকত।
কতদিন হল আলী সাহেব তাঁকে সাদী করেছেন? সেও তো দু সাল হয়ে গেল। বেগম সাহেবার বাপের বাড়িতে কে কে আছেন জান?
এক বুড়ী মা—আর একটা মাতাল গাই—গরীব-ভীষণ গরীবনবাব সাহেবই তো বরাবর তাদের সাহায্য করে আসছেন।
কোথায় তারা থাকে?
শুনেছি মেটিয়াবুরুজ।
আচ্ছা কুলসম?
জী–
এ বাসায় বেশ সুন্দর দেখতে অল্পবয়েসী আর কোন মেয়েছেলে আছে?
জী–মনে হল কুলসম কী বলতে গিয়েও নিজেকে যেন সামলে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গে বললে, না—আর কে থাকবেনবাব সাহেবের তিন বেগম সাহেবা আর আমরা দাস-দাসী-আর–
আর—আর কে আছে?
কুণ্ডু বাবু–সিরিটারী বাবু—
তাহলে আর কেউ নেই?
না।
কিরীটীর মনে হল কুলসম যেন না কথাটা বলতে গিয়ে একটু কেমন দ্বিধা করল।
আচ্ছা, তুমি যেতে পারমোতিকে একবার পাঠিয়ে দাও–
সেলাম সা—
কুলসম চলে গেল।
অতঃপর জাহানারা বেগমের খাস দাসী মোতি এল।
মোতির বয়স ত্রিশের নীচে নয়। রোগা পাতলা চেহারা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চোখেমুখে একটা বোকা-বোকা ভাব।
০৭. তোমার নাম মোতি
তোমার নাম মোতি?
জী—
তুমি তো কাল রাত্রে জলসাঘরের বাইরেই ছিলে?
জী—
নবাব সাহেবকে বাজনা বাজিয়ে শোনাচ্ছিলেন ছোট বেগম সাহেবা, তাই না?
জী–
নবাব সাহেব কাল রাত্রে কখন জলসাঘর থেকে চলে যান জান তুমি?
জানি আমার সামনে দিয়েই তো রাত্রে এক সময় বের হয়ে গেলেন।
রাত কটা হবে?
তা রাত বারোটার পরে।
কি করে বুঝলে?
দালানের ঘড়িতে রাত বারোটা তার আগে ঢং ঢং করে বেজে গিয়েছিল।
হুঁ—আচ্ছা, নবাব সাহেব চলে যাবার পর তো একাই বেগম সাহেবা জলসাঘরে ছিলেন?
জী—আর কে থাকবে! একা-একাই বেগম সাহেবা বাজাচ্ছিলেন।
ঘরে আর কেউ ঢোকে নি তুমি ঠিক জানো?
জানি—আর কে ঢুকবে!
অত রাত হয়ে গিয়েছিল, তুমি তো ঘুমিয়েও পড়তে পার সেই সময়—
ঘুমিয়ে—
হ্যাঁ–তুমি ঘুমিয়ে পড়নি? একটু ঘুমিয়েছিলে, তাই না?
বোধ হয় একটু ঘুমিয়েছিলাম।
একটু নয়—মনে হচ্ছে বেশ ঘুমিয়েছিলে কিছুক্ষণ—অনেক রাত বাদলা—ঠাণ্ডাও পড়েছিল, তাই না?
মোতি মাথা নীচু করে থাকে।
কিরীটী বলে চলে মোতির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
সেই সময় জলসাঘরে কেউ যেতেও পারে বের হয়েও আসতে পারে—তাছাড়া তুমি যে কেবল ঘুমিয়েছিলে তাই নয় খুব গভীর ঘুম ঘুমিয়েছ।
না না—
হ্যাঁ-নচেৎ তুমি তোমার বেগম সাহেবার মৃত্যু-চিৎকারটা ঘরের দরজায় বসে নিশ্চয়ই শুনতে পারতে—খুব ঘুমিয়েছিলে তুমি।
মোতি চুপ।
বল, জবাব দাও।
জী– কিছু পিয়েছিলে কাল সন্ধ্যায়?
জী—মোতি ভয়ে ভয়ে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করে। জিজ্ঞাসা করে, কাল সন্ধ্যার সময় বা তারপর মানে প্রথম রাত্রের দিকে কিছু খেয়েছিলে?
জী—
কি জিজ্ঞাসা করছি বুঝতে পারছনা মোতি?
জী—
কিছু খেয়েছিলে বা কেউ কিছু—এই ধর সরবৎ বা ঐ জাতীয় কিছু তোমাকে খাইয়েছিল বা তুমিই ইচ্ছা করে খেয়েছিলে?
না।
খাওনি?
নেহি—
ভাল করে মনে করে দেখ মোতিনচেৎ অমন গভীর ঘুম তুমি ঘুমোতে পারতে না।
মোতি চুপ করে থাকে–
শোন মোতি, তুমি তো বুঝতে পারছ তোমার মনিবান বেগম সাহেবাকে কাল রাত্রে কেউ ছোরা মেরে নৃশংসভাবে খুন করেছে এবং তুমি তাকে খুব ভালবাসতে এবং সেও তোমাকে
বাসত।
জী—
তুমি কি চাও না হত্যাকরী ধরা পড়ুক?
জী—
আচ্ছা মোতি—
বলুন।
নবাব সাহেব সুরা পান করেন—তাই না?
জী–
বেগম সাহেবা পান করলে না?
আমার মনিবানও পান করতেন মধ্যে মধ্যে—
আর অন্যান্য বেগমরা?
বড় বেগম সাহেবা রোজ সিদ্ধি খান সিদ্ধি?
জী—
কে তৈরী করে দিত?
কুলসম—
কেবল বড় বেগম সাহেবাই খান, আর কেউ এ বাড়িতে সিদ্ধি খায় না? কুলসমও নিশ্চয়ই খায়—তাই না?
জী—
তুমিও মধ্যে মধ্যে খাও–তাই না?
জী—
কথাটা হঠাৎ বলেই সঙ্গে সঙ্গে মোতি যেন নিজকে সামলে নেবার চেষ্টা করে, না, না-আমি—
কিরীটীতাকে সামলাবার সময় দেয় না—প্রায় সঙ্গে সহেতীকণ্ঠে বলেওঠে, হ্যাঁমধ্যে মধ্যে তুমিও খাও আর কাল সন্ধ্যায় তুমি একটু বেশীই সিদ্ধি খেয়েছিলে।
মোতি যেন কেমন থতমত খেয়ে চুপ করে থাকে।
খেয়েছিলে কি না বল?
জী—খুব মৃদু কণ্ঠে সাড়া এলো।
অনেকটা?
না—এক গ্লাস—
জলসাঘরের বাইরে থাকতে থাকতে বাদলার ঠাণ্ডায় সিদ্ধির নেশায় ঘুম ধরেছিল তোমার—তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। এখন ঠিক করে বল, কখন তোমার ঘুম ভেঙ্গেছিল—কখন প্রথম তুমি তোমার মনিবকে ডাকতে জলসাঘরে ঢুকেছিলে?
রাত তখন—
বল–কত রাত তখন?
রাত দুটো হবে।
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল?
জী—একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিল।
কি রকম শব্দ শুনেছিলে?
একটা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ–কেউ যেন পড়ে গেল।
তারপর?
চেয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই বারান্দাটা খালি—তবু মনে কেমন সন্দেহ হল, উঠে সিঁড়ির দিকে যাই–
বল থামলে কেন—তারপর?
সিঁড়ির কাছাকাছি যেতে আমার নজরে পড়ে কয়েকটা ভাজা কাঁচের চুড়ি—
কাঁচের চুড়ি?
জী—আমি সেগুলি রেখে দিয়েছি।
তারপর?
আমি তারপর জলসাঘরে এসে ঢুকি।
কেন—জলসাঘরে ঢুকলে কেন?
কেমন যেন চারিদিক একেবারে চুপচাপ, কোন শব্দ নেই—আগে দুবার ঘুম ভেঙ্গেছে সেতার বাজানোর শব্দ কানে এসেছে-ভাবলাম তাই, বেগম সাহেবা চলে গেছেন হয়ত শোবার ঘরে—
বল—তারপর?
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি বেগম সাহেবা—
বল কি?
মুখে একটা রেশমী রুমাল বাঁধা—আর বুকে তার একটা ছোরা বিঁধানো–তিনি যন্ত্রণায় গোঁ গোঁ করছেন—
তাহলে তখন তোমার বেগম সাহেবা বেঁচে ছিলেন—
জী—
সঙ্গে সঙ্গে তুমি লোক ডাকলে না কেন?
কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম প্রথমটায়, তারপর তাড়াতাড়ি বেগম সাহেবার মুখের রুমালটা কোনমতে খুলে ফেলে দিতেই–
কি?
সেই মুহূর্তেই বেগম সাহেবার শরীরটা দুবার কেঁপে উঠলমুখ হাঁ করে কি যেন বলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না—মাথাটা কাত হয়ে পড়লোবুঝলাম বেগম সাহেবা মারা গেছেন—হঠাৎ ঐ সময় চোখে পড়ল—আমার জামাকাপড়ে রক্ত
রক্ত!
হ্যাঁ, বেগম সাহেবার রক্ত।
আচ্ছা মোতি, তখন তুমি সকলকে ডাকলে না কেন?
না বাবুজী ডাকিনি–ভয়ে—
ভয় কিসের।
যদি আমার জামাকাপড়ে রক্ত দেখে সবাই আমাকে সন্দেহ করে।
হুঁ, তারপর তুমি কি করলে?
তাড়াতাড়ি ঘর হতে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যাই। বুকটার মধ্যে তখনো আমার ধড়াস ধড়াস করছে—গলা শুকিয়ে গিয়েছে–
আর সেই রক্তমাখা জামা কাপড়গুলো কি করলে?
সেই রাত্রেই খুলে পরিষ্কার করে–সোজা নীচে বাবুর্চিখানায় চলে যাই, চুল্লির আগুনে সেঁকে সেঁকে সেগুলো শুকিয়ে উপরে চলে আসি–তারপর আরো খানিকক্ষণ বাদে সকলকে ডাকি।
তাহলে সকলকে তুমি ডাক রাত তিনটার পর নিশ্চয়ই কোন এক সময়!
ঐ রকমই হবে বাবুজী।
০৮. তুমি যে বলছিলে
আচ্ছা, তুমি যে বলছিলে ঘরে ঢুকে যখন তুমি বেগম সাহেবাকে মৃত দেখ তখন রাত দুটো–ঠিক রাত দুটো তা কি করে বুঝলে?
ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বেজেছিল।
ঐ সময় বারান্দায় জুতোর মম্ মম্ শব্দ শোনা গেল। কিরীটী চোখ তুলে তাকায় দরজার দিকে।
মানিকবাবু, দেখুন তো কে এলো!—কিরীটী শুধায়।
মানিকবাবুকে আর দেখতে হলো না। সুদর্শন একটি যুবাপুরুষ কক্ষে এসে প্রবেশ করল।
ইনি?—কিরীটী প্রশ্ন করে।
মানিক চাটুয্যে বলে, নাসির হোসেন, নবাব সাহেবের বোন সুলতানা বেগমের ছেলে।
কিরীটী তাকাল।
নাসির হোসেন। আলী সাহেবের একমাত্র ভগিনী সুলতানা বেগম সাহেবার একমাত্র সন্তান। নাসির হোসেনের বয়স বেশী হবে না। ত্রিশের নীচে বলেই মনে হয়। দোহারা চেহারা। মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। চোখেমুখে একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে। চোখে চশমাদামী সোনার ফ্রেম। পরনে টেরিলিনের আমেরিকান কাটের প্যান্ট ও বুশ শার্ট। পায়ে চপ্পল।
একা নাসির হোসেনই নয়, তার পিছন পিছন ঘরে এসে প্রবেশ করেন নবাব সাহেবের সরকার বা সেক্রেটারী সৌমেন কুণ্ডু মশাইও। শেষোক্ত ব্যক্তির বয়স ত্রিশের ঊর্ধ্বে বলেই মনে হয়। রোগা পাকানো চেহারা। গায়ের রং কুচকুচে কালো। মুখে ছোট ছোট কাঁচাপাকা দাড়ি। বোধ হয় ভদ্রলোক নিয়মিত ক্ষৌরকর্ম করেন না।
কথা বললেন প্রথমে সৌমেন কুণ্ডুই, চাটুয্যে সাহেব নাসির সাহেব বলছিলেন—
নাসির হোসেনই এবার কুণ্ড মশাইয়ের অর্ধসমাপ্ত কথাটা শেষ করলো, আমার বিশেষ কাজ আছে চাটুয্যে সাহেব, আমাকে একবার অনুমতি দিতে হবে আমি বাইরে যাবো।
মানিক চাটুয্যে নিঃশব্দে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
আপনিই নাসির হোসেন সাহেব?
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
মিঃ কুণ্ডু, আপনি একটু বাইরে যাবেন—আমার নাসির হোসেন সাহেবের সঙ্গে কিছু কথা আছে।
সৌমেন কুন্ডু তখুনি বাইরে চলে গেলেন। এবার কিরীটী নাসির হোসেনের দিকে তাকাল। কিছু মনে করবেন না হোসেন সাহেব, আপনি কি ফিলমের–মানে ছবির কোন বিজনেস করেন?
হ্যাঁ, আমার একটি নিজস্ব চিত্র-প্রতিষ্ঠান আছে।–নাসির হোসেন জবাব দিলেন।
তাই আপনার ছবি আমি সিনেমা কাগজে দেখেছি। রিসেন্টলি কি একটা হিন্দি সিনেমা কাগজ আপনার কি সব ছবি নিয়ে লিখেছে। তাতে প্রথমেই আপনার ছবি আছে। একটা পাইপ হাতে–
মৃদু হাসলো নাসির হোসেন, হ্যাঁ, বের হয়েছে আমার নতুন ছবি ইয়ে জিন্দিগী কিতনী পিয়ারা হ্যায়।
বেশ সুন্দর নামটা তো ছবির।–কিরীটী বলে।
আমারই গল্প—আমারই সিনারি ও ডাইরেকশন।
তাই বুঝি?
কিরীটী আবার নাসির হোসেনের মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ।
আপনি তো তাহলে দেখছি অসাধারণ গুণী ব্যক্তি। তা মিউজিকটাও দিলেন না কেন আপনার ঐ ছবিতে ঐ সঙ্গে?
পরের ছবিতে দিচ্ছি।
হ্যাঁ দেবেন। সবই একহাতে—এক ব্রেন থেকে এলে জিনিসটা একটা সত্যিকারের ক্রিয়েশন হয়।
হ্যাঁ—আজকাল কেউ কেউ তাই করছেনও।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, তা আপনার অফিস কোথায়?
বম্বেতেও আছে, এখানেও আছে। বম্বেতেমহালক্ষীতে, আর কলকাতায় ওয়াটারলু স্ট্রীটে—
সুটিং কোথায় হয়?
বম্বে কলকাতা দু জায়গাতেই। যখন যেমন প্রয়োজন হয়।
আপনার শেষ বই কি ছিল হোসেন সাহেব?
ইয়ে দুনিয়া গোল হ্যায়।
বাঃ, বেশ সুন্দর নাম তো!
হ্যাঁ, একদল মিল ওয়াকার্সদের নিয়ে গল্প–
হুঁ-আচ্ছা হোসেন সাহেব—আপনাদের তো শুনেছি এক একটা ছবি বিশেষ করে হিন্দি ছবি করতে প্রচুর টাকা লাগে, মানে লাখ লাখ টাকার ব্যাপার—তাই না?
নাসির হোসেন হেসে বলে, তা তো লাগেই।
তা কি ভাবে টাকাটা আপনি যোগাড় করেন?
ডিস্ট্রিবিউটররা দেয় অগ্রিম!
তাহলেও ইনিসিয়ালি তো একটা মোটা টাকা লাগেই?
তা লাগে।
আপনার মামা মানে নবাব সাহেবই বোধ হয় সে টাকাটা আপনাকে দেন?
একবার দিয়েছেন।
আর দেন নি?
না, তবে তবে?
এবার দেবেন বলেছেন যে নতুন ছবিটা ইস্টম্যান কালারে করবো ঠিক করেছি, সেটায় ফিনান্স করবেন হয়তো
হয়ত কেন বলছেন? সন্দেহ আছে নাকি কিছু?
মানে বাধা দিয়েছিলেন আমার ছোট মামী।
মানে জাহানারা বেগম—যিনি—
হ্যাঁ।
০৯. কিরীটী একটু থেমে
কিরীটী একটু থেমে নাসির হোসেন সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, এবার বোধ হয় আর বাধা থাকল না—কি বলেন?
য়্যাঁ-যেন নাসির হোসেন সাহেব হঠাৎ কেমন চমকে ওঠেন।
বলছিলাম এখন যখন তিনি আর রইলেন না—আপনার বাধাও আর থাকল না, বিশেষ করে তিনিই যখন বাধা দিচ্ছিলেন—কি বলেন?
নাসির হোসেন সাহেব কোন কথা বলে না, চুপ করে থাকে।
আপনার তিন মামীর মধ্যে বোধ হয় ঐ মামীরই বেশী আধিপত্য ছিল নবাব সাহেবের উপরে—তাই না?
ঠিকই ধরেছেন।
যাক–কাল রাত্রে আপনি তো এই বাড়িতেই ছিলেন?
না।
ছিলেন না?
না, আমি রাত তিনটার পর ফিরেছি।
অত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন কাল রাত্রে?
দমদমে আমার এক বন্ধুর ওখানে ছিলাম। মানে বৃষ্টির জন্য সেখানে বিকেলের দিকে গিয়ে আটকে পড়েছিলাম।
তাহলে আপনি রাত তিনটের পর এসেছেন?
হ্যাঁ, এসেই তো শুনলাম ব্যাপারটা কিছুক্ষণ আগে।
আচ্ছা আপনি যে কাল রাত্রে ফিরতে পারেন নি কেউ জানতো এ বাড়িতে কথাটা?
কাল আসতে পারব না বলে ফোনে এখানে জানিয়ে দিয়েছিলাম।
ফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
হঠাৎ ঐ সময় মানিক চাটুয্যে বলে ওঠেন, কাল রাত্রে কখন ফোন করেছিলেন?
কেন, রাত তখন সাড়ে সাতটা আটটা হবে বৃষ্টি নামার কিছুক্ষণ পরেই।
মানিক চাটুয্যেই আবার প্রশ্ন করেন, ফোন কে ধরেছিল?
কেন বলুন তো?
না, তাই জিজ্ঞাসা করছি।
অবিশ্যি ব্যাপারটা সত্যি স্যাড।–মৃদু কণ্ঠে বলে নাসির হোসেন সাহেব।
কেন, স্যাড কেন?
কারণ ছোট মামীই ফোন ধরেছিলেন।
ছোট মামী! কিন্তু কুণ্ডু মশাই যে বলছিলেন—
কি?
কাল বিকেল থেকেই এ বাড়ির ফোনটা আউট অফ অর্ডার হয়ে আছে।
নাসির হোসেন সাহেব হেসে উঠলেন। বললেন, এ বাড়ির ফোন আউট অফ অর্ডার হয়েছিল?
হ্যাঁ।
কে বলেছে আপনাদের?
সৌমেন কুণ্ড মশাই।
মানিক চাটুয্যে বললেন।
ননসেন্স-ঐ লোকটা কখনো কোনো খবর রাখে না কিছু না, দুম্ করে একটা কথা এক এক সময় বলে বসে—আমি নিজে ফোনে ছোট মামীর সঙ্গে প্রায় দশ মিনিট ধরে কথা বললাম। আর ফোন আউট অফ অর্ডার হয়েছিল বলে বসলেন!
কিরীটী মানিক চাটুয্যের দিকে তাকিয়ে বললে, মানিকবাবু, সৌমেনবাবুকে একবার ডাকবেন এ ঘরে?
নিশ্চয়ই।
মানিক চাটুয্যে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
নাসির হোসেন সাহেব!
কিরীটীর ডাকে নাসির হোসেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল আবার।
কালরাত্রে কখন আপনি দমদমে আপনার বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হয়েছেন?
পৌনে তিনটে নাগাদ হবে।
কিসে এলেন?
কেন আমার নিজের গাড়িতে।
আপনার গাড়ি আছে? আছে বৈকি।
কি গাড়ি?
অস্টিন অক্সফোর্ড—
নিজেই চালান, না ড্রাইভার আছে?
না না, ড্রাইভার নেই, নিজেই চালাই নিজের গাড়ি।
আপনি সাধারণত কেমন speedয়ে গাড়ি চালান?
সে যদি বলেন মশাই, আমি একটু জোরে—মানে speedয়েই গাড়ি চালাই।
Speedয়ে–তবু সাধারণত কত মাইল?
মিনিমাম চল্লিশ তো বটেই, তার কমে গরুর গাড়ি চলে, সে মটোর নয়—
তা বটে!
মানিক চাটুয্যে কুণ্ডুকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন ঐ সময়।
আসুন কুণ্ডু মশাই, এ বাড়ির ফোনটা কি ঠিক আছে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে না।
ঠিক নেই?
না।
কখন থেকে আউট অফ অর্ডার?
কাল বিকেল থেকে। কোন্ ঘরে ফোন আছে?
এই তো বাইরের বারান্দায়।
কই, চলুন তো দেখি।
কিরীটী বের হয়ে গেল ঘর থেকে বারান্দায়।
১০. বারান্দার এক কোণে ফোনটা
বারান্দার এক কোণে ফোনটা এমনভাবে এবং এমন জায়গায় রাখা যে চট্ করে কারো চোখে পড়ে না।
ফোনটা কিরীটী পরীক্ষা করে দেখলো—একেবারে ডেড়, কোন শব্দই নেই তখনো।
কিরীটী সৌরীন কুণ্ডুর দিকে তাকাল, কখন আপনি প্রথম জানতে পারেন সৌরীনবাবু। যে ফোনটা আউট অফ অর্ডার?
কাল বিকালেই ছোট বেগম সাহেবা আমাকে জানান এবং বলেন, অফিসে একটা কমপ্লেন করতে।
মানে জাহানারা বেগম?
হ্যাঁ।
আচ্ছা সৌরীনবাবু, এই বাড়িতে পর্দার ব্যাপারটা কি রকম মানা হয়, সবাই পদানশিন কি?
সবাই, তবে—
তবে?
ছোট বেগম সাহেবা পদার ব্যাপারটা তেমন মানতেন না।
সকলের সঙ্গেই বুঝি তিনি কথা বলতেন?
সকলের সঙ্গেই।
খুব স্বাধীনচেতা ছিলেন বোধ হয়?
তাই–হুটহাট করে যখন যেখানে খুশি বেরুতেন, যা এ বাড়ির অন্যান্য বেগমরা আদৌ করেন না।
নবাব সাহেব নিশ্চয়ই খুব রক্ষণশীল মানুষ?
খুবই—তাহলেও ছোট বেগম সাহেবার ব্যাপারে তাঁর খুব একটা কনট্রোল ছিল বলে মনে হয় না।
আচ্ছা কুণ্ডু মশাই, একটা কথা—
বলুন। নবাব সাহেবের ঐ ভাগ্নে মানে আমাদের নাসির হোসেন সাহেব—ওঁর প্রতি নবাব সাহেবের মনোভাবটা ঠিক কেমন জানেন কিছু?
খুব প্রীতির বলব না, তবে—
তবে?
সুলতানা বেগম সাহেবার যে কারণেই হোক তাঁর ভাইয়ের প্রতি একটা হোল্ড আছে যে জন্য ঐ ভাগ্নেটির এ গৃহে বিশেষ একটা প্রতিপত্তি আছে।
হোল্ড থাকার কারণ তাহলে আপনার জানা নেই?
না, তবে মনে হয় নবাব সাহেব তাঁর বোনকে যেন একটু ভয় ও সমীহ করেন।
হুঁ—আচ্ছা নাসির হোসেন সাহেবের সিনেমার ছবি তৈরীর ব্যাপারে নবাব সাহেবের—
সহযোগিতার কথা বলছেন তো-খুব বেশীই আছে— তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
তার কারণ নবাব সাহেবের এ বয়সেও একটা ব্যাধি আছে।
স্ত্রীলোকের উপরে দুর্বলতা বোধ হয়? কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে কথাটা।
আপনি ধরেছেন ঠিক।
কিরীটী মৃদু হাসল।
ভাল কথা, নবাব সাহেব তো তাঁর ঘরেই আছেন?
হ্যাঁ।
এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে খুব upset হয়ে পড়েছেন নাকি?
স্বাভাবিক, কারণ জাহানারা বেগম বলতে তো নবাব সাহেব একেবারে পাগল ছিলেন।
হুঁ–চলুন ঘরে যাওয়া যাক।
দুজনে এসে আগের ঘরে আবার প্রবেশ করল।
মানিক চাটুয্যে একাই ঘরে ছিলেন।
নাসির হোসেন সাহেব কই? কিরীটী প্রশ্ন করে।
তাঁর ঘরে গেছেন।
চলুন, তাহলে একবার নবাব সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসা যাক।
কিরীটীকে সঙ্গে নিয়ে অতঃপর মানিক চাটুয্যে নবাব সাহেবের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়।
দোতলারই একটা অংশে দুখানা বড় বড় ঘর নিয়ে নবাব সাহেব থাকেন। বাব সাহেবের ঘরের একদিকে লাইব্রেরী-ঘর, অন্যদিকে যে দুখানা পর পর ঘর সেখানেই তিনি থাকেন।
ঘরের সংলগ্ন দুদিকে দুটি বাথরুম।
বড় বেগম সাহেবা নবাব সাহেবের পাশের ঘরেই থাকেন।
১১. বাথরুম দুটির মধ্যে একটি
বাথরুম দুটির মধ্যে একটি বড় বেগম সাহেবা রৌশেনারা বেগম সাহেবার ব্যবহারের জন্য, অন্যটি তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের।
নবাব সাহেব লোকটি যে কেবল সংগীতপিপাসুই তা নয়–রীতিমত শিক্ষিতও।
মানিক চাটুয্যেই বলছিল কিরীটীকে–নবাব সাহেবের ঘরের দিকে যেতে যেতে। বলছিল, স্কুল কলেজে লেখাপড়া যদিও বেশী করেন নি, তাহলেও পড়াশুনা যথেষ্ট করেছেন এবং এখনো করেন।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, এবং সেই নেশাতেই নিজস্ব একটি লাইব্রেরী গড়ে তুলেছেন।
লাইব্রেরী!
হ্যাঁ—ইংরাজী—বাংলা—হিন্দী–উর্দু—সব ভাষাতেই তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি। কাজে কাজেই সব রকম বইয়েরই সংগ্রহ রয়েছে ঐ লাইব্রেরীতে।
লম্বা টানা বারান্দা। পর পর দশটি ঘর ঐ বারান্দায়।
লাইব্রেরী-ঘরের পাশে যে ছোট ঘরটি অর্থাৎ ৬নং ঘর—সেই ঘরের মধ্যে বসেই এতক্ষণ ওরা কথাবার্তা চালিয়েছিল।
১নং ঘর ছিল নিহত জাহানারা বেগমের—২নং ঘর ভাগ্নে নাসিরহোসেন সাহেবের এবং ৩নং হলঘর, যে ঘরের মধ্যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।
৪নং ঘর ইদানীং নবাব সাহেবের বৃদ্ধা পিসি অর্থাৎ ফুপুর মৃত্যুর পর খালিই পড়ে আছে।
৫নং ঘরে মানিক বেগম থাকেন—তাঁরই ঘর।
৭নং ঘর হচ্ছে লাইব্রেরী।
৮ ও ৯নং ঘর দুটো নিয়ে থাকেন নবাব সাহেব।
১০ নং ঘর প্রধানা ও জ্যেষ্ঠা বেগম রৌশনারা বেগম সাহেবার ঘর।
দুজনে এসে নবাব সাহেবের বসবার ঘরে প্রবেশ করল—কিরীটী ও মানিক চাটুয্যে।
ঘরের মধ্যে একটা আবছা আলোছায়া। সমস্ত জানলা দরজা বন্ধ—তার উপরে ভারী পর্দা টাঙানো এবং জানলা দরজা সব বন্ধ বলেই ঘরের মধ্যে স্বল্প শক্তির নীলাভ গোটা দুই বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছিল। সেই নীলাভ আলোই ঘরের মধ্যে একটা আলো-ছায়ার সৃষ্টি করছিল।
ঘরের মেঝেতে পুরু দামী কার্পেট বিছানো। ঘরের মধ্যে গোটাকয়েক পুরাতন আমলের ভারী ও কারুকার্য করা সোফা কৌচ ছিল।
ওদের সাড়া পেয়ে সুশীল মুখার্জী থানার অফিসার ইনচার্জতাড়াতাড়ি উঠেদাঁড়ায় ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে বসে নবাব সাহেবের জবানবন্দি নিচ্ছিল বোধ হয়।
সুশীল মুখার্জী বলে, আসুন স্যার—
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই প্রথম কথা কিরীটী বললে, ঘরে এ ছাড়া আর আলো নেই?
আছে—
ভরাট পুরুষ গলায় শোনা গেল।
তারপর সেই কণ্ঠস্বরই বললে, মেহের–বড় আলোটা জ্বালিয়ে দাও।
খুট করে একটু পরে একটা শব্দ হলো ও সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল আলোয় সমস্ত কক্ষটা উদ্ভাসিত ও দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
আর আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েইএকবোরখা-পরিহিতা নারীমূর্তিঘরছেড়েমধ্যবর্তীদরজা-পথে পদা ঠেলে অন্তর্হিত হয়ে গেল নিঃশব্দে। নারীমূর্তিকে যেন ভাল করে দেখা গেল না।
তারপর চোখ ফেরাতেই দেখা গেল–সামনে সোফায় আর একজন পুরুষ বসে আছেন। বয়েস হয়েছে পরণে তাঁর পায়জামা ও চুড়িদার পাঞ্জাবি। উঁচু লম্বা বেশ বলিষ্ঠ গড়ন। গায়ের রঙ একেবারেটটকে গৌর। চোখে কালো কাঁচের চশমা। মাথার চুল লালচে কোঁকড়া কোঁকড়া।
মানিক চাটুয্যে বলে, মিঃ রায়, ইনিই নবাব সাহেব—
কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানাল নবাব সাহেবকে, নবাব সাহেব প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললেন, বসুন।
পরিষ্কার বাংলায় কথা বললেন নবাব সাহেব।
কিরীটী সামনেই একটা খালি কৌচের উপর উপবেশন করে।
তার দু চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কিন্তু তখন নবাব সাহেবের উপরেই স্থির-নিবদ্ধ।
মানিক চাটুয্যে বলেছিল, নবাব সাহেবের বয়স সত্তর-বাহাত্তরের নীচে নয় কিন্তু শরীরের বাঁধুনি এবং মুখের চামড়ার মসৃণতা দেখলে মনে হবে বুঝি বয়স এখনো ষাটের কোঠায় যায়নি।
মোটা মোটা হাতের আঙুল। দুহাতের আঙুলে গোটাচারেক আংটি—তার মধ্যে বাম হাতের অনামিকার আংটিটা হীরার বোধ হয়। ঘরের আলোয় হীরাটা ঝিলমিল করছিল। বেশ বড় আকারের হীরাটা। একটা বড় কাবুলী মটরের চাইতেও আকারে বড় হবে।
নবাব সাহেব কিরীটীকে বসুন বলে আহ্বান জানানোর পর হঠাৎ যেন ঘরের মধ্যে আকস্মিক স্তব্ধতা নেমে এসেছিল।
সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ হলো আবার নবাব সাহেবেরই সেই ভরাট পুরুষ-গলায়।
চ্যাটার্জী সাহেব, মৃতদেহটা আর কতক্ষণ বাড়ির মধ্যে ফেলে রাখবেন—নিয়ে গিয়ে আপনাদের যা করণীয় করা হয়ে গেলে জাহানের শেষ কাজটা আমি শেষ করে ফেলতে চাই—
কথাগুলো বলতে বলতে নবাব সাহেবের চোখের দৃষ্টি মনে হলো যেন তাঁর চোখের চশমার কালো কাঁচ ভেদ করে কিরীটীর উপরে গিয়ে মুহূর্তের জন্য পতিত হলো—তারপরই যেন একটু অস্বোয়াস্তি ভাব
ডান হাতটা কোলের উপর তুলে নিয়ে প্রথমে পরিধেয় জামার ভাঁজটা ঠিক করতে লাগলেন, তারপর পকেটে হাতটা চালিয়ে যেন কি খুঁজতে লাগলেন।
আর ঠিক ঐ সময় ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা যেখানে একটা ভারীদামী পর্দা ঝুলছিল সেই পদাটা ঠেলে বোরখা-পরিহিতা এক নারীমূর্তি হাতে রূপার ট্রে তার উপরে একটা কাঁচের গ্লাস বসানোঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
১২. নবাব সাহেব সেই পদশব্দে
নবাব সাহেব সেই পদশব্দে দরজার দিকে তাকালেন।
কিরীটী চিনতে পারে এ সেই বোরখা-পরিহিতা নারীমূর্তি যে কিছুক্ষণ আগে আলো জ্বেলে দিয়ে ঐ ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। বোরখা-পরিহিতা নারী ট্রে হাতে নবাব সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল।
রূপার ট্রের উপরে একটা দামী ইটালীয়ান কাট-গ্লাসের গ্লাস—তার মধ্যে অর্ধেকটা সোনালী রঙের তরল পদার্থ টলটল করছে। নবাব সাহেব ডান হাতটা বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে নিলেন—একেবারে সোজা ওষ্ঠের সামনে। তারপর এক চুমুকে সমস্তটুকুতরল পদার্থ নিঃশেষে পান করে গ্লাসটা ট্রের উপরে নামিয়ে রাখলেন।
কিরীটী তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বোরখা-পরিহিতা নারীর দুটি সুডৌল গৌর কোমল অনাবৃত বাহুর দিকে। অমন সুঠাম পেলব বাহু সচরাচর বড় একটা নজরে পড়ে না। চাঁপার কলির মত যেন সরু সরু আঙুল—মেহেদী রঙে রাঙানো হাতের পাতা ও আঙুল।
বোরখার দুটি ছিদ্রপথে দুজোড়া কালো চোখ দেখা যায় স্পষ্ট।
কিরীটীর দৃষ্টির সঙ্গে যেন মিলিত হলো মুহূর্তের জন্য তারপরইবোরখা-পরিহিতা নারীমূর্তি ধীর শান্ত পায়ে ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে চলে গেল পর্দার অন্তরালে ট্রে-টা হাতে।
কিরীটী ঘুরে তাকাল নবাব সাহেবের দিকে।
প্রশ্ন করল, নবাব সাহেব—ও কি আপনার দাসী?
য়্যাঁ—
বলছিলাম ঐ মেয়েটি কে–বাড়ির দাসী?
দাসীনা না না–হ্যাঁ, মানে দাসী–না ঠিক তা নয়—
তবে মেয়েটি কে?
মেহের—মেহেরুন্নিসা—আসলে কি জানেন—ওকে আমার এ্যাটেনডেন্টও বলতে পারেন। ইদানীং ও এখানে আসবার পর থেকে আমাকে দেখাশোনা সবই ও করে।
খুব বেশী দিন বোধ হয় এখানে উনি আসেননি? কারণ কুলসম ও মোতির কাছে ওর সম্পর্কে কিছু শুনলাম না।
কিরীটী নবাব সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার।
না, না—ও তো সব সময় এখানে থাকে না—মধ্যে মধ্যে আসে। এবারে কয়েকদিন আগে এসেছে আর যায়নি বুঝলেন কিনা যেতে দিই নি মেয়েটা আমার habits কখন কি দরকার না দরকার এসব বুঝে ফেলেছে। ও চলে গেলে আমার ভারী অসুবিধা হয়।
তা তো হবারই কথা—কিরীটী মৃদু হেসে বলে।
হ্যাঁ—মেহের ভারী বুদ্ধিমতী চালাক-চতুর—
আপনার সঙ্গে ওর কোনরকম আত্মীয়তা আছে?
আত্মীয়তা—না, না—সে রকম কিছু নেই–তবে–
তবে?
এই সামান্য পরিচয় আর কি!
কিরীটী মৃদু হাসলো।
হাসিটা এত মৃদু—এত ক্ষণস্থায়ী যে কারো নজরে পড়ে না।
নবাব সাহেব!—কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
বলুন—
ছোট বেগম সাহেবা অর্থাৎ–জাহানারা বেগমের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ—
হ্যাঁ–কারণ আমাদের মনে হচ্ছে—
কি—কি মনে হচ্ছে?
এই বাড়ির মধ্যে কেউ তাঁকে হত্যা করেছে। বাইরের কেউ নয়।
বাড়ির মধ্যে কেউ! কি বলছেন আপনি? কে তাকে হত্যা করবে, কেনই বা করবে?
তা জানি না, তবে আমাদের ধারণা তাই। কিরীটী বলে শান্ত কণ্ঠে।
না না—তা কি করে হবে?
আচ্ছা, আপনার ভাগ্নে নাসির হোসেন সাহেব—
নাসির!
হ্যাঁ—তাঁর সঙ্গে জাহানারা বেগমের সম্পর্কটা কেমন ছিল বলে আপনার মনে হয়?
অবিশ্যি জাহানের সঙ্গে নাসিরের এ বাড়ির মধ্যে সব চাইতে বেশী ভাব ও হৃদ্যতা ছিল, কিন্তু তাই বলে-না না, সে রকম কিছু থাকলে—
আপনি টের পেতেন—স্বাভাবিক। আচ্ছা, নাসির হোসেন সাহেবকে তাঁর সিনেমার ব্যাপারে যে বেগম সাহেবা মধ্যে মধ্যে ওঁকে অর্থসাহায্য করতেন আপনি তা জানেন?
কি—কি বললেন? জাহান নাসিরকে সাহায্য করতটাকা দিত তার সিনেমার ব্যাপারে!
আমার তাই মনে হয়।
অর্থসাহায্য করত জাহান—অথচ ঘুণাক্ষরে আমি তা জানতে পারিনি!
কথা বলতে বলতে মনে হলো যেন নবাব সাহেব রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
কিরীটী নবাব সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
নবার সাহেব বলতে থাকেন, শয়তান—একটা শয়তান—দুমুখো সাপ—দুদিক দিয়ে শুষেছে।
১৩. এখন বুঝতে পারছি
এখন বুঝতে পারছি, কিরীটী বলে, বেগম সাহেবা তো তাঁকে অর্থসাহায্য করতেনই এবং আপনিও করতেন।
দিয়েছি, নিশ্চয়ই দিয়েছি কিন্তু ও যে জাহানের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছে বা নিচ্ছে, যদি একবারও জানতাম—এখন বুঝতে পারছি
কি বলুন তো!
ও আমার সর্বনাশ করবার জন্য সব দিক দিয়ে বদ্ধপরিকর হয়েছিল—
নবাব সাহেবের কথাটা শেষ হলো না।
বাধা পড়লোবোরখায় আবৃতা মেহের পুনরায় ঘরে এসে প্রবেশ করে নবাব সাহেবের সামনে ট্রে ধরল।
ট্রেতে কাঁচের গ্লাসে পূর্বের মত সোনালী তরল পদার্থ।
কিরীটীর মনে হলো যেন ঠিক ঐ সময়—ঐ মুহূর্তে ঐ পানীয়ের জন্য নবাব সাহেব প্রস্তুত ছিলেন না। ঐ সময় ঐ পানীয় যেন অপ্রত্যাশিত—একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন।
পানীয়া গ্রহণ করবেন কি করবেন না সে কারণে যেন খানিকটা দ্বিধাও প্রকাশ পায়। তারপরই মনে হলো মেহের যেন চাপা স্বরে নবাব সাহেবকে কি ফিস ফিস করে বললে।
নবাব সাহেব বারেকের জন্য একবার আড়চোখে—যেন মনে হলো ঘরের মধ্যে বিশেষ করে প্রশ্নকারী কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে পানীয়টা নিঃশেষ করে গ্লাসটা আবার ট্রের উপরে নামিয়ে রাখলেন।
মেহের পুনরায় ধীর পদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা।
মিঃ চ্যাটার্জী—মানিকবাবু—
নবাব সাহেবের ডাকে চ্যাটার্জী মুখ তুলে তাকালো।
আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন—এবারে যদি আপনারা এ ঘর থেকে যান তো আমি একটু বিশ্রাম নিতে পারি–
নিশ্চয়ই। আপনাকে আমরা আর বেশীক্ষণ বিরক্ত করব না নবাব সাহেব—আর দু-চারটে কথা আমাদের জানবার আছে, জানা হলেই আপাতত আপনাকে আর আমাদের প্রয়োজন হবে না।
কিরীটী কথাগুলো বললে।
নবাব সাহেব কিরীটীর মুখের দিকে পুনরায় তাকালেন।
কাল রাত্রে কখন আপনি হলঘর থেকে বের হয়ে আসেন?
আমি?
হ্যাঁ।
তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম—বোধ হয় তখন রাত দশটা হবে–
আপনি যখন হলঘর থেকে উঠে আসেন ছোট বেগম সাহেবা তখন সে ঘরে তাহলে একাই বসে গান গাইছিলেন?
হ্যাঁ।
গানের মাঝখানে উঠে চলে এলেন, বেগম সাহেবা কিছু বলেননি?
না—সে-ই তো বলেছিল উঠে আসতে–
হুঁ–আচ্ছা বাইরে দাসী মোতিকে আপনি বসে থাকতে দেখেছিলেন কি ঐ সময়?
ঠিক লক্ষ্য করিনি।
ফিরে এসে আপনি কি করলেন?
শুয়ে পড়ি।
সঙ্গে সঙ্গেই?
হ্যাঁ।
মেহের তখন কোথায় ছিল?
মেহের—মেহের আমার ঘরেই ছিল।
রাত্রে বুঝি মেহের আপনার ঘরেই থাকত?
হ্যাঁ—মানে–না, মেহের আমার ঘরে থাকবে কেন?
তবে সে কোথায় থাকত?
মেহের তো নীচের মহলেই একটা ঘরে থাকে।
আচ্ছা নবাব সাহেব—বেগম সাহেবাদের কোন মাসোহারার ব্যবস্থা নেই?
আছে বৈকি।
কত করে পেতেন তাঁরা?
সবাই মাসে হাত-খরচ পাঁচশো টাকা করে পায়—তাছাড়া প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট একটা করে আছে।
জাহানারা বেগমের সেই অ্যাকাউন্টে বোধ হয় সবার চাইতে বেশী টাকা ছিল?
হ্যাঁ।
কত আন্দাজ হবে?
তা লাখ খানেক হবে।
অত টাকা আপনি দিয়েছিলেন?
না–দিয়েছিল আমার ফুপু–আসগরী বেগম–তার ব্যক্তিগত বহু টাকা ছিল পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। মরবার আগে সাত মাস ফুপু প্যারালিসিস হয়ে পড়ে ছিল। সেই সময় জাহান তাকে সেবা করেছিল।
তাতেই বুঝি তিনি ঐ টাকা তাঁকে দিয়ে যান?
হ্যাঁ–তাই তো শুনেছি।
আপনার ব্যাক্তিগত অ্যাকাউন্টে কত টাকা হবে?
কত আর, দশ বিশ হাজার থাকে তো যথেষ্ট–ব্যবসায়ে টাকা খাটে—আসে যায়—
কিসের ব্যবসা আপনার?
প্রধানত কয়লার খনি—
আপনার কয়লার খনি আছে?
হ্যাঁ—দুটো।
১৪. রোশন আলী আপনার ছেলে
রোশন আলী আপনার ছেলে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
তিনি তো এখানে থাকেন না?
না—তাকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি—একটা স্কাউনড্রেল। রীতিমত আক্রোশ যেন ফুটে ওঠে কথা বলতে বলতে নবাব সাহেবের কণ্ঠস্বরে।
তিনি কখনো আসেন না এখানে?
না।
কিছু যদি মনে করেন তাঁর সঙ্গে আপনার মনোমালিন্য হল কেন?
তাকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করেছি—তার কথা আর বলবেন না।
আমি কিন্তু আপনার ছেলে রোশন আলী সাহেবকে চিনি।
আপনি চেনেন তাকে?
হ্যাঁ—অনেক দিন থেকেই।
আপনি চেনেন রোশনকে? আবার প্রশ্ন করেন নবাব সাহেব।
হ্যাঁ–তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বও আছে।
ওঃ।
আচ্ছা নবাব সাহেব, আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আমরা পাশের ঘরে যাচ্ছি, যদি অনুগ্রহ করে পাশের ঘরে মেহেরকে একটিবার পাঠিয়ে দেন—
নবাব সাহেব কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, মেহেরকে?
হ্যাঁ।
তার সঙ্গে আপনাদের কি প্রয়োজন? নবাব সাহেব আবার প্রশ্ন করেন।
তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
প্রশ্ন?
হ্যাঁ।
কি প্রশ্ন?
সে তাকেই করব।
ও–বেশ আমি তাকে ডাকছি।
নবাব সাহেব অতঃপর মেহেরকে ডাকলেন। এবং নবাব সাহেবের ডাকে মেহের একটু পরে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
মেহের, এঁরা তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করতে চান—
মেহের হাঁ বা না কোন সাড়া দিল না। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল।
আপনার নাম তো মেহেরউন্নিসা? কিরীটী প্রশ্ন করে।
মেহের পূর্ববৎ নীরব। কোন সাড়া নেই।
আপনি কাল রাত্রে আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?
মেহের পূর্ববৎ নীরব।
চুপ করে থাকলে চলবে না মেহেরউন্নিসা জবাব দিতে হবে। বলুন—কিরীটী বলে।
কোথায় আর থাকবে, বললেন নবাব সাহেব, নীচের মহলে ছিল।
না।
কিরীটীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে চকিতে ফিরে তাকান নবাব সাহেব ওর মুখের দিকে।
উনি ছিলেন আপনার ঘরে।
আমার ঘরে!
হ্যাঁ, আপনার ঘরে।
কিন্তু–
হ্যাঁ, শুধু আপনার ঘরেই নয়। কাল রাত্রে কোন এক সময় উন হলঘরেও গিয়েছিলেন আপনি হলঘর থেকে চলে আসবার পর।
হলঘরে গিয়েছিল মেহের কাল রাত্রে আমি চলে যাবার পর! কি বলছেন আপনি যা-তা। ও আগাগোড়া আমার ঘরেই ছিল।
নবাব সাহেব প্রতিবাদ জানান জোরালো গলায়।
না, সব সময় ছিলেন না, আমি বলছি।
আপনি—
এই যে দেখুন বলতে বলতে কিরীটী একটুখানি কালো রেশমী কাপড়ের অংশ পকেট থেকে বের করে নবাব সাহেবের চোখের সামনে তুলে ধরল।
১৫. নবাব সাহেব প্রশ্ন করেন
এটা—এটা কি? নবাব সাহেব প্রশ্ন করেন।
এটা কি বুঝতে পারছেন না নবাব সাহেব—এটা মেহেরউন্নিসার বোরখার একটি ছেড়া অংশ। এটা কোথায় পেয়েছি জানেন? হলঘরের মধ্যে ফুপুর ঘরের দরজার গায়ে একটা ছোট পেরেক উঠে আছে, সেই পেরেকে লেগে ছিল। সম্ভবত ঐ বাথরুম পথে আসবার বা যাবার সময় তাড়াতড়িতে বোরখাটা পেরেকে লেগে ছিড়ে যায়। আর সেই সময়
মেহেরের বোরখা? নবাব সাহেব যেন বোকার মতই প্রশ্নটা করেন।
হ্যাঁ দেখুন না-পরীক্ষা করে। ওঁর হাতের কাছে বোরখাটা—উনি হাত তুললেই চোখে পড়বে।
কেমন যেন বোকার মতই নবাব সাহেব মেহেরের দিকে তাকালেন আবার।
উনি দু-দুবার ট্রে হাতে করে এ ঘরে যখন এসে ঢোকেন তখনই আমার দৃষ্টিতে ব্যাপারটা পড়েছে।
না। এতক্ষণে মেহেরউন্নিসা কথা বলে।
সকলেই যুগপৎ ওর দিকে তাকায়।
আমার বোরখা ঘেঁড়াই ছিল, তা ছাড়া এটা আমার বোরখা নয়।
আপনার নয়?
না।
তবে কার বোরখা?
মোতির।
মোতির–মানে জাহানারা বেগমের খাস দাসীর?
হ্যাঁ।
মোতির বোরখা আপনি পরেছেন?
হ্যাঁ।
দয়া করে বোরখাখানা খুলবেন কি—
কথাটা শেষ হলো না কিরীটীর। সহসা মেহের তার মুখ থেকে বোরখাখানা তুলে ফেলল।
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী যেন চমকে ওঠে।
এ সেই মুখ—চকিতে আরশিতে দেখা সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি।
কিরীটী যেন বোবা। সত্যিই অপরূপ সুন্দরী মেহেরউন্নিসা।
বয়স খুব বেশী হবে না। চব্বিশ কি পঁচিশ—তার চাইতেও কম হতে পারে। কিন্তু ঐ মুখ—ঐ মুখখানি না হলেও ঠিক অমনি একখানি মুখ কিরীটী যেন কোথায় দেখেছে।
কোথায় কোথায় দেখেছে! হঠাৎ কি যেন একটা মনে পড়ে কিরীটীর। সে বলে, এক্সকিউজ মি—এক সেকেণ্ড—আমি আসছি।
কিরীটী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সোজা গেল হলঘরে। ঢুকে দেখল মৃতদেহটা তখনো সেখানে তেমনিই পড়ে আছে।
মৃতার মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে কিরীটী পুনরায় নবাব সাহেবের ঘরে ফিরে এল।
ঘরের মধ্যে তখনো ঠিক তেমনিই সব দাঁড়িয়ে।
মানিক চাটুয্যে, সুশীল মুখার্জী, মেহেরউন্নিসা, আর বসে নবাব আসগর আলী সাহেব।
১৬. মেহেরউন্নিসার দিকে তাকিয়ে
মেহেরউন্নিসার দিকে তাকিয়ে কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন শুরু করে।
দেখুন আপনি কি কখনো সিনেমায় নেমেছেন, কোন ছবিতে?
মেহেরউন্নিসা কয়েকটা মুহূর্ত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদুকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।
এখন মনে পড়েছে। কোন একটা কাগজে আপনার ছবি কয়েকদিন আগেই মাত্র দেখেছি। কিরীটী বলে।
চিত্রালীতে—চিত্রালী আমার ছবি ছেপেছে কিছুদিন আগে।
মেহেরউন্নিসা মৃদু কণ্ঠে বলে।
জাহানারার সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক?
সে—
বলুন কি সম্পর্ক? আপনার সঙ্গে যে রক্তের তাঁর সম্পর্ক আছে বুঝতে পেরেছি, অতএব ঢাকবার চেষ্টা করবেন না।
সে আমার দিদি। দিদি!
মায়ের পেটের বোন আপনার?
হ্যাঁ।
কতদূর লেখাপড়া করেছেন আপনি?
আমি গত বৎসর বি.এ. পাস করেছি।
কোন্ কলেজ থেকে?
বহরমপুর থেকে।
সেখানেই বরাবর থাকতেন?
হ্যাঁ, আমাদের কাকার কাছেই সেখানে থাকতাম। কলকাতায় এসে অবধি এখানে।
কলকাতায় কতদিন এসেছেন?
মাস ছয়েক হল।
এখানেই, মানে এই বাড়িতেই নিশ্চয়ই আছেন?
না, মধ্যে মধ্যে আসি। থাকি আমি শ্যামবাজার—আমার এক মাসীর কাছে।
কটা বইতে অভিনয় করেছেন?
খান তিনেক বইতে।
সবটাতেই নায়িকা?
না, শেষটায় নায়িকা।
হুঁ—আচ্ছা বোরখা ব্যবহার করা আপনার অভ্যাস নয়–তাই না?
আমি বোরখা ব্যবহার করি না।
তবে যে বোরখা এখন পরেছিলেন?
মেহেরউন্নিসা চুপ। বোবা।
আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে চাননি, তাই কি?
মেহেরউন্নিসা নীরব।
মানিকবাবু!
আজ্ঞে?
মোতি দাসীকে ডাকুন তো একবার।
মানিক চাটুয্যে তখুনি বের হয়ে গেল।
মেহেরের দিকে অতঃপর তাকিয়ে কিরীটী বলে, একটা কথার সত্যি জবাব দিন—আপনার এখানে এ ভাবে আসা—আপনার দিদি নিশ্চয়ই পছন্দ করছিলেন না–
মেহেরউন্নিসা পূর্ববৎ নীরব।
অবিশ্যি পছন্দ না করারই কথা—বিশেষ করে যখন তিনি চোখের উপরে নবাব সাহেবের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা
এসব আপনি কি বলছেন? কিরীটীকে বাধা দিলেন নবাব সাহেব।
কথাটা কি মিথ্যা বলেছি নবাব সাহেব?
চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল কিরীটী। কণ্ঠস্বর তার তীক্ষ্ণ, আপনার সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠতা একটা নেই বলতে চান—অস্বীকার করতে চান আপনি কথাটা এখন?
অত স্পষ্ট করে কিরীটী মুখের উপর কথাটা বলবে হয়ত ভাবতে পারেননি নবাব সাহেব।
মোতি এসে ঘরে ঢুকল ঐ সময়।
নবাব সাহেব তখন চুপ করে আছেন।
মোতি!
বাবুর্জী?
ঐ বোরখাটা তোমার?
হঠাৎ যেন কেমন থতমত খেয়ে যায় মোতি–ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে তাকায়।
কি—চুপ করে আছ কেন, জবাব দাও।
কিরীটী ধমকে ওঠে মোতিকে।
আজ্ঞে—
বল–তোমার কি না?
জী।
তোমার?
জী।
কখন দিয়েছ ওঁকে?
আপনার আসবার পর।
মানে আজই সকালে–কিছুক্ষণ আগে?
জী।
মোতি!
বাবুজী?
তুমি আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছ। ঝুট বলেছ—
মিথ্যা–ঝুট বলেছি?
হ্যাঁ–তুমি বলনি কাল রাত্রে-রাত বারোটার পর নবাব সাহেব হলঘর থেকে বের হয়ে যান?
জী—ঠিকই তো বলেছি।
কিন্তু নবাবু সাহেব বলছেন রাত দশটায় তিনি বের হয়ে গিয়েছিলেন হলঘর থেকে।
নেহি বাবুজী নেহি ঝুটনবাব সাহেব রাত বারোটায়ই–
১৭. মোতির কথাটা শেষ হল না
মোতির কথাটা শেষ হল না—হঠাৎ যেন বাঘের মত গর্জন করে উঠলেন নবাব সাহেব, এই হারামজাদী—আবার মিথ্যা কথা বলছিস–
মিথ্যে ওকে শাসিয়ে কোন লাভ হবে না নবাব সাহেব সত্য তা ওর মুখ দিয়ে আগেই বের হয়ে গিয়েছে
না, না—ও বুট বলছে।
ঝুট ও বলেনি কারণ রাত দশটায় আপনি হলঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন সত্য—এবং আপনি ভেবেছিলেন সে সময়—ও আপনাকে হলঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখতে পেয়েছে আপনার গতরাত্রে হলঘর থেকে রাত দশটায় বের হয়ে যাবার সাক্ষী ও রইল। কিন্তু দুভার্গ্য আপনার, মোতি সেটা দেখতে পায়নি কারণ দেখবার মত অবস্থা তখন তার ছিল না। সিদ্ধির নেশায় জল-বৃষ্টির ঠাণ্ডায় তখন ও ঘুমিয়ে পড়েছিল—তারপর আবার আপনি ঐ হলঘরে গিয়ে যখন দ্বিতীয়বার ঢোকেন-রাত বারোটার কিছু আগে কোন এক সময় ফুপুর ঘর থেকে—এবং যে সময় আপনার গায়ে ছিল ঐ বোরখাটা—
কি—কি সব বলছেন—পাগলের মত
নবাব সাহেব প্রতিবাদ জানালেন বটে কিন্তু তাঁর গলার স্বর যেন কেমন নিস্তেজ কেমন। ঠাণ্ডা প্রতিবাদের তীব্রতা নেই সে কণ্ঠস্বরে তেমন যেন।
আমি যে মিথ্যা কিছু বা পাগলের মত কিছু এলোমেলো বকছি না আপনার চাইতে। বেশী কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয় নবাব সাহেব। শুনুন—হলঘরে ঢুকতে গিয়েই বোরখাটা আপনার পেরেকে বেঁধে ছিড়ে যায়—এবং তারপর যে কোন কারণেই হোক বোরখা খুলে। রেখে আপনি যখন পরে নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বের হয়ে যান মোতি ঘুমিয়ে আছে ভেবে অত রাত্রে—দুভাগ্য আপনার সেই মুহূর্তে মোতির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল এবং সে আপনাকে দেখতে পায়–
কিরীটীর গলার স্বর তীক্ষ্ণ–ঋজু।
সে বলতে থাকে, ধর্মের কল এমনি করেই বাতাসে নড়ে নবাব সাহেব, এমনি করেই আমাদের গুণাহের মাশুল খোদাতালার কাছে তামাম শোধ করতে হয়, নচেৎ আপনিই বা বোরখাটা রেখে পরম নিশ্চিন্তে হলঘর থেকে বের হয়ে আসবেন কেন? আর ঠিক ঐ সময়টিতে অতিরিক্ত পরিমাণ সিদ্ধি খাওয়া সত্ত্বেও মোতির ঘুমটা ভেঙে যাবে কেন এবং আপনি ওর চোখে পড়ে যাবেনই বা কেন—আবার মেহেরউন্নিসাই বা আপনাকে বাঁচাতে কোন এক সময় আপনার ফেলে আসা বোরখাটা হলঘর থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসবেন কেন?
নবাব সাহেব হঠাৎ যেন স্থান কাল পাত্র ভুলে সম্বিৎ হারিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, বেরিয়ে যান বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকেget out-বলতে বলতে নবাব সাহেব উঠে দাঁড়ান।
বেরিয়ে আমি যাচ্ছি, কিন্তু মানিকবাবু আপনাকে নিষ্কৃতি দেবেন না, জাহানারা বেগমের হত্যাপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করবেন।
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
নবাব সাহেব হঠাৎ ধপ করে আবার বসে পড়লেন সোফার উপরে।
মানিকবাবু-জাহানারার হত্যাকারী উনি। কিরীটী বলে ওঠে।
হঠাৎ পাগলের মত হা হা করে হেসে উঠলেন নবাব সাহেব।
হ্যাঁ হ্যাঁ—আমি–আমিই হত্যা করেছি জাহানকে।
১৮.
ফেরার পথে কিরীটী মানিক চাটুয্যেকে বলছিল।
দুটো—দুটো মারাত্মক ভুল করেছিলেন নবাব সাহেব—এক ঐ মোতির বোরখা ব্যবহার করে তার ঘাড়ে দোষটা চাপাবার চেষ্টা করে—দ্বিতীয় জাহানারার হাতের আঙুল থেকে হীরার আংটিটা খুলে নিয়ে এসে লোভের বশে।
কিন্তু কি করে আপনি বুঝলেন মিঃ রায় যে নবাব সাহেবই
হত্যাকারী—তাইনা? ছোরাটা যেভাবে আমূল বুকের মধ্যেবিঁধেছিল সেটাকোনস্ত্রীলোকের পক্ষেই সম্ভব নয়। কোন শক্তিমান পুরুষেরই কাজ। এ বাড়িতে পারবেন একনবাব সাহেব—দুই নাসির হোসেন, কিন্তু নাসির হোসেন স্বর্ণডিম্বপ্রসূ জাহানারাকে হত্যা করতে যাবে কেন, জাহানারা তাকে অর্থ যোগাত আর তার সঙ্গে নাসিরের পীরিতও ছিল।
কিন্তু কেন কেন হত্যা করলেন নবাব সাহেব তাঁর প্রিয় বেগমকে?
এখনও সেটা বুঝতে পারেননি–
না।
মেহেরের জন্য।
মেহের?
হ্যাঁ–ঐ মেহেরের জন্যই। অতিরিক্ত নারীলোভী নবাব সাহেবের যখনই মেহেরের উপর নজর পড়েছিল, জাহানারা সম্ভবত প্রতিবাদ জানিয়েছিল—সংঘর্ষ বেধেছিল সেই মুহূর্তে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে—যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁকে অমন করে প্রাণ দিতে হল….
কিন্তু কি ভাবে হত্যা সংঘটিত হয়েছিল বুঝলেন কি করে?
ঐ বাড়ির দোতলার একটা নকশা মনে মনে ছকে নিন, তাহলেই ব্যাপারটা আপনার কাছে সহজ হয়ে আসবে। অবশ্য আমি ব্যাপারটা নবাব সাহেবকে সন্দেহ করে মোটামুটি অনুমান করেছিলাম–কারণ ঐ ভাবে ছাড়া হত্যা করা সম্ভবপর ছিল না।
কিরীটী চুপ করল।