- বইয়ের নামঃ ড্রাগন
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
১. বর্ষা-মেদুর সন্ধ্যা
চারিদিকে আবছা কালো অন্ধকারের যেন যবনিকা থিরথির করে কাঁপছে। কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে তার বসবার ঘরে কৃষ্ণা চুপটি করে বসে কিরীটীর গল্প শুনছে। কিরীটীর পরিধানে গেরুয়া রঙের খদ্দরের ঢোলা পায়জামা ও গেরুয়া রঙের ঢোলা খদ্দরের পাঞ্জাবি।
মুখে পাইপ।
কিরীটী বলছিল : এই মিস্ত্রি, যাকে তোমরা রহস্য বল-এ কোন ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে পাওয়া যায় না। কত প্রকারের মিস্ট্রিই যে আমি দেখেছি ও শুনেছি-রাতের পর রাত তোমাদের বসে বসে আমি গল্প শোনাতে পারি। ক্রাইমের রহস্য আছে : কোন খুনের মামলার যখন আদালতে বিচার হয়, আদালতে প্রত্যেকটি দর্শক তখন উদগ্রীব ও উৎসুক হয়ে থাকে। ধর একটা খুন হল, কে খুন করলে? কেন খুন করলে? কেমন করে কোন অবস্থায় কখন খুন হল? একটার পর একটা চিন্তা আমাদের মনের মাঝে রহস্যের জাল বুনতে শুরু করে। এই এক ধরনের মিস্ত্রি। আবার হয়ত এমন হল, কোন লোক সহসা আশ্চর্য ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় গেল সে অদৃশ্য হয়ে? কেমন করে সে অদৃশ্য হল? তাকে কি কেউ চুরি বা গায়েব করে নিয়ে গেল? অথবা কেউ কি তাকে খুন করে পৃথিবী থেকে তার মৃতদেহ চিরতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ফেললে? কিংবা হয়ত কোন নিরালা মাঠের প্রান্তে পাওয়া গেল তার হিমশীতল প্রাণহীন দেহখানি কিংবা কোন এক প্রাসাদোপম অট্টালিকার কোন এক নির্জন সুসজ্জিত কক্ষে দেখা গেল পড়ে আছে তার মৃতদেহ। অথবা কোন নদীকিনারে এসে ঠেকে রয়েছে তার মৃত্যুশীতল প্রাণহীন দেহ।
আর তার কাছ থেকে জানা যাবে না কোনদিন কখন কে বা কারা কি ভাবে তাকে এমনি করে খুন করে ফেলে রেখে গেল!
ভাষা তার চিরদিনের জন্য মূক হয়ে গেছে।
আর সে কথা বলবে না, আর সে সাড়া দেবে না।
নিস্তব্ধ স্বল্পালোকিত কক্ষের মধ্যে কিরীটীর স্বপ্নাতুর কণ্ঠস্বর রিম্ ঝিম্ করতে লাগল। বাইরে তখন অশ্রান্ত বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
সোঁ সোঁ করে প্রচণ্ড হাওয়া বন্ধ জানালার কাঁচের শার্সির গায়ে এসে আছাড়িপিছাড়ি করছে।
মাঝে মাঝে হিল-হিল করে উঠছে বিদ্যুতের অগ্নি-ইশারা। কড়কড় করে কোথায় যেন বাজ পড়ল।
পথের ধারের বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছটা ঝড়জলে সোঁ-সোঁ সপসপ শব্দ তুলেছে।
পাইপের আগুনটা নিভে গিয়েছিল, কিরীটী আবার তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।
আবার সে বলতে শুরু করল : এ ধরনের মিস্ত্রিও আছে- একটু অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, অদ্ভুত সব দৃশ্য চোখে পড়ে-যখন কেউ কোথাও জেগে নেই; সব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। অদ্ভুত অশরীরী সব মৃদু চাপা পায়ের শব্দ কোন অন্ধকার শূন্য ঘর থেকে হয়ত শোনা যাচ্ছে। ছুটে হয়ত দেখতে গেলে সেখানে কিসের শব্দ, কিছু চোখে পড়ল না।
যেন মায়ায় গেছে সব মিলিয়ে।
সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে স্বপ্নের ফাঁকে ভেসে আসা ঘুমন্ত রাজকন্যার স্মৃতির মত।
কেউ হয়ত দেখে, আবছা চাঁদের আলোয় কোন পোড়ো বাড়ির বারান্দায় নিঃশব্দে একাকী কে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
কে সে?
কেন সে একাকী গভীর রাতে এমনি করে পোড়ো বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়?
কাকে সে খোঁজে?
সে কি কোন বিদেশী রাজপুত্র, হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীকে আজও এই পৃথিবীর ঘরে ঘরে নিশীথ রাতে খুঁজে খুঁজে ফেরে? মানুষ না ছায়া? না মিথ্যা দুঃস্বপ্ন?
শরীর সহসা রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।
মিস্ত্রি! মিস্ত্রি! রহস্য!
কার চাপা ফিসফিস কণ্ঠস্বর? কার করুণ কান্নার সুর? মৃদু গানের আওয়াজ বা সঙ্গীতের মৃদু রেশ…রাতের নিঃশব্দে অন্ধকারে এমনি করে ভেসে আসে।
কে শব্দ করে? কে কথা বলে? কে গান গায়? কে বাজায় একা একা আপন মনে?
এ প্রশ্নের মীমাংসা কোথায়? কোথায় এ রহস্যের সমাধান? শুধু কী এই? মানুষের চরিত্রও কি অনেক সময় একটা প্রকাণ্ড রহস্য হয়ে আমাদের চোখের কোণে মায়া জাগায় না? এই পৃথিবীর ঘরে ঘরে কত বিভিন্ন চরিত্রের লোকই না আছে। কেউ কাদে পরের দুঃখে, কেউ দুঃখ দিয়ে আনন্দ পায়। কেউ ভালবেসে হয় সুখী, কেউ ঘৃণা করে আনন্দ পায়। কেউ আপনাকে বিলিয়ে দিয়েই ধন্য, কেউ অন্যকে বঞ্চিত করে নিজেকে মনে করে ধন্য!
***
বিচিত্র—সব বিচিত্র রহস্যময় বিচিত্র এই পৃথিবী! বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষ!
মানুষই মানুষকে করে খুন।
যে খুন করেছে সেও মানুষ—যাকে খুন করছে, সেও তারই মত একজন মানুষ!
কেউ উদ্দেশ্য নিয়ে খুন করে, আবার কেউ বিনা উদ্দেশ্যেই নিছক নেশায় খুন করে।
ডাক্তারী ভাষায় বলা হয় তাদের—হোমিওসাইড্যাল ম্যানিয়াক মানুষের।
.
সারাটি রাতের বর্ষণক্লান্ত প্রকৃতি প্রথম ভোরের আলোয় ঝিলমিল করছে। কিরীটী লম্বা টান-টান হয়ে একটা বড় সোফার উপরে গভীর আলস্যে শুয়ে চোখ বুজে নিঃশব্দে চুরুট টানছে।
চুরুটের পীতাভ ধোয়া মাথার উপরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদূরে আর একটা সোফায় বসে কৃষ্ণা সেদিনকার দৈনিক সংবাদপত্রটা ওলটাচ্ছে।
সহসা একসময় কৃষ্ণা বলে উঠল, আজকের সংবাদপত্রটা দেখেছ?
কিরীটী চোখ বুজেই জবাব দিল : না, কেন?
বিখ্যাত ডেনটিস্ট ডাঃ চৌধুরীকে কে বা কারা যেন নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে তার সাজারী রুমে। ক্লিনিকে–
কি রকম?
এই দেখ না, কৃষ্ণা সংবাদপত্রটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিল।