- বইয়ের নামঃ চারের অঙ্ক
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. বছর দশ-বারো আগেকার কথা
০১.
বছর দশ-বারো আগেকার কথা।
তখন ভোরবেলা সংবাদপত্রের পাতা খুললেই প্রথম পৃষ্ঠাতে শহরের এখানে-ওখানে নিত্য আট-দশটা খুনখারাপির কথা দেখা যেত না।
এ অশাস্তি আর অস্থিরতা ছিল না এ শহরের জনজীবনে। এত আতঙ্ক আর খুনোখুনি রক্তপাতও ছিল না।
সেই সময়ই দুমাসের মধ্যে পর পর দুটি খুনের সংবাদ সংবাপত্রে প্রকাশিত হল। নিহত ব্যক্তিরা শহরের গণ্যমান্য কোন বিশেষ পরিচিত ব্যক্তি না হলেও, প্রত্যেকেই তারা যাকে বলে ধনী এবং নামী জুয়েলার্স। এবং জুয়েলারির ব্যবসা ছাড়াও কলকাতা শহরে তাদের গাড়ি বাড়ি ও প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স প্রত্যেকেরই ছিল। এবং তাদের হত্যার ব্যাপারে বিশেষ যে ব্যাপারটা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেটা হচ্ছে প্রত্যেকেরই গলায় একটা নীল রেশমী রুমাল জড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগ নানাভাবে অনুসন্ধান করেও তিন-তিনটে নিষ্ঠুর হত্যাব্যাপারের কোন হদিসই করতে পারেনি।
শীতের এক সকালে কিরীটী তার বসবার ঘরে বসে গায়ে একটা শাল জড়িয়ে আরাম করে চা-পান করছে, এমন সময় জংলী ওইদিনকার সংবাদপত্রটা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।
কৃষ্ণা পাশেই বসেছিল। সে-ই প্রথমে জংলীর হাত থেকে সংবাদপত্রটা নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠাটা খুলে তার ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে বলে উঠল, দেখেছ, আবার সেই নীল রুমাল! আবার একজন জুয়েলার!
কিরীটী মুখ তুলে কষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললে, মানে?
আবার আর একজন জুয়েলারকে গলায় নীল রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণা বলল।
তাই নাকি! কিরীটীর কণ্ঠে যেন একটা ব্যগ্রতার সুর।
হ্যাঁ। ভদ্রলোকের নাম শশধর সরকার। বৌবাজারে মস্ত বড় জুয়েলারি শপ সরকার জুয়েলার্স-এর প্রোপ্রাইটার ছিলেন।
দেখি! কিরীটী হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল।
প্রথম পৃষ্ঠাতেই সংবাদটা প্রকাশিত হয়েছে।
আবার সেই নীল রুমাল! আবার একজন জুয়েলার! এই নিয়ে হল তিনজন।
এবারে নিহত হয়েছেন বিখ্যাত জুয়েলারি শপ সরকার জুয়েলার্স-এর প্রোপাইটার শশধর সরকার। ভদ্রলোকের বয়স বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ হবে। তার দোকানের মধ্যেই তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিস-তদন্তে প্রকাশ, শনিবার বেলা আড়াইটে নাগাদ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দোকান বন্ধ করে সকলের সঙ্গে শশধর সরকার বের হয়ে যান। রাত্রি আটটা পর্যন্ত তিনি বালিগঞ্জে যতীন দাস রোডে তার বাড়িতেই ছিলেন। রাত আটটা নাগাদ একটা ফোন-কল পেয়ে তিনি বের হয়ে যান। বাড়ির কেউ বলতে পারেনি কোথা থেকে ফোন-কলটা এসেছিল এবং কে করেছিল বা কোথায় তিনি গিয়েছিলেন। স্ত্রীকে কেবল বেরুবার সময় বলে যান একটা বিশেষ কাজে বেরুচ্ছেন, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই ফিরে আসবেন। কিন্তু রাত বারোটা বেজে গেল—যখন তিনি ফিরলেন না, তখন শশধর সরকারের স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। চারদিকে জানাশোনা জায়গায় ফোন করতে থাকেন, কিন্তু কেউ তার কোন সংবাদ দিতে পারে না। একসময় রাত শেষ হয়ে গেল, কিন্তু শশধর সরকার ফিরলেন না। পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ দোকান থেকে ফোন এল।
দোকানের একজন কর্মচারী—বিনয়ভূষণ ফোন করে। রবিবার দোকান বন্ধ, সে বাসায়ই ছিল। বৌবাজার অঞ্চলেই তার বাসা। একটি ছোকরা এসে তার বাসায় তাকে কথাটা জানায়। ছেলেটি ওই পাড়ারই, বিনয়ভূষণকে চিনত।
বিনয়বাবু, শীগগিরই একবার দোকানে যান!
দোকানে! আজ তো রবিবার, দোকান বন্ধ!
তা তো জানি। ছোকরাটি বলে, দেখলাম আপনাদের দোকানের কোলাপসিবল গেটটা খোলা!
খোলা? সে কি?
হ্যাঁ। ব্যাপার কি দেখবার জন্য ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি, দোকানের ভেতর সব আলো জ্বলছে, আর
কি?
কে একটা লোক মেঝেতে পড়ে আছে। আমি ছুটতে ছুটতে এসেছি আপনাকে খরবটা দিতে।
বলাই বাহুল্য, অতঃপর বিনয়ভূষণ উঠি-কি-পড়ি করে সঙ্গে সঙ্গে দোকানে ছুটে যায় এবং দেখে ছোকরাটির দেওয়া সংবাদ সত্য। শুধু তাই নয়, মৃত ব্যক্তি আর কেউ নয়—তাদের মালিক শশধর সরকার। তার গলায় একটা নীল রুমাল বাঁধা। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসছে। প্রথমটায় ওই বীভৎস দৃশ্য দেখে বিনয়ভূষণ আতঙ্কে যেন বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে সে-ই পুলিশে ফোন করে সংবাদটা দেয়।
পুলিশ আসে। ঘরের মধ্যে শো-কেসগুলো যেমন ছিল তেমনিই আছে। প্রত্যেক শো-কেসে নানা ধরনের অলঙ্কার সাজানো যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আছে। কোনটার তালা বা চাবি ভাঙা হয়নি। এমন কি দোকানের চাবির গোছাটা শশধর সরকারের জামার পকেটেই পাওয়া গেছে। দোকানের যে দারোয়ান হনুমানপ্রসাদ দোকানের প্রহরায় থাকত রাত্রে, তাকে দোকানের পেছনদিককার একটা ঘরে খাটিয়ার ওপর নিদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়। বেলা দশটার সময়ও সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে তার। ঘুম ভাঙানো হয়, কিন্তু সে কোন কিছুই জানে না। সন্ধ্যার দিকে তার এক দেশওয়ালী পরিচিত ব্যক্তি এসেছিল, দুজনে মিলে লোটা-দুই সিদ্ধির শরবৎ খেয়েছিল। তারপর তার সেই লোকটা চলে যায়, আর হনুমানপ্রসাদ খাটিয়ায় শুয়ে নিদ যায়। সে কিছু জানে না-রামজীর কসম। দোকানের অন্যান্য কর্মচারীদের শুধিয়ে ও খাতাপত্র দেখে যতদূর জানা গেছে, দোকান থেকে কোন অলঙ্কারাদি বা সিন্দুকের টাকাকড়ি কিছুই চুরি যায়নি। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা শুধু হত্যাই—স্রেফ হত্যার উদ্দেশ্যেই হত্যা করা হয়েছে, কোন চুরিচামারির ব্যাপার নেই এই হত্যার সঙ্গে।