- বইয়ের নামঃ চক্রী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. সাগর-সৈকত হোটেল
ঠিক সমুদ্রের উপকূল ঘেষে ‘সাগর-সৈকত’ হোটেলটি। বলতে গেলে ছোটখাটো শহরটি যেন গড়ে উঠেছে সাগরেরই কূল ঘেষে। শহরটিতে নানা শ্রেণীর স্বাস্থ্যান্বেষীদের ভিড় ও আনাগোনা যেন লেগেই আছে। এবং একমাত্র বর্ষাকাল ব্যতীত বৎসরের বাকি সময়টা নানা জাতীয় নানা শ্রেণীর যাত্রীদের আনাগোনা চলে। মাঝে মাঝে হোটেলে স্থান পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে। সাগর-সৈকত হোটেলটির মালিক একজন সিন্ধী। সময়টা মাঘের শেষ এবং শীত এখনো যেন বেশ আঁকড়েই বসে আছে এখানে। কিরীটীর ধারণা, শীতকালে কোনো সমুদ্র-সৈকতই নাকি রৌদ্রসেবনের প্রকৃষ্ট স্থান এবং এমন কোন স্থানে আসতে হলে নাকি মনের মত একজন সঙ্গী বা সাথী অপরিহার্য, অতএব আমাকেও সে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে, আমার কোন যুক্তিতেই সে কান দিতে চায়নি।
আমি অনেক করে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, রৌদ্রসেবনের আমার আদৌ প্রয়োজন নেই, যেহেতু আমার জন্মগত দৈহিক কৃষ্ণবর্ণের উপরে আর এক পোঁচ কৃষ্ণ রঙ সূৰ্যদেবতার নিকট হতে আমি গ্রহণে একান্তই অনিচ্ছুক, কিন্তু আমার যুক্তি সে মেনে নিতে রাজী হয়নি, বলেছে, গায়ের রঙটাই বড় কথা নয় সুব্রত। আমাদের মাথার মধ্যে যে স্নায়ুকোষের গ্রে সেলগুলো আছে, সূর্যরশ্মির মধ্যস্থিত বেগুনী-পারের আলোর প্রভাবে সেগুলো আরো সজীব ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তা ছাড়া সমুদ্রের মত মনের খোরাকও কেউ দিতে পারে না। তুই দেখবি, কী আশ্চর্যরকম সক্রিয় করে তোলে রৌদ্রসেবন তোর মনকে ও চিন্তাশক্তিকে!
কিন্তু রৌদ্রসেবন তো এখানে বসেও চলতে পারে?
উহুঁ। এখানে হলে চলবে না। রৌদ্রসেবনেরও অনুপান আছে—সমুদ্রসৈকত। কিরীটী মাথা নেড়ে জবাব দেয়।
কিরীটীর যুক্তিকে হয়তো, তর্কের ঝঞ্চা তুলে কিছুক্ষণ ক্ষতবিক্ষত করতে পারতাম কিন্তু তাতেও তাকে নিরস্ত্র করা যেত না; কারণ রৌদ্রসেবন ও সমুচ-সৈকত একটা অছিলা মাত্র। মোট কথা মনে মনে কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা সে স্থির করেছে এবং কিছুদিনের জন্য সে সেখানে গিয়ে নিরবচ্ছিন্ন খানিকটা নিষ্ক্রিয় আরাম উপভোগ করতে চায় এবং সাথী হতে হবে আমায়। তাই বৃথা আর যুক্তিতর্কের জাল না বুনে একান্তভাবেই ওর হাতে আত্মসমর্পণ করে দিনপাঁচেক হল আমরা এই জায়গাটিতে এসে সাগর-সৈকত হোটেলে অধিষ্ঠিত হয়েছি এবং হোটেলের সামনে খোলা জায়গাটিতে বসে রীতিমত রৌদ্রসেবনও চলেছে আমাদের।
সাগর-সৈকত হোটেলটি থেকে সমুদ্র হাত-কুড়ি-পচিশের বেশী দূরে হবে না। হোটেলের বারান্দা হতে সমুদ্র একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়—ঐ দিগন্তে আকাশ ও সমুদ্র যেন প্রীতির আনন্দে কোলাকুলি করছে। একটানা সমুদ্রের নোনা বাতাসে ভেসে আসছে যেন অবিশ্রাম নিষ্ঠুর চাপা হাসির একটা উল্লাস। সফেন তরঙ্গগুলি যেন আদি-অন্তহীন সমুদ্রের ঝকঝকে করাল দন্তপাতি। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল। বলতে গেলে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মাটি, যেটুকু সমুদ্রের বলয়গ্রাসের বেষ্টনীতে বন্দী হয়ে আছে সেটুকুও যেন গ্রাস করবার জন্য দুরন্ত নিষ্ঠুর ঐ জলধির চেষ্টার অন্ত নেই। ব্যাকুল নির্মম লক্ষ লক্ষ বাহু প্রসারিত করে মুহুর্মুহুঃ সে মাটির বুকে দুরন্ত উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ক্ষুরধার তৃষিত লোল জিহবা দিয়ে লেহন করে নিষ্ঠুর কলহাসিতে যেন পরক্ষণেই আবার ভেঙে শতধায় গড়িয়ে ভূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
বেলা প্রায় সাড়ে আটটা হবে। সূর্যের তাপ এখনো প্রখর হয়নি। হোটেলের সামনেই বালুবেলার উপরে নিত্যকারের মত আমি ও কিরীটী দুটো ক্যামবিসের ফোলডিং চেয়ার পেতে কিরীটীরই নির্দেশমত শোলার হ্যাট চাপিয়ে গেঞ্জি গায়ে পায়জামা পরিধান করে যথানিয়মে রৌদ্রসেবন করছি। রৌদ্রসেবনের ফলাফল যাই হোক, শীতের সকালে সমুদ্রোপকূলে বসে রৌদ্রের তাপটুকু বেশ উপভোগই করছিলাম।
অল্প দূরেই সমুদ্র-সৈকত এবং শীতকাল হলেও নানাজাতীয় যুবা-বৃদ্ধ-পুরুষ-রমণী ও কিশোর-কিশোরী স্নানার্থী ও দর্শকদের ভিড়ে সমুদ্র-সৈকতটি আলোড়িত হচ্ছে এবং মধ্যে মধ্যে তাদের উল্লাসের সুস্পষ্ট গুঞ্জনও কানে আসছে সাগর-বাতাসে ভেসে।
হোটেলের সামনে যে জায়গাটিতে আমরা বসে আছি তাকে ছোটখাটো একটা উদ্যান বলা চলে। নানাজাতীয় পাতাবাহারের গাছ ও মরসুমী ফলের বিচিত্র রঙিন সমারোহ স্থানটিকে সত্যিই মনোরম করে রেখেছে। হোটেল থেকে যে পায়ে-চলা-পথটা বরাবর সাগর-সৈকতে গিয়ে মিশেছে, তার দু পাশে ঝাউয়ের বীথি। সাগর-বাতাসে ঝাউ গাছের পাতায় একটা করুণ কান্না যেন নিরন্তর দীর্ঘশ্বাসের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে।
অল্পক্ষণ আগে কিরীটী তার মাথা থেকে শোলার টুপিটা খুলে একটা মোটা লাঠির মাথায় বসিয়ে পাশেই বালুর মধ্যে লাঠিটা পুতে দিয়ে আড় হয়ে আরামকেদারটার ওপরে বাম হাঁটুর উপরে ডান পা-টা তুলে দিয়ে মৃদু মৃদু নাচাচ্ছিল সামনের সাগর-সৈকতের দিকে তাকিয়ে। হাতের মুঠোয় ধরা একটা ইংরাজী উপন্যাস। হঠাৎ আমাকে সম্বোধন করে বললে, সু, ঐ সাদা ফ্লানেলের লংস ও গায়ে কালো গ্রেট কোট একটা চাপিয়ে যুবকটি এই দিকেই আসছে, স্রেফ ওর চলা দেখে এই মুহূর্তে ওর মনের চিন্তাধারার একটা study করে বলতে পারিস কিছু?