- বইয়ের নামঃ আলোকে আঁধারে
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই
প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই প্রথমে যে, একটা দিন সকলে মিলে বটানিকসে গিয়ে হৈ চৈ করে কাটানো যাক।
এবং প্রস্তাবটা তুলেছিল সে মিত্রানীর কাছে এসে তার বাড়িতে এক সকালে। বেলা তখন নয়টা সোয়া নয়টা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই সেই আনন্দ উৎসবে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ছুটি না শেষ হতেই তাকে চলে যেতে হয়েছিল। বৎসর তিনেক হবে প্রায় সজল কলকাতায় ছিল না। সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাস, তারপর বি. কম.-এ কোনমতে পাস করে যখন সে নিজেও স্থির করতে পারছে না অতঃ কিম্ কোন্ লাইনে, কোন্ পথে পা বাড়াবে, আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব নানা জনে নানা পরামর্শ দিচ্ছে, সজল সকলের অজ্ঞাতেই এবং নেহাতই একটা খেয়ালের বশে কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসে গিয়েছিল—পাস সে করবেই না জানত।
সাধারণ মিডিওকার ছাত্র সে কিন্তু রেজাল্ট বেরুলে আশ্চর্য, দেখা গেল প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতে প্লেস একটা সে নীচের দিক হলেও পেয়ে গিয়েছে। এবং তারই জোরে একটা চাকরি তার আজকালকার দিনে লোভনীয়ই বলতে হবে পেয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবেরা তো বটেই, আত্মীয় ও পরিচিতজনেরা ওর এই হঠাৎ সাকসেসে বেশ একটু যেন আশ্চর্যই হয়েছিল। প্রথমে দিল্লীতে ট্রেনিং, তারপর বৎসরখানেক এদিক ওদিক হাতেকলমে ট্রেনিং শেষ করে একদিন সে নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড হলো বোধ হয় কিছুদিনের জন্যই। এবং ঐ পোস্টিংয়ের খবরটা তার পরিচিত বন্ধুমহলে সকলেই পেয়েছিল।
মিত্রানী সেদিন সকালে কলেজে বেরুবে বলে উঠি-উঠি করছে-হঠাৎ সজল এসে ঘরে ঢুকল। পরনে দামী সুট, বড়লোক বা অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে না হলেও পোশাকে আশাকে বরাবরই সে কিছুটা শৌখীন ও ফিটফাট ছিল। কিন্তু আজকের বেশভূষা ও শৌখীনতার মধ্যে একটু বিশেষত্বই ছিল বুঝি সজলের। দেখতে সজল কালোর উপর মোটামুটি মন্দ নয়, সুগঠিত পৌরুষোচিত দেহ। বেশ লম্বা।
হ্যালো মিত্ৰানী—
আরে আরে কী আশ্চর্য, সজল তুমি। উচ্ছল আনন্দে মিত্রানী বলে ওঠে।
হাসতে হাসতে আরো দুপা এগিয়ে এসে সজল বললে, হ্যাঁ, সজলের প্রেত নয়-সজল চক্রবর্তীই–
হাসতে হাসতেই মিত্রানী জবাব দেয়, সে তো দেখতেই পাচ্ছি—শুনেছিলাম নর্থ বেঙ্গলের কোথায় কি একটা একজিকিউটিভ পোস্ট নিয়ে গিয়েছে–।
সজল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে, আর বলো না—ঐ নামেই বড় পোস্ট দিবারাত্র এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেই। তোমরা তো ভাবো কি জানি কি একটা হয়ে গিয়েছি, কিন্তু আসলে—
বোস সজল, চা করে আনি। কতকটা যেন সজলকে থামিয়ে দিয়েই কথাটা বললে মিত্রানী। কারণ মিত্রানী জানত, একবার শুরু করলে সজল থামবে না।
না না-সজল বললে।
সে কি-যখন-তখন আগের মত চা খাও না বুঝি আজকাল আর!
না।
তাহলে তোমার সেই থিওরি, সব সময়ই টির সময়–
জান না তো, সর্বক্ষণ কাজ নিয়ে কি ব্যস্ত থাকতে হয় আমায়—তাছাড়া বানিয়ে দেবে কে?
কেন, বানাবার কেউ নেই!
শ্রীমান বাহাদুর আছে বটে, তবে সে যা চা বা কফি বানায়—
তা এবার জীবনে যখন থিতু হয়ে বসেছে—তোমার কথায় চা-কফি বানাবার জন্য কাউকে একজনকে ঘরে নিয়ে এসো না। হাসতে হাসতে বললে মিত্রানী।
তার মানে বিয়ে তো! সজল বললে।
হ্যাঁ—তা ছাড়া আর কি?
কি জান, বিয়ে তখনি করা যায় মিত্রানী, যখন মনের মত কাউকে পাওয়া যায়। তাছাড়া তুমি তো জানো মিত্রানী, ওয়াইফ এবং কম্প্যানিয়ন আমি একই সঙ্গে চাই।
ওয়াইফই একদিন কম্প্যানিয়ন হয়ে ওঠে সজল। মিত্রানী হাসতে হাসতে বললে।
না। ওটা তোমার ভুল। সব সময় ঠিক তা হয় না। আর তখন নিজের হাত নিজে কামড়ানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।
তা বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব আছে নাকি। খুঁজলে তুমি যেমনটি চাইছো তেমনি
অত সময় বা ধৈর্য কোনটাই আমার নেই।
ঘড়িতে ঐ সময় নয়টা বাজতেই মিত্রানী চমকে ওঠে, উঃ বাবা, নটা তুমি বোসো সজল, আমি চট করে স্নান করে তৈরী হয়ে নিই—
কেন? এত তাড়াহুড়ো কিসের?
আমি যে একটা কলেজে প্রফেসারী করছি কিছুদিন হলো—
সত্যি?
হ্যাঁ—এম. এ. পাস করে ডক্টরেটের জন্য তৈরী হতে হতে একটা পেয়ে গেলাম—তবে মাইনে সামান্যই–
আজকাল আর সে কথা বলো না মিত্রা, আজকাল শিক্ষক, অধ্যাপকদের মাইনে তো ভালই দেয় শুনেছি আমাদের দেশে
তা অবিশ্যি দেয় তবে সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার মানটাও মার্কারি কলমের মতো প্রত্যহ ঊর্ধ্বগতির দিকেই চলেছে—বোসা আমি আসছি–
না, না—আজকের দিনটা ড্রপ কর—নাই বা কলেজে গেলে আজ অধ্যাপিকা।
তা কি হয়, মেয়েরা ক্লাসে আমার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবে—
একটা দিন না হয় বসেই রইলো, ড়ুব মেরে দাও আজকের দিনটা—কতদিন পরে এলাম! কতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলো বল তো, আমার অনারেই আজ না হয় কাজে ড়ুব দিলে
তা হয় না সজল। অথচ আমি শুধু তোমারই জন্য—
আমারই জন্য?
তাই, তোমারই জন্য এসেছি।
সত্যি বলছো?
বিশ্বাস তুমি যে করবে না তা আমি জানি মিত্রা, নচেৎ এতগুলো চিঠি লিখেছি অথচ একটারও জবাব দাওনি—
ডোন্ট টেল লাই সজল, তোমার প্রত্যেকটা চিঠিরই জবাব আমি দিয়েছি।
হ্যাঁ দিয়েছে, তবে আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি। যে জবাবটি পাওয়ার জন্য প্রতিদিন তোমার চিঠির প্রত্যাশায় থেকেছি–
মিত্রানী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে।
আচ্ছা, তুমি কি সত্যিই আমার চিঠির অর্থ বুঝতে পারোনি?