- বইয়ের নামঃ নীলনির্জন
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্ত্য রঙ্গ
হারে-রে রঙ্গিলা, তোর কথার টানে টানে
পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াই, সমস্ত রাতভোর
কোন্ কামনার আগুন ছুঁয়ে স্বপ্ন দেখি তোর,
কোন্ দুরাশার, রঙ্গিলা? তুই হঠাৎ কোনোখানে
না ভাঙলে না-দেখার দেয়াল, মিথ্যে এ তোর খোঁজে
দিন কাটানোল বাঁধন খোলার স্বপ্নে দিয়ে ছাই
ঘর ছাড়িয়ে পরিয়ে দিলি পথের বাঁধন, তাই ব্যর্থ হল রঙ্গিলা তোর সমস্ত রঙ্গ যে।
হারে-রে রঙ্গিলা, তোর গানের টানে টানে
পার হয়েছি দুঃখ, তবু কেমন করে ভুলি
আজও আমার জীর্ণ শাখায় সুখের কুঁড়িগুলি
পাপড়ি মেলে দেয়নি, আমার শুকনো মরা গাঙে
তরঙ্গ নেই, হৃদয়ধনুর দৃপ্ত কঠিন ছিলা
দিনে দিনে শিথিল হল; রঙ্গিলা, এইবার
অন্ধকারকে ছিন্ন করে ফুলের মন্ত্র আর
ঢেউয়ের মন্ত্র শেখা আমায়, রঙ্গিলা রঙ্গিলা!
হারে-রে রঙ্গিলা, তোর সময় নিরবধি
রঙ্গও অনন্ত, আমার সময় নেই যে আর,
কে আমাকে শিখিয়ে দেবে পথের হাহাকার
কী করে হয় শান্ত, আমার প্রাণের শুকনো নদী
উজান বইবে কেমন করে, অমর্ত্য কোন্ গানে
ফুল ফুটিয়ে ব্যর্থ করি শীতের তাড়নায়,–
তুই যদি না শেখাস তবে চলব না আর, না,
রঙ্গিলা তোর কথার টানে, টানের টানে টানে।
অমর্ত্য গান
সাধারণ, তুমি সাধারণ, তাই
অসাধারণের গানে
উতলা হয়ো না হয়ো না, তোমার
যা কিছু স্বপ্ন সীমা টানো তার,
তুলে দাও খিল হৃদয়ে, নিখিল
বসুধার সন্ধানে
যেয়ো না, তোমার নেই অধিকার
দুর্লভ তার গানে।
সাধারণ, তুমি সাধারণ, তাই
ছোট আশা ভালবাসা—
তা-ই দিয়ে ছোট হৃদয় ভরাও,
তার বেশি যদি কিছু পেতে চাও
পাবে না, পাবে না, যাকে আজও চেনা
হল না, সর্বনাশা
সেই মায়াবীর গান ভুলে যাও,
ভোলো তার ভালবাসা।
সাধারণ, তুমি সাধারণ, তবু
অসাধারণের গানে
ভুলেছ; পুড়েছে ছোট ছোট আশা,
পুড়েছে তোমার ছোট ভালবাসা,
ছোট হাসি আর ছোট কান্নার
সব স্মৃতি সেই প্রাণে
বুঝি মুছে যায় যে-প্রাণ হারায়
সেই অমর্ত্য গানে।
আকাঙ্ক্ষা তাকে
আকাঙ্ক্ষা তাকে শান্তি দেয়নি,
শান্তির আশা দিয়ে বার বার
লুব্ধ করেছে। লোভ তাকে দূর
দুঃস্থ পাপের পথে টেনে নিয়ে
তবুও সুখের ক্ষুধা মেটায়নি
দিনে দিনে আরও নতুন ক্ষুধার
সৃষ্টি করেছে; সুখলোভাতুর
আশায় দিয়েছে আগুন জ্বালিয়ে।
এই যে আকাশ, আকাশের নীল,
এই যে সুস্থসবল হাওয়ার
আসা-যাওয়া, রূপরঙের মিছিল,
কোনোখানে নেই সান্ত্বনা তার।
বন্ধুরা তাকে যেটুকু দিয়েছে,
শত্রুরা তার সব কেড়ে নিয়ে
কোনো দূরদেশে ছেড়ে দিয়েছিল
কোনো দুর্গম পথে। তারপর
যখন সে প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে,
শোকের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে
প্রেম তাকে দিল সান্ত্বনা, দিল
স্বয়ংশান্তি তৃপ্তির ঘর।
একচক্ষু
কী দেখলে তুমি? রৌদ্রকঠিন
হাওয়ার অট্টহাসি
দু’হাতে ছড়িয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর
গ্রীষ্মের প্রেত-সেনা
মাঠে-মাঠে বুঝি ফিরছে? ফিরুক,
তবু তার পাশাপাশি
কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী তুমি
একবারও দেখলে না?
একবারও তুমি দেখলে না, তার
বিশীর্ণ মরা ডালে
ছড়িয়ে গিয়েছে নম্র আগুন,
মৃত্যুর সব দেনা
তুচ্ছ সেখানে, নবযৌবনা
কৃষ্ণচূড়ার গালে
ক্ষমার শান্ত লজ্জা কি তুমি
একবারও দেখলে না?
এশিয়া
এখন অস্ফুট আলো । ফিকে ফিকে ছাড়া অন্ধকারে
অরণ্য সমুদ্র হ্রদ, রাত্রির শিশির-শিক্ত মাঠ
অস্থির আগ্রহে কাঁপে, আসে দিন, কঠিন কপাট
ভেঙে পড়ে । দুর্বিনীত দুরন্ত আদেশ শুনে কারো
দীর্ঘরাত্রি মরে যায়, ধসে পড়ে শীর্ণ রাজ্যপাট ;
নির্ভয়ে জনতা হাঁটে আলোর বলিষ্ঠ অভিসারে ।
হে এশিয়া, রাত্রিশেষ, “ভস্ম অপমান শয্যা” ছাড়,
উজ্জীবিত হও রূঢ় অসংকোচ রৌদ্রের প্রহারে ।
শহরে বন্দরে গঞ্জে, গ্রামাঞ্চলে, ক্ষেতে ও খামারে
জাগে প্রাণ, দ্বীপে দ্বীপে মুঠিবদ্ধ অহ্বান পাঠায় ;
অগণ্য মানবশিশু সেই ক্ষিপ্র অনিবার্য ডাক
দুর্জয় আশ্বাসে শোনে, দৃঢ় পায়ে হাঁটে । তারপরে
ভারতে, সিংহলে, ব্রহ্মে, ইন্দোচীনে, ইন্দোনেশিয়ায়
বীত-নিদ্র জনস্রোত বিদ্যুত্-উল্লাসে নেয় বাঁক ।
কাঁচ রোদ্দুর, ছায়া অরণ্য
কাঁচ-রোদ্দুর, ছায়া-অরণ্য, হ্রদয়ের স্বপ্ন।
আকণ্ঠ নিস্তেজ তৃপ্তি, ডোরাকাটা ছায়া সরল’–
বনে-বাদাড়ে শত্রু ঘোরে,
তাজা রক্ত,–শয়তান অব্যর্থ।
ঝানু আকাশ ঝুঁকে পড়ে অবাক।
কাঁচা চামড়ার চাবুক হেনে
ছিঁড়ে টেনে খেলা জমছে:
এরা কারা, এ কী করছে?
লোহা-গলানো আগুন জ্বলছে, সাঁড়াছি-
যন্ত্রণার দুঃস্বপ্ন।
আপ্রাণ চেষ্টায় জলের উপর রাখা জাগিয়ে
আকাশ! আকাশ!
বাতাস টেনে শ্বাসযন্ত্র আড়ষ্ট।
এখন আবার মনে পড়ছে।
প্রান্তরে জরায়ু-ভাঙা রক্তভ্রূণ,
শকুন! শকুন!
কয়েকবার পাখ্সাট মেরে ফেল আকাশে উঠল।
করোটি, হাড়পোড়া, ধুলো–
চাপ-চাপ জমাট রক্ত। ছায়ামূর্তি কে দাঁড়িয়ে?
ধুলো, ধুলো। আমি ইয়াসিন,
পুরব-চটির হাটে যাব; লাহেরিডাণ্ডা ছাড়িয়ে
সে কত দূর, সেই এক ভাবনা ঘুরছে।
জল! জল! মরচে-পড়া চুল উড়ছে।
লোহামুঠিতে
ট্রাক্টরের হাতল চেপে তবু কখন ঝিমিয়ে পড়ল মন;
কে গো তুমি মধ্যাহ্নের স্বপ্ন কাড়ো?
আগুন-বাতাসে সূর্য কাঁপে, সন্ধ্যা নামবে কখন।
মস্তিষ্কের নিখুঁত ছাপ উঠল প্লাস্টারে।
রাত করেছে, এলোমেলো চিন্তা নিস্পন্দ।
পাহাড়ের শীত-হাওয়ায় চিন্তা নিস্পন্দ।
তারা চলছে। ঘুমিয়ে পথ, যাত্রী।
আকাশ ভিজিয়ে অন্ধকার জ্বলছে,
আর
মরা অরণ্যে হঠাৎ-আগুন-লাগা ফানুসের চাঁদ উঠল,
রাত্রি।