- বইয়ের নামঃ ব্যাচেলার
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কিছু কেনাকাটা
অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কিছু কেনাকাটা করে রাস্তা পার হয়ে বন্ড স্ট্রিট টিউব স্টেশনে ঢুকতে গিয়েই মুখোমুখি দেখা। দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বললাম, আপনি?
দেবব্রত হাসতে হাসতে বললো, আমি তো বহুদিনই এখানে। আপনি কবে এলেন?
প্রায় দুসপ্তাহ হতে চললো। এবার তো ফেরার পালা।
সে কি? এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাবেন?
ফেরার পথে কয়েক জায়গায় স্টপওভার করব বলে পরশুই রওনা হচ্ছি।
অজস্র যাত্রী আসা-যাওয়া করছেন। দেবব্রত আমার হাত ধরে একটু পাশে সরে গিয়ে বললো, পরশু যাওয়া হচ্ছে না।
একটু আগেই রিজার্ভেশন করে এলাম।
দ্যাটস নাথিং। ক্যানসেল করে দিলেই হবে। তারপর হাসতে হাসতে বললো, এতকাল পরে দেখা হলো আর আমার হাতের রান্না না খাইয়েই ছাড়ব?
আমি বললাম, খেলে রঞ্জনার হাতের রান্নাই খাব।
রঞ্জনা তো এখানে আসেনি। ও দিল্লিতেই…
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমার হাতে টুকিটাকি কয়েকটা প্যাকেট। তাছাড়া বন্ড স্ট্রিট-টিউব স্টেশনে দাঁড়িয়ে কথা বলাও অসম্ভব। দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছেন?
হোটেলে।
কোনো হোটেলে? সেই স্ট্রান্ড…
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, হোটেলে আসবেন?
আপনি থাকবেন?
থাকব। আজ আর কোথাও বেরুচ্ছি না।
দেবব্রত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, সেকি? লন্ডনে এসে সন্ধেবেলা হোটেলে শুয়ে কাটাবেন?
কি করব? কদিন এত পরিশ্রম করতে হয়েছে যে আজ আর একটু রেস্টনা নিয়ে পারছি না।
কোনো পুরনো বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন নেই?
ছিল কিন্তু তাকে বললাম কাল যাব।
কিন্তু আমি এলে তো আপনার বিশ্রাম হবে না।
হাসতে হাসতে বললাম, পরিশ্রমও হবে না।
দেন আই অ্যাম কামিং। এই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আসছি।
আসুন। গল্প করা যাবে।
আমি তর তর করে নিচে নেমে গেলাম। দেবব্রত অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ভিড়ে মিশে গেল।
.
ঠিক পনের বছর আগেকার কথা। নেহরুর সঙ্গে কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে এসেছি লন্ডনে। তাছাড়া প্রথমবার লন্ডন দেখছি। বেশ চঞ্চল। প্রায় উত্তেজিত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মার্লবোরা হাউসেই কাটাই। মাঝে মাঝে সময় পেলেই রাস্তার ওপাশে গিয়ে সেন্ট জেমস প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাই আর মনে মনে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের কয়েকটা পাতা উল্টে যাই। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের কত অবিস্মরণীয় চরিত্র এখানে বাস করেছেন। সপ্তম হেনরি, ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, এলিজাবেথ, মেরী। প্রথম চার্লস ফঁসির মঞ্চে চড়ার আগে এই সেন্ট জেমস প্যালেসের চার্চেই মহামতি যীশুর নাম স্মরণ করে ঈশ্বরের কাছে তার শেষ প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। আমাদের কোহিনূর মাথায় নিয়ে এখানেই শপথ নিয়েছে সপ্তম এডওয়ার্ড, পঞ্চম জর্জ, ষষ্ঠ ও আজকের রানী এলিজাবেথ দ্য সেকেন্ড। এই সেন্ট জেমস প্যালেসের এক ব্যালকনি থেকেই রাজার মৃত্যু সংবাদ প্রথম ঘোষণা করা হয়, দ্য কিং ইজ ডেড! লং লিভ দ্য কিং! এখনও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের পরিচয় পত্রে লেখা থাকে অ্যাম্বাসেডর টু দ্য কোর্ট অব সেন্ট জেমস! অথবা অন্য কোনো জার্নালিস্টের সঙ্গে গল্প করি। একটু বেশি সময় পেলে ল্যাংকাস্টার হাউস পেরিয়ে বাকিংহাম প্যালেসের আশেপাশে অহেতুক ঘোরাফেরা করি। বাকিংহাম প্যালেসের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি কিন্তু যতটা ভালো লাগবে আশা করেছিলাম, তা লাগে না। সেন্ট জেমস প্যালেস, মার্লবোরা হাউস বা অন্যান্য রাজপ্রাসাদের মতো বাকিংহাম প্যালেস দেখে ইতিহাস মনে পড়ে না; তবে সামনের ভিক্টোরিয়ার পাথরের মূর্তিটা দেখতে ভালো লাগে। ইতিহাসের অনেক স্মৃতি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রথমবার বিলেত দেখতে এসে সব কিছুর সঙ্গে ইতিহাস আর মনের ছবি মিলিয়ে নিতে গিয়ে কোথাও ভালো লাগে, কোথাও দুঃখ পাই। বিকেলে নিউজ পাঠাবার পরই হোটেলে আসি। স্নান করি। কালো স্যুট-টাই পরে আবার বেরিয়ে পড়ি। রিসেপসন, কটেল, ডিনার। রোজই কিছু না কিছু থাকে। শুরু হয়েছে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের প্রেস রিসেপসন দিয়ে। কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরই সাংবাদিকদের সম্মানে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের পার্টি। মার্লবোরা হাউসের পিছনের গার্ডেনের প্রবেশ পথে স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টার নিজ হাতে তুলে দেন ড্রিঙ্ক। হুইস্কি, জিন, ব্রান্ডি, বিয়ার। তারপর কোনোদিন অস্ট্রেলিয়া হাউসে আর ঘানা হাইকমিশনে, কোনোদিন স্যাভয় বা ক্লারিজ হোটেলে। অথবা কেনসিংটন গার্ডেনে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের বাড়িতে স্কচের গেলাস হাতে নিয়ে কাশ্মীরী কার্পেট বা ইন্দ্রাণী রহমানের ওডিসি নাচের আলোচনা থেকে আয়ুব সিকিউরিটি কাউন্সিল ডিঙিয়ে একেবারে ভারতীয় সমাজতন্ত্রে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের ডিপ্লোম্যাটরা। এসব শেষ হলেও ছুটি পাই না। কোনো না কোনো আড়ডায় আটকে পড়ি। তারপর হোটেলের রিসেপসনে এসে ঘরের চাবির জন্য হাত বাড়িয়ে সামনের বড় ঘড়িটার দিকে নজর পড়ে। দু চার পেগ হুইস্কি পেটে থাকলেও চমকে উঠি। দুটো! আড়াইটে!
ছটা দিন এভাবেই কেটে গেল। পরের দিন সকালে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনারের বাড়িতে মস্কো বন প্যারিসের ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসেডরদের সঙ্গে নেহরু ঘন্টা দুই আলাপ-আলোচনা করলেন। তারপর প্রবাসী কয়েকজন ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের নানা সমস্যা নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। প্রাইম মিনিস্টারের সম্মানে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের লাঞ্চের সময় নেহরু নিজেই কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে এসে বললেন, ডু ইউ নো আই উইল বী মিটিং আওয়ার স্টুডেন্টস অ্যাট ফোর-পাঁচটায় নয়।