- বইয়ের নামঃ নাসরীন জাহানের গল্প
- লেখকের নামঃ নাসরীন জাহান
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
পথ, হে পথ – নাসরীন জাহান
আমার যদি আলাদা একটি গোপন ঘর থাকতো এই স্বপ্নটি আমি প্রায়ই দেখি। বিছানায় ল্যাপটে থাকা সবুজ চাদর পাল্টানোর সময়, অথবা ছাতলা পড়া ঘটর ঘটর ফ্যানের দিকে চেয়ে যখন শুয়ে থাকি, সেই ঘরটির কথা গম্ভীরভাবে মনে হয়। আমি যে ঘরটিতে থাকি, সেই ঘরটিও খুব ছিমছাম, গোছানো। যদিও মাঝে মাঝে একসেট ভালো সোফা, একটি ফ্রিজ, রঙিন টি.ভি. বিশেষ করে একটি টেলিফোন এসবের অভাব অনুভব করি। মনে হয় ফোন থাকলে মহেন্দ্র, ইরফান অথবা আবদুল্লাহর সাথে গল্প করে অনেক একঘেয়ে সময়কে মুখ করে তোলা যেতো। বুও এসবের অভাব সত্ত্বেও আমি আমার ছোেট রুম দুটোকে যথেষ্ট ভালোবাসি। বারান্দাটিকে ভালোবাসি, যেখানে দাঁড়িয়ে আমার অনেক নিঃসঙ্গ সময় অতিবাহিত হয়। আমার একটাই অসুবিধে একটি জিনিস একভাবে দেখতে খুব হাঁপিয়ে উঠি। তাই আমি আমার ঘরে যা-ই আসবাব আছে তাকেই অদলবদল করে মাঝে মাঝে অন্যরকম করার চেষ্টায় নানাভাবে সাজাই। খাট, ড্রেসিং টেবিল আয়না….এই যথাস্থান থেকে সরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাখলে ভেতরে এক আশ্চর্য অনাবিলতা অনু করি। তো কথা হচ্ছিলো ঘর নিয়ে। এতো যে মাঝে মাঝে টানা হ্যাচড়া তাতেও কিন্তু আমি কম হাঁপিয়ে উঠি না। কিন্তু জিনিসগুলো এক জায়গায় বেশিদিন স্থির থাকলে আমার যতটুকু শাস কষ্ট হয়, তার চেয়ে ওগুলোকে স্থানাস্ত্র করার কষ্ট যথেষ্ট কম। মনে হয় মাঝে মাঝেই আমি এক নতুন স্থানে সময় কাটাচ্ছি।
২.
এখন গভীর রাত।
দেড় বছরের শিশুর মতো টলমল হাঁটছে মইন। অনেক জরুরি ব্যাপার মনে থাকার কথা ছিলো আজ। মনে থাকেনি। সারাদিন শুধু একটি কথাই মনে থেকেছে তার অনেকগুলো জরুরি কাজ সারতে হবে। আর কিছু মনে থাকেনি। যা তোক পাঁচ পেগ গেলার পর যে কোন জরুরি ব্যাপারকেই ফানুস বানিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায়, এমন একটা ভাবনা ওকে ফুরফুরে করে দেয়। যেন, যে পাঁচ পেগ, কিংবা দুই পেগ, কিংবা এক পেগ-যা-ই পান করে, যে পান করে তাকে কোন জরুরি অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়াটাই অন্যায়। তার কাছে যে কোন কৈফিয়ত চাওয়া অন্যায়। সে ঘরে। ফিরলে ঘরের মানুষের কুঞ্চিত হওয়া অন্যায়…..। অন্তত বিয়ের আগে মইন যখন দিনরাত বাংলা মদ, আর মেথরপট্টির মধ্যে থাকতো, তাই মনে হতো তার। আজও মনে হচ্ছে। অন্তত মইন তেমন অন্যায় বরদাস্ত করবে না। তাই সে বেশ দূরে মেইন রোডে রিকশা ছেড়ে দিয়ে রাজার মতো হাঁটতে শুরু করেছে।
ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে রাক্ষুসী সূর্য মাথায় নিয়ে, অফিস থেকে রুটিন মতোই বাড়ি ফিরছিলো। সূর্যের গনগনে আঁচে ঝিমঝিম করছিলো মাথা। শহরের ওপর আছড়ে পড়া উজ্জ্বল আলো যখন কখনো নীল, কখনো সবুজ কখনো বেগুনি, হলুদ, বেগুনি নীল, কমলা….বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছিলো চোখে, তখনই সেই ভিবজিওরের মাঝখান থেকে চিৎকার করে উঠেছিলো একটি মার্সিডিজ গাড়ি-হেই মইন-হেই
নিজের নামটা টং করে মস্তিষ্কের মধ্যে ধাক্কা খায়। ঘোর লাগা চোখে মইন উত্তপ্ত শহরের চলমান যন্ত্রগুলোর ওপর দৃষ্টি বোলায়। সাত রঙের মাঝখানে একটি মার্সিডিজ। হাত নাড়ছে পুতুল। এক গাদা রিকশা, গাড়ি, রাস্তার পাশে স্তুপাকার দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা, কাঁচা মাংসের গাড়িসহ কসাইয়ের গাড়ি, একঝাক কুঁজো বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকের মাঝখানে পুতুল স্বপ্নের মতো হাত নাড়ছে। রিকশা থেকে লাফিয়ে নামে মইন।
ক্লাসমেট ছিলো, মইন একতরফা দুর্বল ছিলো, বহুদিন পর দেখা। ওর শীতল গাড়িতে বসে, সেন্টের ভুর ভুর গন্ধে মইন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরপর লে হালুয়া! দুপুরে হোটেলে রুটি-মাংস, বিকেলটা অনেকদিন পর ক্রিসেন্ট লেকে, সন্ধ্যার পর ওর নির্জন ফ্ল্যাটে, এক পেগ, দুই পেগ, তিন পেগ-। মইনের পা গর্তের মধ্যে হড়কে পড়ে।
৩.
আমি ঘর নিয়ে ভাবছিলাম। গলির মোড়ে একটি লোক রিকশা থেকে নামছে। আমি গলা বাড়িয়ে দেই, মইন এসে গেছে তাহলে। অন্ধকার পথ দিয়ে হেঁটে আসছে মানুষটি। নিমগাছ আর ঘিঞ্জি বাড়িগুলি রাস্তাটিকে আড়াল করে রেখেছে। ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ছায়া মন মানুষটিকে। জানালা থেকে সরে আসি, না, মইন অত লম্বা নয়। নিজেকে শিথিল বিছানায় শুয়ে আমি পুনরায় ভাবনার ভেতর নিমজ্জিত হই। আমার ভাবনা আবারও ঘরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। আমার এই ঘরকেই আমি ভালোবাসা সত্ত্বেও আমি আরেকটি নির্জন ঘরের স্বপ্ন দেখি।
যে ঘরে কোন আসবাবই নেই। সেই শূণ্য নির্জন ঘরে থাকবে শুধু থোকা থোকা বাতাস। আমি ভীষণ বিচিত্র মনের মেয়ে। বেশিক্ষণ এক বিষয় আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। মুশকিল হয় মইনকে নিয়ে। সেতো আর আসবাব নয়, যখন তখন নিজের মতো করে সাজিয়ে নিলাম। রীতিমতো শিক্ষিত একজন রক্ত মাংসে গড়া মানুষ, যে দিব্যি আমাকে বাঁ ঠ্যাং দেখিয়ে খুঁটিনাটি আমার অনেক অপছন্দের কাজ নাকের ডগায় সেরে ফেলে। বিয়ের পর এতটা বছর কেটে যাওয়ার পরও প্রথম দিন তাকে যেমন দেখেছিলাম এ থেকে ওর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। মাঝে মাঝে দাঁড়ি রাখতে বলে, মিলিটারী ছাঁটের চুল ঝাকড়া করে রেখে অথবা এক দুটো লাল শার্ট, ঠোঙ্গা প্যান্ট বানাতে বলে…. ওর একটু পরিবর্তিত রূপ দেখার তীব্র ইচ্ছে হয়েছে আমার। কিন্তু ওই যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ, হাত আছে, পা আছে, মুখ আছে অনুভূতি আছে। বাধা দিতে জানে, পাশ কাটিয়ে চলে যেতে জানে, মোট কথা সে নিজের অনুভত্বকেই সর্বাগ্রে মূল্য দিতে জানে।