- বইয়ের নামঃ দশমহাবিদ্যা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার মা যে গোলাপ সুন্দরী
(আমার) মা যে গোলাপ সুন্দরী।
এক বৃন্তে কৃষ্ণকলি,
অপরাজিতার মঞ্জরী॥
(সে) আধেক পুরুষ আধেক কৃষ্ণা নারী
অর্ধ কালী অর্ধ বংশীধারী
(মা) অর্ধ অঙ্গে পীতাম্বর
আধেক সে দিগম্বরী॥
(সে) এক পায়ে প্রেম-কুসুম ফোটায়
নূপুর-পরা সেই চরণ।
(মা-র) সেই পায়ে রয় সর্প-বলয়
সে পায়ে প্রলয়-মরণ।
আধো ললাটে অগ্নি-তিলক জ্বলে
চন্দ্রলেখা আধেক ললাট-তলে।
শক্তি আর ভক্তিতে মা
আছেন যুগল রূপ ধরি॥
আয় মা উমা, রাখব এবার
আয় মা উমা, রাখব এবার
ছেলের সাজে সাজিয়ে তোরে।
(ওমা) মা-র কাছে তুই রইবি নিতুই,
যাবি না আর শ্বশুর-ঘরে॥
মা হওয়ার মা কী যে জ্বালা
বুঝবি না তুই গিরিবালা,
(তোরে) না দেখলে শূন্য এ বুক
কী যে হাহাকার করে॥
তোর টানে মা শংকর শিব
আসবে নেমে জীব-জগতে,
আনন্দেরই হাট বসাব
নিরানন্দ ভূ-ভারতে।
না দেখে যে মা তোর লীলা
হয়ে আছি পাষাণ-শিলা,
(আয়) কৈলাসে তুই ফিরবি নেচে
বৃন্দাবনের নূপুর পরে॥
ওরা আমার কেহ নয়
(ওরা) আমার কেহ নয়।
আজ এসেছে রইবে না কাল, আমার কেহ নয়।
মা গো ওরা তোরে শুধু আড়াল করে রয়॥
(ওরা) মোর ইচ্ছায় আসেনিকো কেহ
(ওরা) মোর ইচ্ছায় যায় না ছেড়ে গেহ।
এ সংসারের পান্থশালায় ক্ষণিক পরিচয়
মা, ওদের সাথে ক্ষণিক পরিচয়॥
যারা কেবল আছে মা গো
মা-ভোলাবার তরে,
নে তাদের মায়া হরে।
(তোর) পূজারই ভোগ খায় কেড়ে মা
পাঁচ ভূতে আর চোরে।
(ওরা) সবাই যাবে রইবে নাকো কেউ,
মিথ্যা ওরা ক্ষণিক মায়ার ঢেউ,
ওদের মায়ায় তোকে ভোলার
ভুল যেন না হয়॥
কী দশা হয়েছে মোদের
কী দশা হয়েছে মোদের
দেখ মা উমা আনন্দিনী।
(তোর) বাপ হয়েছে পাষাণ গিরি
মা হয়েছে পাগলিনি॥
(মা) এদেশে আর ফুল ফোটে না,
গঙ্গাতে আর ঢেউ ওঠে না,
(তোর) হাসি মুখ না দেখলে যে মা
পোহায় না মোর নিশীথিনী॥
আর যাবি না ছেড়ে মোদের
বল মা আমার কন্ঠ ধরি
সুর যেন তার না থামে আর
বাজালি তুই যে বাঁশরি।
না পেলে তুই শিবের দেখা
রইতে যদি নারিস একা
(আমি) শিবকে বেঁধে রাখব মাগো
হয়ে শিব-পূজারিনি॥
কে তোরে কী বলেছে মা ঘুরে বেড়াস কালি মেখে
কে তোরে কী বলেছে মা ঘুরে বেড়াস কালি মেখে।
(ও মা) বরাভয়া, ভয়ংকরীর সাজ পেলি তুই কোথা থেকে॥
(তোর) এলোকেশে প্রলয় দোলে
(আমি) চিনতে নারি গৌরী বলে
(ওমা) চাঁদ লুকাল মেঘের কোলে
তোর মুখে না হাসি দেখে॥
(ও মা) আমার দেবলোকে কেন
খেলিস এমন নিঠুর খেলা?
আনন্দেরই হাটে সতী
বসালি পাঁচ ভূতের মেলা।
শংকর কি গঙ্গা নিয়ে
কাঁদায় তোরে দুঃখ দিয়ে (মা)
(ও মা) শিবানী তোর চরণ-তলে
এনেছি তাই শিবকে ডেকে॥
জয় বিগলিত করুণা-রূপিণী গঙ্গে
(জয়) বিগলিত করুণা-রূপিণী গঙ্গে।
(জয়) কলুষহারিণী পতিতপাবনী
নিত্যাপবিত্রা যোগী-ঋষিসঙ্গে॥
হরি-শ্রীচরণ ছুঁয়ে আপনহারা
পরম প্রেমে হলে দ্রবীভূতধারা।
ত্রিলোকের ত্রি-তাপ-পাপ তুমি নিলে মা
নির্মলে! তোমার পবিত্র অঙ্গে॥
তুই কালি মেখে জ্যোতি ঢেকে
(তুই) কালি মেখে জ্যোতি ঢেকে
পারবি না মা ফাঁকি দিতে।
(ওই) অসীম আঁধার হয় যে উজল
মা তোর ঈষৎ চাহনিতে॥
মায়ের কালি-মাখা কোলে
শিশু কি মা যেতে ভোলে?
(আমি) দেখেছি যে,
বিপুল স্নেহের সাগর দোলে তোর আঁখিতে॥
কেন আমায় দেখাস মা ভয়
খড়্গ নিয়ে, মুণ্ড নিয়ে?
আমি কি মার সেই সন্তান
ভুলাবি মা ভয় দেখিয়ে?
তোর সংসার-কাজে শ্যামা
বাধা আমি হব না মা,
মায়ার বাঁধন খুলে দে মা
ব্রহ্মময়ী রূপ দেখিয়ে॥
তুমিই দিলে দুঃখ অভাব তুমিই করো ত্রাণ
তুমিই দিলে দুঃখ অভাব তুমিই করো ত্রাণ
তুমিই দিলে দুঃখ অভাব তুমিই করো ত্রাণ।
দীনতারিণী, মঙ্গলময়ী শরণাগত প্রাণ॥
যখন পরম নির্ভরতায়
শরণ যাচি তোমারই পায়
(তুমি) আপন হাতে বিনাশ কর সকল অকল্যাণ॥
(আমি) অহংকারে রাখতে যাহা
চাই গো আমার বলে
হরণ করে লও তুমি তা
ভাসিয়ে চোখের জলে।
তাই তো আমার সংসার-ভার
মা গো তোমায় দিলাম এবার,
আমার বলে রইল শুধু তোমার নাম গান॥
তোমার পূজার ফুল ফুটেছে
তোমার পূজার ফুল ফুটেছে
মা গো আমার মনে।
তুমিই এসে লহ যে ফুল
তোমার শ্রীচরণে॥
কখন তুমি মনের ভুলে
চরণ দিয়ে হৃদয় ছুঁলে,
কমল হয়ে ফুটল হিয়া
তোমার পরশনে॥
মা গো, সেই ফুল ঠাঁই পাবে কি
তোমার গলার মালায়?
সে ফুল কবে রাখব তোমার
নিবেদনের থালায়?
তোমার চলার পথের ধূলি
ছেয়ে দিলাম সে ফুল তুলি
কবে তারে দলবে পায়ে
চলতে আনমনে॥
তোর রাঙা পায়ে নে মা শ্যামা
তোর রাঙা পায়ে নে মা শ্যামা
আমার প্রথম পূজার ফুল।
ভজন-পূজন জানি না মা
হয়তো হবে কতই ভুল॥
দাঁড়িয়ে দ্বারে ‘মা, মা’ বলে
ভাসি মাগো নয়ন-জলে,
ভয় হয় মা ছুঁই কেমনে
মা তোর পূজার বেদিমূল।
আশ্রয় মোর নাই জননী
ত্রিভুবনে কোথাও হায়!
দাঁড়াই মাগো কাহার কাছে
তুইও যদি ঠেলিস পায়।
হানে হেলা সবাই যারে
তুই নাকি কোল দিস মা তারে
(আমি) সেই আশাতে এসেছি মা
অকূলে তুই দে মা কূল॥
নন্দলোক হতে আমি এনেছি রে মহামায়ায়
নন্দলোক হতে আমি এনেছি রে মহামায়ায়।
বন্ধ যথায় বন্দি যত কংস রাজার অন্ধ কারায়॥
বন্দি জাগো! ভাঙো আগল
ফেল রে ছিঁড়ে পায়ের শিকল
বুকের পাষাণ ছুঁড়ে ফেলে
মুক্তলোকে বেরিয়ে আয়॥
আমার বুকের গোপালকে রে
রেখে এলাম নন্দালয়ে,
সেইখানে সে বংশী বাজায়
আনন্দে গোপ-দুলাল হয়ে।
মা-র আদেশে বাজাবে সে
অভয় শঙ্খ দেশে দেশে
তোরা, নারায়ণী-সেনা হবি
এবার নারায়ণীর কৃপায়॥