- বইয়ের নামঃ জুলফিকার
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অসীম বেদনায় কাঁদে মদিনাবাসী
অসীম বেদনায় কাঁদে মদিনাবাসী।
নিভিয়া গেল চাঁদের মুখের হাসি॥
শোকের বাদল আছড়ে পড়ে
কাঁদছে মরুর বুকের পরে,
ব্যথার তুফানে আরব গেল ভাসি॥
গোলাব-বাগে গুল নাহি আজ
কাঁদিছে বুলবুলি।
ছাইল আকাশ অন্ধকারে
মরু সাহারার ধূলি।
তরুলতা বনের পাখি
কোথায় হোসেন কইছে ডাকি,
পড়ছে ঝরে তারার রাশি॥
আজি ঈদ ঈদ ঈদ খুশির ঈদ
আজি ঈদ ঈদ ঈদ খুশির ঈদ, এল ঈদ
(যাঁর) আসার আশায় চোখে মোদের ছিল না রে নিদ॥
শোন, রে গাফিল, কী বলে তকবির ঈদগাহে,
(তোর) আমানতের হিসসা সাদকা দে খোদার রাহে;
নে সাদকা দিয়ে বেহেশ্তে, যাবার রসিদ॥
ঈদের চাঁদের তশতরিতে জান্নাত হতে
আনন্দেরই শিরনি এল আশমানি পথে,
সেই শিরনি নিয়ে নতুন আশায় জাগবে না-উম্মিদ॥
(তোর) পিরাহানের আতব গোলাব লাগুক রে মনে,
(আজ) প্রেমের দাওত দে দুনিয়ার সকল জনে,
দিলেন ঈদের মারফতে হজরত এই তাগিদ॥
আমার হৃদয় শামাদানে জ্বালি মোমের বাতি
আমার হৃদয় শামাদানে জ্বালি মোমের বাতি।
নবিজিগো! জেগে আমি কাঁদি সারা রাতি॥
আশমানেরই চাঁদোয়াতলে
চাঁদ সেতারার পিদিম জ্বলে,
ওরাও যেন খোঁজে তোমার আমার দুখের সাথি॥
দিনের কাজে পাই না সময় তাই নিরালা রাতে
তোমার পাওয়ার পথ খুঁজি গো কোরানের আয়াতে।
ঝরলে পাতা ডাকলে পাখি
চমকে ভাবি তুমি নাকি?
মসজিদে যাই গভীর রাতে খুঁজি আঁতিপাঁতি
রোজহাশরে পায় দেখা মোরে সবাই বলে
তোমার বিহনে ঘুম নাই নয়নে,
মোর জীবনে রোজ কিয়ামত আসে প্রতিপলে,
বিষের সমান লাগে আমার দুনিয়ার যশ খ্যাতি॥
মিনার কোলে নাচে হেলে দুলে
আমিনার কোলে নাচে হেলে দুলে
শিশু নবি আহমদ রূপের লহর তুলে॥
রাঙা মেঘের কাছে ঈদের চাঁদ নাচে –
যেন নাচে ভোরের আলো গোলাব গাছে।
চরণে ভোমরা গুঞ্জরে গুল ভুলে॥
সেই খুশির ঢেউ লাগে আরশ ও কুরসির পাশে,
হাততালি দিয়ে হুরি সব বেহেশ্তে হাসে,
সুখে ওঠে কেঁপে দুনিয়া চরণ-মূলে॥
চাঁদনি-রাঙা অতুল মোহন মোমের পুতুল
আদুল গায়ে নাচে খোদার প্রেমে বেভুল।
আল্লার দয়ায় তোহ্ফা এল ধরার কূলে॥
আল্লা নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে
আল্লা নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে।
ফলবে ফসল, বেচব তারে কিয়ামতের হাটে॥
পত্তনিদার যে এই জমি
খাজনা দিয়ে সেই নবিজির
বেহেশ্তেরই তালুক কিনে বসব সোনার খাটে॥
মসজিদে মোর ধরাই বাঁধা, হবে নাকো চুরি,
‘মনকের’‘নকির’ দুই ফেরেশতা হিসাব রাখে জুড়ি।
রাখব হেফাজতের তরে
ইমানকে মোর সাথি করে,
রদ হবে না কিস্তি, জমি উঠবে না আর লাটে॥
আল্লা রসুল জপের গুণে কী হল দেখ চেয়ে
আল্লা রসুল জপের গুণে কী হল দেখ চেয়ে।
সদাই ঈদের দিনের খুশিতে তোর পরান আছে ছেয়ে॥
আল্লার রহমত ঝরে
ঘরে বাইরে তোর উপরে,
আল্লার রসুল হয়েছেন তোর জীবন-তরির নেয়ে॥
দুখে সুখে সমান খুশি, নাই ভাবনা ভয়,
(তুই) দুনিয়াদারি করিস, তবু আল্লাতে মন রয়।
মরণকে আর ভয় নাই তোর,
খোদার প্রেমে পরান বিভোর,
(এখন) তিনিই দেখেন তোর সংসার তোর ছেলেমেয়ে॥
আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়
ভৈরবী – কারফা
আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়।
আমার নবি মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়॥
আমার কীসের শঙ্কা,
কোরআন আমার ডঙ্কা,
ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়॥
কলেমা আমার তারিজ, তৌহীদ আমার মুরশিদ,
ইমান আমার বর্ম, হেলাল আমার খুরশিদ।
‘আল্লাহ্ আকবর’ধ্বনি
আমার জেহাদ-বাণী,
আখের মোকাম ফেরদৌস খোদার আরশ যথায় রয়॥
আরব মেসের চীন হিন্দ মুসলিম-জাহান মোর ভাই,
কেহ নয় উচ্চ কেহ নীচ, এখানে সমান সবাই।
এক দেহ এক দিল এক প্রাণ,
আমির ফকির এক সমান,
এক তকবীরে উঠি জেগে, আমার হবেই হবে জয়॥
আহ্মদের ওই মিমের পর্দা উঠিয়ে দেখ মন
পিলু কাম্বাজ – সাদ্রা
আহ্মদের ওই মিমের পর্দা
উঠিয়ে দেখ মন।
আহাদ সেথায় বিরাজ করেন
হেরে গুণীজন॥
যে চিনতে পারে রয় না ঘরে
হয় সে উদাসী
সে সকল ত্যজি ভজে শুধু
নবিজির চরণ॥
ওই রূপ দেখে রে পাগল হল
মনসুর হল্লাজ
সে আনালহক’‘আনালহক’বলে
ত্যজিল জীবন॥
তুই খোদকে যদি চিনতে পারিস
চিনবি খোদাকে,
তোর রুহানী আয়নাতে দেখরে
সেই নূরী রওশন॥
আয় মরু-পারের হাওয়া
মাঢ়-মিশ্র – দাদরা
আয় মরু-পারের হাওয়া,
নিয়ে যা রে মদিনায়।
জাত পাক মোস্তফার
রওজা মোবারক যথায়॥
পড়িয়া আজি দুখে
মুশরেকী এই মুল্লুকে,
পড়ব মগরেবের নামাজ
কবে খানায়ে-কাবায়॥
হজরতের নাম তসবি করে,
যাব রে মিসকিন বেশে,
ইসলামেরই দীন-ই ডঙ্কা
বাজল প্রথম যে দেশে॥
কাঁদব মাজার-শরিফ ধরে,
শুনব সেথায় কান পাতি,
হয়তো সেথা নবির মুখে
রব ওঠে ‘য়্যা উম্মতি’!
আজও কোরআনের কালাম
হয়তো সেথা শোনা যায়॥
ইসলামের ওই সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর
ভৈরবী – কারফা
ইসলামের ওই সওদা লয়ে
এল নবীন সওদাগর।
বদনসিব আয়, আয় গুনাহ্গার,
নতুন করে সওদা কর॥
জীবন ভরে করলি লোকসান,
আজ হিসাব তার খতিয়ে নে,
বিনি মূলে দেয় বিলিয়ে
সে যে, বেহেশ্তি নজর॥
কোরানের ওই জাহাজ বোঝাই
হিরা মুক্তা পান্নাতে,
লুটে নে রে লুটে নে সব
ভরে তোল তোর শূন্য ঘর॥
কলেমার ওই কানাকড়ির
বদলে দেয় এই বণিক
শাফায়তের সাত রাজার ধন,
কে নিবি আয় ত্বরা কর॥
কিয়ামতের বাজারে ভাই
মুনাফা, যে চাও বহুত,
এই ব্যাপারীর হও খরিদার,
লও রে ইহার সিলমোহর॥
আরশ হতে পথ ভুলে এ
এল মদিনা শহর,
নামে মোবারক মোহাম্মদ,
পুঁজি আল্লাহু আকবর॥