- বইয়ের নামঃ চোখের চাতক
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আঁধার রাতে কে গো একেলা
দেশ-পিলু – দাদরা
আঁধার রাতে কে গো একেলা
নয়ন-সলিলে ভাসালে ভেলা।
কাঁদিয়া কারে খোঁজো ওপারে
আজও যে তোমার প্রভাতবেলা॥
কী দুখে আজি যোগিনী সাজি
আপনারে লয়ে এ হেলাফেলা॥
সোনার কাঁকন ও দুটি করে
হেরো গো জড়ায়ে মিনতি করে।
খুলিয়া ধুলায় ফেলো না গো তায়
সাধিছে নূপুর চরণ ধরে।
হেরো গো তীরে কাঁদিয়া ফিরে
আজি ও রূপের রঙের মেলা॥
আজি এ শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে
মিঁয়া কী মল্লার – কাওয়ালি
আজি এ শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে
গুর দেয়া-গরজন কাঁপে হিয়া ঘনঘন
শনশন কাঁদে বায়ু নীপ-কাননে॥
অন্ধ নিশীথ, মন খোঁজে কারে আঁধারে,
অন্ধ নয়ন ঝরে শাওন-বারিধারে।
ভাঙিয়া দুয়ার মম এসো এসো প্রিয়তম,
শ্বসিছে বাহির ঘর ভেজা পবনে॥
কার চোখে এত জল ঝরে দিক প্লাবিয়া,
সহিতে না পারি কাঁদে ‘চোখ গেল’ পাপিয়া।
কাহার কাজল-আঁখি চাহি মোর নয়নে
ঝুরেছিল একা রাতে কবে কোন্ শাওনে,
আজি এ বাদল ঝড়ে সেই আঁখি মনে পড়ে,
বিজলি খুঁজিছে তারে নভ-আঙনে॥
আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে
ভৈরবী-আশাবরি – আদ্ধা কাওয়ালি
আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে
হায় কী মনে পড়ে মন এমন করে॥
হায় এমন দিনে কে নীড়হারা পাখি
যাও কাঁদিয়া কোথায় কোন, সাথিরে ডাকি।
তোর ভেঙেছে পাখা কোন্ কুল ঝড়ে॥
আয় ঝড়ের পাখি আয়এ একা বুকে,
আয় দিব রে আশয় মোর গহন-দুখে,
আয় রচিব কুলায় আজ নূতন করে॥
এই ঝড়ের রাতি নাই সাথের সাথি,
মেঘ-মেদুর-গগন বায় নিবেছে বাতি,
মোরএ ভীরু প্রণয় হায় কাঁপিয়া মরে॥
এই বাদল-ঝড়ে হায় পথিক-কবি
ওই পথের পরে আর কতকাল রবি,
ফুল দলিবি কত হায় অভিমান-ভরে॥
আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরি
খাম্বাজ-পিলু – দাদরা
আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরি
এ কোন্ সোনার গাঁয়।
আমার ভাটির তরি আবার কেন
উজান যেতে চায়॥
আমার দুঃখের কাণ্ডারি করি
আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙা তরি,
তুমি ডাক দিলে কে স্বপনপরি
নয়ন-ইশারায়॥
আমার নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিল ঝড়ের রাতি,
তুমি কে এলে মোর সুরের সাথি
গানের কিনারায়॥
সোনার দেশের সোনার মেয়ে,
তুমি হবে কি মোর তরির নেয়ে,
এবার ভাঙা তরি চলো বেয়ে
রাঙা অলকায়॥
আমার গহিন জলের নদী
ভাটিয়ালি – কাহারবা
আমার গহিন জলের নদী।
আমি তোমার জলে রইলাম ভেসে জনম অবধি॥
তোমার বানে ভেসে গেল আমার বাঁধা ঘর
চরে এসে বসলাম রে ভাই ভাসালে সে চর।
এখনসব হারায়ে তোমার জলে রে
আমি ভাসি নিরবধি॥
আমার ঘর ভাঙিল ঘর পাব ভাই
ভাঙলে কেন মন,
হারালে আর পাওয়া না যায়
মনের রতন।
জোয়ার মন ফেরে না আর রে
ও সে ভাটিতে হারায় যদি॥
তুমি ভাঙো যখন কূল রে নদী
ভাঙো একই ধার,
আর মন যখন ভাঙো রে নদী
দুই কূল ভাঙো তার।
চর পড়ে না মনের কূলে রে
একবার সে ভাঙে যদি॥
আমার দুখের বন্ধু, তোমার কাছে
ছায়ানট-কেদারা – একতালা
আমার দুখের বন্ধু, তোমার কাছে
চাইনি তো এ সুখ।
আমিজানিনি তো বুকে পেয়েও
কাঁদবে এমন বুক॥
আমারশাখায় যবে ফোটেনি ফুল
আমি চেয়েছি পথ আশায় আকুল,
আজ ফোটা ফুলে কাঁদে কেন
কুসুম ঝরার দুখ॥
প্রিয়, মিলন-আশায় ছিনু সুখে
ছিলে যবে দূর।
আজ কাছে পেয়ে পরান কাঁদে
বিদায়-ভয়াতুর।
এ-যে অমৃতে গরল মিশা
প্রাণে কেবলই বাড়িছে তৃষা,
আমার স্বর্গে কেন মলিন ধরার
বেদন জাগরূক॥
আমার সাম্পান যাত্রী না লয়
ভাটিয়ালি – কার্ফা
আমার সাম্পান যাত্রী না লয়
ভাঙা আমার তরি।
আমিআপনারে লয়ে রে ভাই
এপার ওপার করি॥
আমায় দেউলিয়া করেছে রে ভাই যে নদীর জল
আমি ডুবে দেখতে এসেছি ভাই সেই জলেরই তল।
আমি ভাসতে আসি, আসিনিকো কামাতে ভাই কড়ি॥
আমি এই জলেরই আয়নাতে ভাই দেখেছিলাম তায়
এখন আয়না আছে পড়ে রে ভাই
আয়নার মানুষ নাই।
চোখের জলে নদীর জলে রে
আমি তারেই খুঁজে মরি॥
আমি তারই-র আশায় সাম্পান লয়ে ঘটে বসে থাকি,
আমার তারই-র নাম ভাই জপমালা,
তারেই কেঁদে ডাকি।
আমার নয়ন-তারা লইয়া গেছে রে
নয়ন নদীর জলে ভরি॥
ওই নদীর জলও শুকায় রে ভাই, সে জল আসে ফিরে,
আর মানুষ গেলে ফিরে না কি দিলে মাথার কিরে।
আমি ভালোবেসে গেলাম ভেসে গো
আমি হলাম দেশান্তরী॥
আমি কী সুখে লো গৃহে রব
কীর্তন
আমি কী সুখে লো গৃহে রব।
আমার শ্যাম হল যদি যোগী ওলো সখী
আমিও যোগিনী হব॥
সেআমারই ধেয়ান করিত গো সদা
তার সে ধ্যান ভাঙিল যদি,
ওলো সে ভোলে ভুলুক, আমি ওই রূপ
ধেয়াইব নিরবধি।
আমিও যোগিনী হব।
শ্যামযে তরুর মূলে বসিবে লো ধ্যানে
সেথা আঁচল বিছায়ে রব।
আমি ধুলায় বসতে দেব না সই,
তার সোনার অঙ্গ মলিন হবে
ধুলায় বসতে দেব না সই।
কুয়াশায় চাঁদ পড়বে ঢাকা
সহিতে পারিব না সই।
সখী ধুলাই যদি সে মাগে,
আমি আপনি রাঙা পথ-ধূলি
বঁধুয়ার অনুরাগে।
শ্যাম যে পথ দিয়ে চলে যাবে
সেই পথের ধূলি হব।
সে চলে যেতে দলে যাবে
সেই সুখে গো ধূলি হব।
হব ভিক্ষার ঝুলি, শ্যাম লবে তুলি
বাহুতে আমারে জড়ায়ে,
সখী আমার বেদনা-গৈরিক-রাঙা
বাস দেব তারে পরায়ে।
নবীন যোগীরে সাজাইব আমি,
আমার প্রাণের গোধূলি-বেলায়
রঙে রঙে তারে সাজাইব আমি।
সখী তার অনাদর-আগুনে জ্বালায়ে
পোড়াব লাবণি মোর,
ওলো তারই-র হাতের আঘাতে আঘাতে
হবে এ দেহ কঠোর।
আমার এ তনু শুকাবে গভীর অভিমানের জ্বালা,
আমি তাই দিয়ে তার হব গলায় রুদ্রাক্ষেরই মালা।
আমি শ্যামের গলার মালা হব,
আমি জীবনে পেয়েছি জ্বালা শুধু সখী,
মরে এবার মালা হব।
আমার চোখের জলে বইবে নদী,
আমি নদী হয়ে কেঁদে যাব
চরণে তার নিরবধি।
আমি কী সুখে লো গৃহে রব,
আমার শ্যাম হল যদি যোগী ওলো সখী
আমিও যোগিনী হব॥