- বইয়ের নামঃ চলে যায় বসন্তের দিন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
মাজেদা খালার চিঠি
[“চলে যায় বসন্তের দিন!”
কী অদ্ভুত কথা! বসন্তের দিন কেন চলে যাবে? কোনো কিছুই তো চলে যায় না। এক বসন্ত যায়, আরেক বসন্ত আসে। স্বপ্ন চলে যায়, আবারো ফিরে আসে।
আমি হিমু!
আমি কেন বলব— চলে যায় বসন্তের দিন। আমার মধ্যে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
কী সেই সমস্যা?]
প্রসঙ্গ : হিমু।
অহঙ্কার প্রকাশ পায় এমন কিছু লেখার ব্যাপারে। আমি বেশ সচেতন। খুব চেষ্টা করি কেউ যেন আমার ভেতরের অহঙ্কার বুঝতে না পারে। এই যুক্তিতে, যে-ঘটনাটি আমি এখন বলব তা বলা উচিত না। ঘটনাটির মধ্যে সূক্ষ্ম এবং স্কুল— দুই রীতিতেই অহঙ্কার প্রকাশ পায়। তবু বলে ফেলছি।
দুবছর আগে আমি কোলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে মাত্র ঢুকেছি, হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ছেলে পা ছুঁয়ে প্ৰণাম করে বলল, দাদা, আমি হিমু। দেখুন। আমার পাঞ্জাবি–হলুদ। আমি বললাম, হিমুরা তো খালি পায়ে হাঁটাহাটি করে। দেখি তোমার পা। সে সবগুলি দাঁত বের করে তার খালি পা দেখাল।
নিজের দেশে অনেক হিমুর দেখা পেয়েছি। বিদেশে এই প্রথম খাঁটি হিমু দেখলাম। আমার ত্রিশ বছর লেখালেখির ফসল যদি হয় কিছু হিমু তৈরি করা— তাহলে তাই সই। আমি এতেই খুশি। পরম করুণাময় আমাকে যথেষ্টই করুণা করেছেন।
হুমায়ুন আহমেদ
নুহাশপল্লী, গাজীপুর
১০.০১.২০০২
——————
০১.
হিমু,
আমি মহাবিপদে পড়েছি। তুই আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর। বিনিময়ে যা চাইবি তাই দেব। আমার অতি গুণধর পুত্ৰ মনে হয়। কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। ভাড়া খাটা টাইপ একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে। মুখে অবশ্যি এখনো কিছু বলছে না। আমি গন্ধে গন্ধে বুঝে ফেলেছি। আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। মেয়েটার নাম ফুলফুলিয়া। যে মেয়ের নাম ফুলফুলিয়া সে কেমন মেয়ে বুঝতেই তো পারছিস। ঘটনা এখানেই শেষ না। ঐ হারামজাদি মেয়ের বাবা কী করে জিনিস? সে হারমোনিয়াম বাদক। যাত্ৰাদলে হারমোনিয়াম আরো কী সব নাকি বাজায়। তুই চিন্তা করে দেখ ছেলের বাবা কেবিনেট সেক্রেটারি। আর শ্বশুর হারমোনিয়াম বাদক। হিমু যেভাবেই হোক জহিরকে বুঝিয়ে সুজিয়ে পথে আনতে হবে। ঐ হারামজাদিকে দূরে কোথাও বিয়ে দিয়ে বিদায় করার ব্যবস্থা কর। যাবতীয় খরচ আমি দেব। প্রয়োজনে হারামজাদিকে গয়নাও কিনে দেব।
তোর দোহাই লাগে ঘটনা কাউকে বলবি না। চিঠি পাওয়া মাত্র আমার কাছে চলে আসবি। দুজনে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেব। তোর খালু সাহেব এখনো কিছু জানে না। তাকে ইচ্ছা করে কিছু জানাই নি। এতবড় শক সে নিতে পারবে না। ধুম করে এটাক ফেটাক হয়ে যাবে। একবার এটাক হয়েছে। দ্বিতীয়বার হলে আর দেখতে হবে না। হিমু, তুই আমাকে বাঁচা।
ইতি
তোর মাজেদা খালা
এক পৃষ্ঠার চিঠি। চিঠির সঙ্গে পাঁচশ টাকার চকচকে একটা নোট স্ট্রেপল করা। এটা হলো মাজেদা খালার সন্টাইল। তিনি কাউকে চিঠি দিয়েছেন সঙ্গে টাকা স্ট্রেপল করা নেই এমন কখনো হয় নি। চিঠির সঙ্গে টাকা দেয়ার পেছনে একটা গল্প আছে। খুব ছোটবেলায় মাজেদা খালার বড় মামা তাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠির সঙ্গে ছিল একটা চকচকে দশ টাকার নোট। জীবনের প্রথম চিঠি, সেই সঙ্গে টাকা। খালার মাথার ভেতরে ব্যাপারটা ঢুকে গেল। তখন থেকেই তিনি ঠিক করেছেন–যখনই কাউকে চিঠি লিখবেন সঙ্গে টাকা থাকবে। শৈশবের প্রতিজ্ঞা কৈশোর পর্যন্ত গড়ায় না। মাজেদা খালা ব্যতিক্রম। তিনি এখনো প্ৰতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেছেন। শুরুতে দশ টাকা, বিশটাকা দিতেন। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে টাকার পরিমাণ বেড়েছে। এখন চিঠি প্ৰতি পাঁচশ টাকা।
মাজেদা খালার চিঠিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কোনো কারণ নেই। দড়ি দেখলেই যারা সাপ মনে করে তিনি তাদের চেয়েও দুই ডিগ্রি ওপরে— যেকোনো লম্বা সাইজের জিনিস দেখলেই তিনি সাপ মনে করেন। কাছে গিয়ে দেখবেনও না–সাপ কি-না। দূর থেকেই চিৎকার চোঁচামেচি–ওমাগো, দোতলায় সাপ এলো কীভাবে?
আমি নিশ্চিত জহিরকে নিয়ে তিনি যে মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন তা পুরোপুরি অর্থহীন। জহির অতি ভালো ছেলে। সে যে কত ভালো তা একটা অতি ব্যবহার করে বুঝানো যাবে না। খুব কম করে হলেও তিনটা অতি ব্যবহার করতে হবে–অতি অতি অতি ভালো ছেলে। সে ফিজিক্সে অনার্স পড়ছে। দুর্দান্ত ছাত্র। পাশ করেই ঢাকা ইউনিৰ্ভাসিটিতে লেকচারারের চাকরি পেয়ে যাবে। কিন্তু তার জীবনের স্বপ্ন সে একটা কফির দোকান দেবে। আধুনিক কফিশপ। জীবন কাটাবে কফি বিক্রি করে। কারণ কফির গন্ধ তার ভালো লাগে। কফি হাউসে লোকজন আনন্দ করে কফি খেতে খেতে গল্প করে–এই দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে এবং তার নিজেরও কফি খেতে ভালো লাগে। সে কফি হাউসের নামও ঠিক করে রেখেছে— শুধুই কফিতা।
জহিরের ধারণা ফ এবং ব খুব কাছাকাছি। শুধুই কফিতা আসলে শুধুই কবিতা। নিতান্তই ভালোমানুষ টাইপ লোকজনের মাথাতেই এ রকম আইডিয়া আসে। জহির সরল ধরনের ভালোমানুষ। পৃথিবীতে বক্র ধরনের ভালোমানুষও আছে। বক্র ভালোমানুষরা ভালো। তবে তাদের চিন্তা-ভাবনা বক্ৰ। জহির সেরকম না। ফুলফুলিয়া হয়েছে। একজন ভালো মানুষ অন্য একজন ভালোমানুষকে খুঁজে বের করে। একটা চোর খুঁজে বের করে আরেকটা চোরকে। ফুলফুলিয়ার সঙ্গে পরিচয় হলে দেখা যাবে সেও চমৎকার একটি মেয়ে। জহিরের শুধুই কফিতা কফিশপে কফি বানানোর জন্যে ছটফট করছে।