- বইয়ের নামঃ জলপদ্য
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্যরকম
তুমি এলে, দুঃখ দিয়ে চলে গেলে
বোকা ছেলে!
এ কোনও অচেনা দুঃখ নয়–
এর দাঁতগুলো, নখগুলো কতটা গভীরে যায়
মাংসে, হাঁড়ে, মজ্জায়
হৃদয়ের কোন কুঠুরিতে ঢুকে হল্লা করে, করে না-শুকোনো ঘা
কতটা জল শুষে নিয়ে চর ফেলে
কতটা দিতে পারে বনবাস বা সন্ন্যাস
কী রকম নিখুঁত খেলা খেলে
এ দুঃখ জানি, এ আমার অনেককালের চেনা।
এমন দুঃখ দিয়ে বুঝি স্বস্তি পেলে!
এরকম যে কেউ দিতে পারে, যে কোনও ছেলে,
তুমি অন্যরকম কিছু দুঃখ দিলে না কেন
তুমি তো আর ছিলে না যে কোনও ছেলে!
ছিলে অন্যরকম,
তোমাকে ভালবেসেছিলাম অন্যরকম।
আছে মানুষ, নেই মানুষ
এখানে যারা ছিল তারা নেই আর
যারা আছে তারাও থাকবে না
তুমি না,
আমি না।
আমাদের ত্বক থেকে গজিয়ে উঠবে ঘাস, চুলের ডগা থেকে মেঘছোঁয়া কৃষ্ণচূড়া
কারো কারো হাড় থেকে সাত তলা দালান
সেসব দালানে বসে জীবনের চারাগাছে জল দেবে যারা,
তারাও একদিন সার হবে আমজামকামরাঙার।
এখানে ছিল এখানে আছে
এখানে নেই সেখানে নেই কোথাও নেই
নেই তো নেই-ই
নেই
যারা নেই হয়ে যায়, তাদের কেউ খোঁজে না কখনও
বেঁচে থাকা মানুষের ব্যস্ততা বিষম, বাঁচার জন্য।
আত্মহনন
তুমি বলেছিলে ’ন মেকিত পা,
ছেঁড়ো না আমাকে।
পুরনো চটিজুতোর মত, চিরুনির মত
ঘরের কুকুরের মত,
বেড়ালছানার মত থাকতে দিও কাছে,
তোমার ছায়ার মত।‘
অথচ তুমিই ছেড়ে গেলে
আর কারও ছায়া বা ছায়ার ছায়া হতে।
আমি একা বসে সুতির কাঁটা নেড়ে সূক্ষ্ম জাল বুনি
নিজেই জড়াই যে জালে, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে–
কে যেন শেকড়সুদ্ধ টেনে ফেলে রাখে খানাখন্দে, ঝোপে
যে ঝোপে পথ ভুলে একটি জোনাকিও আসেনা কখনও–
আমার ছায়াটিও বুঝি পালাচ্ছে তোমার মত!
আনা কারেনিনা
প্রতিটি নারীর ভেতর বাস করে একজন আনা কারেনিনা
জানি না নারী তা জানে কি না
সম্ভবত না।
আমার কোনও বন্ধু নেই
আমার কোনও বন্ধু নেই, আপন কিছু শত্রু আছে শুধু
শত্রু নিয়ে পাড়া বেড়াই, শহর ঘুরি নীল গাড়িতে, পাতাল রেলে বাসেও চড়ি, দোকানপাটে,
রাস্তাঘাটে, রেস্তোরাঁতে ভিড়ে
রাত্রিবেলা ফিরে
যে যার মত গরম জলে স্নান করে নি’,
মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে দুজোড়া ঠোঁটে মুহুর্মুহু চুমু দু
জন বেসেদুজনকেই ভীষণ ভাবে ভাল
এক বালিশে ঘুমিয়ে পড়ি, নিবিয়ে কড়া আলো।
সকালবেলা দুজন উঠে নাস্তা করি, বাজার ঘুরে শাকসবজি মাছ মাংস কিনে
রান্না করি, বাসন মাজি, মিটিয়ে ফেলি দিনের কাজ দিনে।
শত্রু বসে বাঁশি বাজায়, মুগ্ধ চোখে তাকায় চোখে, আমি
দেখে পাগল, হৃদয় জলে জোয়ার ওঠে, সমুদুরে নামি,
সারা দুপুর সাঁতরে ফিরি ডাঙার খোঁজে, কোথায় পাব? তার অতলে থামি।
জেনেই থামি শত্রু সমকামি,
ভেতরে তার বিষ লুকোনো দাঁত, কামড়ে দেবে যখন খুশি
তারই বা দোষ দিচ্ছি কেন!
নিজেই আমি নিজের মনে অসম্ভব এক শত্রু পুষি না কি?
আমার মায়ের গল্প
১.
চোখ হলুদ হচ্ছিল মা’র,
শেষে এমন, যেন আস্ত দুটো ডিমের কুসুম!
পেট এমন তেড়ে ফুলছিল, যেন জেঁকে বসা বিশাল পাথর
নাকি এক পুকুর জল–বুঝি ফেটে বেরোবে!
মা দাঁড়াতে পারছেন না,
না বসতে,
না নাড়তে হাতের আঙুল,
না কিছু।
মা’কে মা বলে চেনা যাচ্ছিল না, শেষে এমন।
আত্মীয়রা সকাল সন্ধে শুনিয়ে যাচ্ছে
ভাল একটি শুক্রবার দেখে যেন তৈরি হন মা…
যেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে
যেন মুনকার নকির সওয়াল জবাবের জন্য এলে বিমুখ না হয়
যেন পাক পবিত্র থাকে ঘর দুয়োর, হাতের কাছে থাকে সুরমা আর আতর।
হামুখো অসুখ মা’র শরীরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেদিন,
গিলে ফেলছে দুফোঁটা যে শক্তি ছিল শেষের, সেটুকুও।
কোটর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে চোখ,
চরচর করছে জিভ শুকিয়ে,
ফুসফুসে বাতাস কমে আসছে মা’র,
শ্বাস নেবার জন্য কী অসম্ভব কাতরাচ্ছেন–
যন্ত্রণায় কুঁচকে আছে কপাল, কালো ভুরু
গোটা বাড়ি তখন চেঁচিয়ে মা’কে বলছে তাদের সালাম পৌঁছে দিতে নবীজিকে,
কারও কোনও সংশয় নেই যে মা জান্নাতুল ফিরদাউসে যাচ্ছেন,
নবীজির হাত ধরে বিকেলে বাগানে হাঁটবেন,
পাখির মাংস আর আঙুরের রস খাবেন দুজন বসে,
অমনই তো স্বপ্ন ছিল, মা’র অমনই স্বপ্ন ছিল।
আশ্চর্য, মা তবু কোথাও এক পা যেতে চাইছিলেন না।
চাইছিলেন বিরুই চালের ভাত বেঁধে খাওয়াতে আমাকে,
টাকি মাছের ভর্তা আর ইলিশ ভাজা। নতুন ওঠা জাম-আলুর ঝোল।
একখানা কচি ডাব পেড়ে দিতে চাইছিলেন দক্ষিণের গাছ থেকে,
চাইছিলেন হাতপাখায় বাতাস করতে চুল সরিয়ে দিতে দিতে–কপালের কটি এলো চুল।
নতুন চাদর বিছিয়ে দিতে চাইছিলেন বিছানায়,
আর জামা বানিয়ে দিতে, ফুল তোলা…
চাইছিলেন উঠোনে খালি পায়ে হাঁটতে,
হেলে পড়া কামরাঙা গাছটির গায়ে বাঁশের কঞ্চির ঠেস দিতে
চাইছিলেন হাসনুহেনার বাগানে বসে গান গাইতে ওগো মায়াভরা চাঁদ আর
মায়াবিনী রাত, আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার।…
বিষম বাঁচতে চেয়েছিলেন মা।
.
২.
আমি জানি পরকাল, পুলসেরাত বলে কিছু নেই।
আমি জানি ওসব ধর্মবাদিদের টোপ
ওসব বেহেসত, পাখির মাংস, মদ আর গোলাপি মেয়েমানুষ!
আমি জানি জান্নাতুল ফিরদাউস নামের কোনও বেহেসতে
যাবেন না, কারও সঙ্গে বাগানে হাঁটবেন না মা!
কবর খুঁড়ে মা’র মাংস খেয়ে যাবে পাড়ার শেয়াল
শাদা হাঁড়গুলো বিচ্ছিরিরকম ছড়িয়ে–
গোরখাদক একদিন তাও তুলে ফেলে দেবে কোথাও,
জন্মের মত মা নিশ্চিহ্ন হবেন।
তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে
সাত আসমানের ওপরে অথবা কোথাও
বেহেসত বলে কিছু আছে,
জান্নাতুল ফিরদাউস বলে কিছু,
চমৎকার কিছু,
চোখ ঝলসানো কিছু।
মা তরতর করে পুলসেরাত পার হয়ে গেছেন
পলক ফেলা যায় না দেখলে এমন সুদর্শন, নবীজি,
বেহেসতের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে মা’কে আলিঙ্গণ করছেন;
মাখনের মত মা মিশে যাচ্ছেন নবীজির লোমশ বুকে।
ঝরণার পানিতে মা’র স্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছে
মা’র দৌড়োতে ইচ্ছে ইচ্ছে
বেহেসতের এ মাথা থেকে ও মাথা–
মা স্নান করছেন,
দৌড়োচ্ছেন, লাফাচ্ছেন।
রেকাবি ভরে পাখির মাংস এসে গেছে, মা খাচ্ছেন।
মা’কে দেখতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পায়ে হেঁটে
বাগান অবদি এসেছেন।
মা’র খোঁপায় খুঁজে দিচ্ছেন লাল একটি ফুল,
মা’কে চুমু খাচ্ছেন।
আদরে আহ্লাদে মা নাচছেন, গাইছেন।
মা ঘুমোতে গেছেন পালকের বিছানায়,
সাতশ হুমা’কে বাতাস করছে,
রূপোর গেলাশ ভরে মা’র জন্য পানি আনছে গেলবান।
মা হাসছেন, মা’র সারা শরীর হাসছে
আনন্দে।
পৃথিবীতে এক দুঃসহ জীবন ছিল মা’র, মা’র মনে নেই।
এত ঘোর নাস্তিক আমি,
আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে বেহেসত বলে কিছু আছে কোথাও।