- বইয়ের নামঃ বন্দিনী
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অজ্ঞাতবাস
অজ্ঞাতবাস
দিল্লি
২৩ নভেম্বর ২০০৭–১৯ মার্চ ২০০৮
যে ঘরটিতে আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে….
আমি এখন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে বন্ধ একটা জানালা আছে,
যে জানালা আমি ইচ্ছে করলেই খুলতে পারি না।
ভারি পর্দায় জানালাটা ঢাকা, ইচ্ছে করলেই আমি সেটা সরাতে পারি না।
এখন একটা ঘরে আমি বাস করি,
ইচ্ছে করলেই যে ঘরের দরজা আমি খুলতে পারি না, চৌকাঠ ডিঙোতে পারি না।
এমন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে আমি ছাড়া প্রাণী বলতে দক্ষিণের দেয়ালে
দুটো দুঃস্থ টিকটিকি। মানুষ বা মানুষের মতো দেখতে কোনও প্রাণীর এ ঘরে
প্রবেশাধিকার নেই।
একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় আমার।
আর কোনও শব্দ নেই চারদিকে, শুধু মাথা ঠোকার শব্দ।
জগতের কেউ দেখে না, শুধু টিকটিকিদুটো দেখে,
বড় বড় চোখ করে দেখে, কী জানি কষ্ট পায় কিনা–
মনে হয় পায়।
ওরাও কি কাঁদে, যখন কাঁদি?
একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে বাস করতে আমি চাই না।
একটা ঘরে আমি বাস করতে বাধ্য হই,
একটা ঘরে আমাকে দিনের পর দিন বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র,
একটা ঘরে, একটা অন্ধকারে, একটা অনিশ্চয়তায়, একটা আশংকায়
একটা কষ্টে, শ্বাসকষ্টে আমাকে বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র।
একটা ঘরে আমাকে তিলে তিলে হত্যা করছে ধর্মনিরপেক্ষতা।
একটা ঘরে আমাকে বাধ্য করছে প্রিয় ভারতবর্ষ…..
ভীষণরকম ব্যস্তসমস্ত মানুষ এবং মানুষের মতো দেখতে প্রাণীদের সেদিন
দুসেকেণ্ড জানি না সময় হবে কিনা দেখার,
ঘর থেকে যেদিন জড়বস্তুটি বেরোবে,
যেদিন পচা গলা একটা পিণ্ড। যেদিন হাড়গোড়।
মৃত্যুই কি মুক্তি দেবে শেষ অবধি?
মৃত্যুই বোধহয় স্বাধীনতা দেয় অতপর চৌকাঠ ডিঙোনোর!
টিকটিকিদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে সারাদিন,
ওদেরও হয়তো দুঃখ হবে মনে।
গণতন্ত্রের পতাকা পেঁচিয়ে প্রিয় ভারতবর্ষের মাটিতে
আমাকে পুঁতে দেবে কেউ, কোনও সরকারি লোক সম্ভবত।
সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে চৌকাঠ নেই ডিঙোতে চাওয়ার,
সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে শ্বাসকষ্ট নেই। ০৪.০১.০৮
অতলে অন্তরিন
তুমি আজকাল আমার বাড়িতে আসছে না আর। বাড়ি আসবে, আর
আততায়ীরা যদি আমাকে হত্যা করে, তোমার ভয়, কোনওদিক দিয়ে
কোনও গুলি ছিটকে তোমার গায়ে কোথাও লেগে যাবে।
মাঝে মাঝে ফোন কর, কেমন আছি টাছি জানতে চাও,
বাড়ি আসার কথা উঠতেই বল কী কী কারণে যেন ভীষণ ব্যস্ততা তোমার।
তুমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। শুধু বন্ধু বলি কী করে, প্রেমিক ছিলে।
কোনও কারণে ব্যস্ততা বাড়তেই পারে তোমার, ভেবে নিজেকে বুঝিয়েছি,
একা একা অন্তরীণে না হয় কাটালামই কিছু দিন। মানুষ তো দ্বীপান্তরেও
শখ করে মাঝে মাঝে যায়।যেদিন জানলাম, আমার বাড়ি না আসার
আসল কারণ তোমার কী, ভয়ে আমি কুঁকড়ে পড়ে থাকলাম,
আততায়ীর চেয়েও বেশি ভয় আমি তোমাকে পেলাম।
নভেম্বর ২০০৭
অন্তরিন
কখনও কোনওদিন যদি অন্তরিন হতে হয় তোমাকে,
যদি শেকল পরায় কেউ পায়ে, আমাকে মনে কোরো।
যদি কোনওদিন যে ঘরটিতে তুমি আছো
সে ঘরের দরজা ভেতর থেকে নয়,
বাইরে থেকে বন্ধ করে কেউ চলে যায়, মনে কোরো।
সারা তল্লাটে কেউ নেই তোমার শব্দ শোনে,
মুখ বাধা, ঠোঁটে শক্ত সেলাই।
কথা বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না।
অথবা কথা বলছে, কেউ শুনতে পাচ্ছে না,
অথবা শুনছে, শুনেও গা করছে না,
মনে কোরো।
তুমি যেমন খুব চাইবে কেউ দরজাটা খুলে দিক,
তোমার শেকল সেলাই সব খুলে দিক,
আমিও তেমন চেয়েছিলাম,
মাস পেরোলেও কেউ এ পথ মাড়ায়নি,
দরজা খুলে দিলে আবার কী হয় না হয় ভেবে খোলেনি কেউ।
মনে কোরো।
তোমার যখন খুব কষ্ট হবে, মনে কোরো আমারও হয়েছিলো,
খুব ভয়ে ভয়ে সাবধানে মেপে মেপে জীবন চললেও
আচমকা অন্তরিন হয়ে যেতে পারে যে কেউ, তুমিও।
তখন তুমি আমি সব একাকার, দুজনে এক সুতো তফাৎ নেই,
তুমিও আমার মতো, তুমিও অপেক্ষা করো মানুষের,
অন্ধকার কেঁপে আসে, মানুষ আসেনা।
২২.১.০৮
আজ যদি গান্ধিজী বেঁচে থাকতেন
আজ যদি বেঁচে থাকতেন গান্ধিজী,
যে করেই হোক বন্দি শিবির থেকে
আমাকে উদ্ধার করতেন।
নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতেন।
এ আমি হলফ করে বলতে পারি, দিতেন।
হৃদয় বলে যেহেতু তাঁর কিছু ছিল, তিনি দিতেন।
বাড়ির ঘর দোর উঠোন আঙিনায়
নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি, উছলে পড়া খুশি,
বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন দিয়ে সাজানো সংসার-সমুদ্রে
আমার সঞ্জীবনী সাঁতার দেখে
বড় সস্নেহে হাসতেন তিনি।
হৃদয় বলে যেহেতু কিছু ছিল তার, হাসতেন।
আমাকে আমার মতো যাপন
করতে দিয়ে আমার জীবন,
আমি নিশ্চিত, তিনি স্বস্তি পেতেন।
গান্ধিজী যদি বেঁচে থাকতেন আজ,
দেশের দুর্দশা দেখে তাঁর দুঃখ হত।
কালসাপের মতো ফুঁসে ওঠা অসহিষ্ণুতার সন্ত্রাস
বন্ধ করতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের
ডাক দিতেন তিনি। নিশ্চয়ই দিতেন।
আমাকে আর কতটুকু,
মূলত দেশটাকেই বাঁচাতেন।
২৯.২.২০০৮
আমরা
কাল রাতে দেখি একটি টিকটিকি কোত্থেকে লাফিয়ে গায়ে পড়ে বাহু বেয়ে আমার ঘাড়ের দিকে চলে গেল, ঘাড় পার হয়ে মাথার দিকে, চুলের জঙ্গলে শরীর আড়াল করে দ্বিতীয় টিকটিকির দিকে ঘন্টা দুয়েক অপলক তাকিয়ে থেকে ভোররাত্তিরের দিকে কানের পাশ দিয়ে নেমে শিরদাঁড়ায় গিয়ে বসে রইল। দ্বিতীয়টি স্থির শুয়ে ছিল আমার ডান পায়ের হাঁটু থেকে ইঞ্চি দুয়েক নিচে। সারারাত একচুলও নড়েনি। ওদের সরাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা আমি যা করছিলাম, তাই করি, চোখ বুজে পড়ে থাকি। মনে মনে একশ থেকে এক অবধি বারবার করে গুনি। কোনও কারণ নেই গোনার, তারপরও গুনি।
যে বিছানায় আমি ঘুমোচ্ছি, দীর্ঘদিন হল সেটি আধোয়া কাপড়, এঁটো বাসন, হিজিবিজির খাতা, চায়ের দাগে বাদামি হয়ে থাকা পুরোনো পত্রিকা, চুল আটকে থাকা চিরুনি, মিইয়ে যাওয়া মুড়ি, খোলা ওষুধপত্র, কালি ফুরিয়ে যাওয়া কলম ইত্যাদির স্থূপ। দুশর মতো বড় বড় কালো পিঁপড়ে সারা বিছানা জুড়ে কদিন হল নোঙর ফেলেছে। আটঘাট বেঁধে লেগে গেছে নতুন বসত তৈরি করতে।
আমাকে দখল করে নিচ্ছে ওরা। ওরা খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। কুঁকড়ে থেকে থেকে দিন দিন ওদের মতোই ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছি আমি।এ অবধি একটি পিঁপড়েও, আশ্চর্য, আমার শরীর জুড়ে উৎসব করছে ধ্রুপদী নৃত্যের, ভুলেও কামড় দেয়নি। আমাকে, আমার বিশ্বাস, ওদেরই একজন মনে করে ওরা!
সম্ভবত মানুষের জগতের চেয়েও এই পোকামাকড়ের জগতেই বেশি নিরাপদ আমি।
০৮.০২.০৮