- বইয়ের নামঃ খালি খালি লাগে
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
কাল
কী দেবে দাও, এক্ষুণি দাও
কালের জন্য তুলে রেখো না
প্রতিটি আগামী মুহুর্তে অতীত হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিটি ফুলই ঝরে যায়, প্রতিটি পাতাই
প্রতিটি মানুষ
একদিন আমি, একদিন তুমি।
হৃদয় দিতে চাইলে দাও
না চাইলে সেও দাও, না চাওয়াটি দাও।
কালের জন্য আমি কিছু রেখে দিই না,
আজ যদি ইচ্ছে করে দিতে, আজই দিই
তুমি না চাইতেই যা কিছু আছে দিচ্ছি
না চাইতেই আমার যশ বিত্ত না
চাইতেই সুচারু শরীর
না চাইতেই হৃদয়।
কী নেবে নাও
কালের জন্য তুলে রেখো না।
কাল হয়ত লুঠ হয়ে যাবে আমার সকল সম্পদ
কাল হয়ত নষ্ট হবে শরীর
ঘুণে খাবে হৃদয়।
কাল হয়ত ঝরে যাবে তুমি, ঝরে যাব আমি।
খালি খালি লাগে
সেই যে গেলে, জন্মের মত গেলে
ঘর দোর ফেলে।
আমাকে একলা রেখে বিজন বনবাসে
কে এখন ভাল বাসে,
তুমি নেই, কেউ নেই পাশে।
কে এখন দেখে রাখে তোমার বাগান
তুমিহীন রোদুরে গা কারা পোহায়
কে গায় গান পূর্ণিমায়
তুমিহীন ঘরটিতে কি জানি কে ঘুমোয় কে জাগে।
জীবন যায়, যেতে থাকে
যেখানেই যাই যে পথে বা যে বাঁকে দাঁড়াই
যে ঘাটে বা যে হাটে, বড় খালি খালি লাগে।
জীবন
এই অস্তিত্ব
চপল চিত্ত, বোঝাই বিত্ত
নিত্য নৃত্য
অদৃশ্য
ভূত ভবিষ্যত অদৃশ্য
রম্য জীবন অদৃশ্য
এক পলকে অদৃশ্য
মহাজগতের শখের খেলা
হেলা ফেলায় মায়ার মেলা
জীবন-ভেলা
বেলা থাকতেই নিশ্চিহ্ন
এক মুহুর্তে নিশ্চিহ্ন
এই নৃত্য, বিত্ত, চিত্ত নিশ্চিহ্ন
ফুঃ মন্ত্রে স্নায়ুতন্ত্র
ছিন্ন ভিন্ন
নিশ্চিহ্ন
ঠিক তাই তাই চাই
একটি চমৎকার বাগানঅলা বাড়ির বড় শখ ছিল আমার,
ব্যাক্তিগত গাড়ির, এমনকি জাহাজেরাও, জলে ভাসার – ওড়ার।
ভালবাসার কারও সঙ্গে নিত্য সংসারের,
আমার সাধ্যের মধ্যে যদিও এখন সব , আমার সাধ্যের মধ্যে এখন আমার সুখী হওয়া
সুখকে বিষম ঘেন্না এখন
আমি এখন আমার জন্য এমন কিছু চাই না যা দেখলে আনন্দ হত তোমার–
আমার আর ইচ্ছে করে না সমুদ্রের সামনে দাঁড়াতে, তুমি ইচ্ছে করেছিলে একদিন দাঁড়াবে।
তুমি কিছু হারাচ্ছ না, এই দেখ আমার সারা গায়ে ক্ষত,
স্মৃতির তল থেকে তুলে আনছি। মুঠো মুঠো অচেতন মন,
অমল বৃষ্টি থেকে রংধনু থেকে চোখ সরিয়ে রাখি, এই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে বসে
ঠিক তাই তাই চাই, যা দেখলে কষ্ট পেতে, বেঁচে থাকায় ছোবল দিত কালনাগিনী,
আমি অসুস্থ হতে চাই প্রতিদিনই।
তাসের রাজ্য
খেলতে খেলতে সময় চলে যাচ্ছে
এ সময় কোনওদিন ভুল করে আমার জানালায় উঁকিও দেবে না জানি
যে যায়, সে যায়।
সময়ের মত তুমিও আর ফিরে আসো না, সেই যে গেছো।
নির্মাণ করেছি তাসের ঘর আমার তাসের রাজ্যে,
খেলার প্রতিটি জয় আমাকে অর্থহীন সুখ দেয়, তবু তো দেয়,
তুমিই দাওনি কোনও সুখ।
অর্থহীন জীবনের মত অর্থহীন খেলা আমার
অর্থহীন খেলতে খেলতে অর্থহীন মৃত্যুর দিকে ঝুঁকছি।
খেলতে খেলতে জীবন ফুরোচ্ছে জানি, এ জীবন ফুরোলেই কী না ফুরোলেই কী
তুমি তো আর ফিরবে না কোনও সুগন্ধী রজনীগন্ধা হাতে
তুমি তো আর জ্বালবে না আলো ঘোর আধার ঘরে
বাতিগুলো এক এক করে নিবিয়েই তো গেছে, সেই যে গেছো।
সেই কবে লোবান জ্বেলেছিলে ঘরে, কেবল ছাইটুকু পড়ে আছে,
আজও আমি বেড়ে ফেলিনি এক কনা ছাই,
তোমার স্পর্শ ছিল লোবানে, কী করে ফেলি, হোক না সে ছাই!
আমি তো পুড়েছি লোবানের মত কবেই
সেই ছাইটুকু যখন গেছো সঙ্গে নিয়ে গেছো,
ওটুকু তোমারও তো সূতি, ওটুকুই তোমার আমি।
তোমার শরীর, তুমি নেই
তোমার শরীর, তুমি নেই
একটু সরে শোও, পাশে একটু জায়গা দাও আমাকে শোবার
কত কথা জমে আছে।
কত স্পর্শ
কত মৌনতা, মুগ্ধতা।
সেই সব সুদূর পারের কথা শোনাব তোমাকে
শুনতে শুনতে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে,
কয়েক ফোঁটা কষ্ট তোমার উদাস দুচোখে বসবে
শুনতে শুনতে হাসবে, হাসতে হাসতে চোখে জল।
ভেবেছিলাম রোদেলা দুপুরে সাঁতার কাটিব হাঁসপুকুরে,
পূৰ্ণিমায় ভিজব, নাচব গাইব।
ভেবেছিলাম যে কথা কোনওদিন বলিনি তোমাকে, বলব।
এখন ডাকলেও চোখ খোলো না
স্পর্শকরলেও কাঁপো না,
এখন এপার ওপার কোনও পারের গলপাই তোমাকে ফেরায় না
নাগালের ভেতর তোমার শরীর, তুমি নেই।
দাঁড়াও সময়
দুদন্ড দাঁড়াও, হাতের কাজগুলো সেরে নি
সংসারের ঝামেলাগুলো,
কী এত কাজ? সে বলে শেষ হবে না, অনেক।
সে বলে শেষ হবে না, বরং অপেক্ষা করো।
তোমার সঙ্গে ঠিকই যাব ওখানে, ওখানে উৎসব হচ্ছে জানি,
ওখানে আকাশ তার লাজুক মুখ লুকোচ্ছে জলে, ওখানে লজ্জাবতীর শরীর থেকে সবগুলো রং
তুলে বিষম নাচছে প্ৰজাপতি
পাড়ার ফুলেশ্বরীর মত দৌড়ে যাচ্ছে গঙ্গা পদ্মা চুল উড়িয়ে
ওখানে সমুদ্র দুহাত বাড়িয়ে আছে উতল হাওয়ার দিকে
পাহাড়গুলো এক একটি দুষ্টু ঈশ্বরের মত
গাঙচিলগুলো অপ্সরীর পালক
সময় তুমি অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
পাথর-মত
মানুষ, মানুষের কাঁধে কাঁধে মানুষ পায়ে পায়ে কুকুর কাউকে চেনা লাগে না, না কুকুর, না মানুষ। অন্য কোনও গ্রহ থেকে নেমে আসা এরা বুঝি না, নাকি আমিই অন্য গ্রহের! নাকি আমারই এমন, আর কারও নয়, খালি খালি লাগে। গাছে পাতা ধরলেও মনে হয় ধরেনি ফুলগুলোকে মনে হয় ফুল নয় ঘাসে হাঁটছি অথচ ঘাসে হাঁটছি না, ঘাসগুলোকে পাথর-মত লাগে মেঘগুলোকে ঠিক মেঘ মনে হয় না চাঁদকেও চাঁদ না।
নিয়ন আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকি এক শরীর অন্ধকার
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পাথরের শরীর ফুঁড়ে ঢুকে যায় শেকড়।
আমিও, আমার কাছেই, দিনদিন অচেনা ঠেকছি
শহরটি বড় ধুসর ধুসর,
শহরের মধ্যিখানে ঘোলা জনের নদীটিও।
নদীটিই আমার আপন ছিল, আমার উদাস চুলে স্পর্শ দিত তার,
ফুলে ফুলে আমার জন্য কেঁদেছেও অনেক।
নদীটিকে সেদিন বলেছি, তোমাকে খুব পাথর-মত লাগে,
নদীও বলল আমার কানে কানে, আঁচল উড়িয়ে দিয়ে হু হু হাওয়ায়,
-তোমাকেও।