- বইয়ের নামঃ শিউলি বনে গন্ধরাজ
- লেখকের নামঃ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
শিউলি বনে গন্ধরাজ
অনেক ঘুরে, অ-নেক পরিশ্রমে যোগাড় করার ঝক্কি পোয়াতে হয়েছে। আর এখন? হাতের নাগালে, বলতে গেলে মুঠোর মধ্যে। কনাদ উপুড় হয়ে শুয়ে, বুকে বালিশ দিয়ে, অভ্যাস মতো বই খুলে পড়তে যায়। নীরদ সি. চৌধুরীর লেখা। মন বসাতে পারে না। এষার মুখটা মনে পড়ে। হাতটা সামনে রাখা গ্লাসটার দিকে এগিয়ে যায়। একসাথে কয়েকটা চুমুক।
সামনের চুলটা সেদিন বিশ্রি ভাবে কেটে এল এষা, অফিসের ক্যাশিয়ার বাবু প্রশান্তদার কাছে আসা সস্তা মেয়েটার মুখ আর এষার মুখের মধ্যে কোন তফাত খুঁজে পায়নি কনা। প্রতিবাদ করতেই এষা বলেছিল, কনাদের মতো বুড়োটে লোকের নাকি হাল ফ্যাশন সম্বন্ধে কোন আইডিয়াই নেই।
রগটা কি রকম দপদপ উঠল কনাদের। আরও দু ঢোঁক।
মধ্য চল্লিশ কনাদের সঙ্গে মধ্য ত্রিশ এষার বয়সের ব্যবধান সংখ্যার হিসাবে একযুগের কম হলেও দু-জনের চিন্তাভাবনা, মানসিক ব্যবধান দু যুগের।
অথচ প্রেমের প্রথম পর্বে-যদিও সে প্রেম ছমাসের বেশি স্থায়ী হয়নি—এষার মুগ্ধ হয়েনাদের কবিতা শোনা, বিস্ময়ে কনাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকা, কনাদকে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করতো। সরকারি চাকরি করা কনাদ তাই আর দেরি করেনি। ধুমধাম করেই বিয়ে করেছিল।
গ্লাসটা টেনে নেয় কনাদ।
প্রথম প্রথম কি সুন্দর ছিল দিনগুলো। অফিস থেকে ফেরার সময় এষার গ্রিল ধরে অপেক্ষা। কনাদ যেটা খেতে ভালোবাসতো তৈরি করে রাখা। স্কুটারে চেপে ছোট্টো স্নিগ্ধকে নিয়ে তিনজনে এদিক ওদিক হারিয়ে যাওয়া। কনাদ আর স্নিগ্ধর ভাল-মন্দ, সুখ-স্বাচ্ছন্দের দিকেই এষার সর্বদা নজর। স্নিগ্ধর সমস্ত ব্যাপার এষা একলাই সামলায়।
–যাও না, তুমি এ্যাকাডেমিতে বন্ধুদের সাথে নাটক দেখে এস।
–না, না, সে কি হয় নাকি? তুমি স্নিগ্ধকে নিয়ে একা থাকবে। তাছাড়া তোমার তো কোথাও যাওয়াও হয় না।
—পাগল? এইটুকু ছেলেকে নিয়ে আমি নাটক দেখতে যাব? তাছাড়া ঐসব আঁতলামি নাটক আমার ভালও লাগে না। তুমি যাও আমি কিছু মনে করব না।
কনাদ পূর্ণ দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকায়। এই তো জীবনসঙ্গী। কনাদের কবিতা লেখা, গান শোনা, গ্রুপ থিয়েটার দেখা কোন কিছুতেই এষা বাধা দেয় না, উৎসাহই দেয়।
কনাদ আবার গ্লাসটা টেনে নেয়। আসলে কিছুদিন পর থেকেই কনাদের সঙ্গে এষার কোনরকম সংঘাত না থাকলেও কোথায় যেন একটা বিরাট ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে। এষার ধরণটাই অন্য রকমের। কনাদের মতো অন্তমুখী নয়। পাড়ার প্রত্যেকের সঙ্গে ভীষণ মেলামেশা। আশপাশের প্রতিবেশী, ক্লাবের চ্যাংড়া ছেলে, মুদি, ফেরিওয়ালা সবাইয়ের ও বৌদি। আর ছোটদের কাকিমা। কনাদও এষার হাতে সংসারের দায়ভার ছেড়ে নিশ্চিন্ত। গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয়, পড়াশোনা, কবি সাহিত্যিক মহলে আচ্ছা, এল. টি.সি. নিয়ে যেখানে লোকে যায়না সেখানে বৌবাচ্ছা নিয়ে বেড়াতে যাওয়া দিব্যি চলছিল।
কনাদের চোখটা যেন কী রকম বুজে আসছে। গাড়োয়ালে দেবপ্রয়াগে এই হোটেলে আসতেই তো ধকল কম যায় নি। এক সেই পরশু হাওড়া থেকে ট্রেনে ওঠা। সকালে ঋষিকেশে নেমে আজকেই চলে আসা। বেড়ানোর আনন্দে আগেও এখানে এসেছে। তখন হিমালয়ের চপল গাম্ভীর্যে ঢুকে মন কখনও দাপাদাপি করতো, কখনও বা শান্ত তাপসের মতো সৌন্দর্যে অবগাহন করতো। কিন্তু এবারে? নিজের কাছে ভীষণ ভাবে হেরে গিয়ে পালিয়ে এসেছে ও। ওরা এখন কী করছে কে জানে। হয়তো এষার বাপের বাড়ির লোকেরা, হয়তো কণিষ্ক নামের ছেলেটা—আর ভাবতে পারে না কনাদ। শরীরটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে।
ঠক্ ঠক্ ঠক্। দরজায় আওয়াজ হয়।
–সাব, রাতকো কেসা খানা? বেয়ারার গলা।
—মেরা তবিয়ত ঠিক নেহি। রাতকো খানা মৎ দেনা। কাদের জড়ানো স্বর। পাহাড় কোলের ছোট হোটেলটা খারাপ নয়। আসলে ধর্মশালার বেটার সংস্করণ। কনা নিজের পরিচয় লিখিয়েছে, মাণিক সামন্ত। ১০, স্টেশন রোড, রামগড় ক্যান্টনমেন্ট। জেলা হাজারিবাগ, ঝাড়খণ্ড।
খুঁজুক না। যত খুশি খুঁজুক। হাওড়ার কাসুন্দিয়ার বাড়িতে বসে এষা, সম্বন্ধী ঋতুদা, শ্বশুরমশাই কিংবা কণিষ্ক-ও, কেউ খুঁজে পাবে না।
আচ্ছা, এষা কেন অন করতে গেল? এষা যেমন কনাদের ব্যাপারে মাথা ঘামাত না, কাদও এষার স্বাধীনতায় হাত দিত না। তবে, দুজনের একটা অলিখিত চুক্তি ছিল। ওরা কেউই বিশ্বাস ভাঙবে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনের শাশ্বত যে সম্পর্ক—সেটা অটুট রাখবে। কনাদ ব্যাপারটা ভীষণভাবে মেনে চলত। এষা সেটা পরীক্ষা করে দেখেছে স্বীকারও করতো।
ছেলের সুইমিং ক্লাব, আঁকা শেখা, ক্রিকেটার তৈরির কারখানা, ছেলের বন্ধুর মা বাবার সঙ্গে পড়াশোনার বিষয়ে লেনদেন, চুল কাটাতে নিয়ে যাওয়া স্ব দায়িত্ব এষার। এষা এ কাজ ভালও বাসতো। সময়ে সময়ে আত্মপ্রসাদ লুকিয়ে দুষ্টু চোখে। বলতে ছাড়তে না।
—ছেলেটা তো আমার। ব দায়িত্বও আমারই।
ছেলেও মার অন্ধ ভক্ত। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা ভালবাসা, অনেকটা সম্রম, বেশিটা লজ্জা। শখ আবদার ব মায়ের কাছেই।
স্নিগ্ধ এখন এইটে পড়ে। লম্বা, সুন্দর, একমাথা চুল। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল। আসলে ভাল হবে নাই বা কেন? কণিষ্ক ওকে ভীষণ ভাবে কেয়ার নেয়। কণিষ্ক—এবারে একসঙ্গে তিন–চারখানা।