একজন পাদরীর কর্তব্য হিসেবে আমি ওর পাশে বসে এই অবস্থায় যা বলা উচিত তাই বললাম। ঝোঁকের মাথায় মানুষ অনেকসময় নিজেরই চরম ক্ষতি করে ফেলে। তখন বুঝতে পারে না কিন্তু সারাজীবন তার খেসারত দেয়। ওকে নিষেধ করলাম যেন এমন কিছু করে না ফেলে।
আমার কথা কতদূর বুঝতে পারল বা মানল বোঝা গেল না। একসময় ও উঠে দাঁড়াল। আমাকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর চলে গেল। আমি তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এই মহিলাটিকে এতদিন আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। তার চরিত্রের ভুল ব্যাখ্যা করেছি। আজ জীবন থেকে বঞ্চিত যন্ত্রণাকাতর এবং মরিয়া একটি মানুষকে দেখতে পেলাম।
লরেন্সকে ও পাগলের মত ভালবেসেছে। অথচ লরেন্স কিন্তু তার চাইতে বয়সে বেশ কয়েক বছরের ছোট।
.
০৩.
একদম ভুলে গিয়েছিলাম যে লরেন্স রেডিং সেই রাত্রেই আমাদের এখানে নৈশভোজে আমন্ত্রিত। অনুমান হল সে আসবে না। পরে হয়তো কোন একটা অজুহাত দেবে।
কিন্তু না, লরেন্স এলো এবং আমরা চারজনে একসময় খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম।
এইবেলা তার দিকে একটু অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকালাম। রীতিমত আকর্ষণীয় পুরুষ। বয়স আন্দাজ তিরিশ ছুঁয়েছে। চকচকে নীল চোখে খুশির ঔজ্জ্বল্য। সর্বদা হাস্যময়।
আমার ধারণা ওর শরীরে আইরিশ রক্ত প্রবহমান।
লক্ষ্য করছিলাম, কথাবার্তা বলতে বলতে লরেন্স মাঝে মাজেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল।
ডিনারের পর লরেন্স পড়ার ঘরে আমার কাছে এসে বসল। আমাকে সরাসরি বলল, আমাদের ব্যাপার তো আপনার কাছে আর লুকনো নেই। এখন এ ব্যাপারে আপনি কি করতে চাইছেন?
লরেন্স পুরুষমানুষ। কোনরকম দ্বিধা না করে আমার বক্তব্য পরিষ্কার ভাবেই জানালাম।
সবশেষে বললাম, গ্রামের মানুষজন চুপ করে থাকবে না, তাদের চোখ কান যেমন সজাগ তেমনি মুখেরও আগল নেই। ওদের দুজনেরই জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
লরেন্স সবকথাই চুপ করে শুনল। আমার সবকথাই যে ঠিক তা সে স্বীকার করল।
পরে বলল, এটা যদি একটা নাটক হত, তাহলে ওই বুড়োটা নির্ঘাৎ মারা পড়ত। আর সকলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচত।
বললাম, এসব কথা তোমার ভাবা বা বলা উচিত নয়।
লরেন্স বলল, আমি একথা বলতে চাইছি না যে বুড়োটাকে আমি খুন করব। তবে যদি কেউ এই কাজটা করে আমি অবাক হব না। কেননা, ওই বুড়োকে কোন মানুষই সহ্য করতে পারে না।
একটু থেমে পরে আবার বলল, বুড়োর দ্বিতীয় বউ তাকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মহিলা এমনই চাপা স্বভাবের যে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।
আপনি অনুমান করতে পারবেন না অ্যানা কিরকম মরিয়া হয়ে উঠেছে। যে কোন সময় ও যা খুশি করে বসতে পারে।
একমুহূর্ত থেমে কি চিন্তা করল। পরে বলল, আমার যদি সামর্থ্য থাকত তাহলে ওকে নিয়ে আমি এখান থেকে চলে যেতাম।
লরেন্সের কথায় আসন্ন একটা ঝড়ের আভাস পাওয়া গেল। শান্তভাবে বললাম, লরেন্স, আমার মনে হয় এই মুহূর্তে তোমার সেন্ট মেরী মিড ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তা না হলে মিসেস প্রথেরো বড় বেশি অস্থির হয়ে পড়বে।
ব্যাপারটা একদিন মিঃ প্রথেরোর চোখেও ধরা পড়ে যাবে। লোকের কানাঘুষাও কানে যাবে। তখন একটা অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটবে।
এরপর আর বেশি কথা হল না। আমার কথা ভেবে দেখবে, এ কথা জানিয়ে লরেন্স বিদায় নিল।
.
পরদিন প্রাতরাশের পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিছু রুগীকে দেখে ওষুধ দেবার ব্যাপার ছিল। গ্রীসলডা ট্রেনে করে লণ্ডন চলে গেল।
ভিকারেজে ফিরে এলাম বেলা সোয়া চারটে নাগাদ। ঢুকতেই মেরী জানাল, মিঃ লরেন্স আমার জন্য পড়ার ঘরে অপেক্ষা করছে।
পড়ার ঘরে এসে দেখলাম সে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। মুখ শুকনো।
পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, আপনাকে কয়েকটা কথা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছি। সারারাত চোখে ঘুম ছিল না।
আপনার কথা ভেবে দেখলাম আপনি ঠিকই বলেছেন।
বলতে বলতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পরে বলল, আমি স্থির করেছি, অ্যানার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে আমি এখান থেকে চলে যাব।
-খুব ভাল কথা। আমি যা বুঝতে পারছি, তুমি এখানে থাকলেই ওর বিপত্তি বাড়বে।
-হ্যাঁ। আমি নিজেও বুঝতে পারছি। আপনাকে কেবল একটা অনুরোধ করব, অ্যানাকে দেখবেন।
আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।
আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লরেন্স বলল, আজ রাতেই সব গোছগাছ করে রাখব আমি যাতে কাল সকালেই এখান থেকে চলে যেতে পারি। অ্যানার সঙ্গেও দেখা করব আজ সন্ধ্যাবেলা। আঁকার কাজের জন্য আপনি এখানে আমাকে একটা ঘর দিয়েছিলেন, তার জন্য ধন্যবাদ। কেবল মিস ক্লেমেন্ট-এর ছবিটা সম্পূর্ণ করে উঠতে পারিনি।
–সে আর কি করা। ও নিয়ে ভেবো না। ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন।
লরেন্স রেডিং ঘরথেকে বেরিয়ে গেল।
.
০৪.
ভিকারেজে ফিরতে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে গেল। দরজা খুলে ঢুকতে যাব এমন সময় লরেন্স ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল।
তার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হতে হল। উদ্ভ্রান্ত মানুষের চেহারা পুরোপুরি। ভেতরে যেন তোলপাড় চলছে। কেমন যেন কাঁপছে।
বললাম, তুমি এসেছিলে? একটা কাজে একটু প্রথেরার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
-প্রথেরার সঙ্গে! আমার কথা কেড়ে নিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল লরেন্স।
পরে বলল, আপনি দেখা করতে গিয়েছিলেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখা করুন।
কেমন অসংলগ্ন কথাবার্তা। কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, তা চলে যাচ্ছ কেন, এসো