নির্দিষ্টভাবে কথাবলার প্রসঙ্গ কিছুই ছিল না। বই, ছবি, পুরনো দিনের চার্চের কথা–এসব নিয়েই খানিকক্ষণ টুকরো টুকরো গল্প হল। এর মধ্যেই আমার কেন যেন মনে হল, ও আমাকে কিছু বলতে চায়।
কিন্তু কিছুই বলল না। আমি একসময়ে উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে আমি একপলক তাকালাম ওর চোখের দিকে। একমুহূর্ত ইতস্তত করে বললাম, আপনার জন্য কিছু করতে পারলে খুশি হব।
ও যেন আমার এই কথাটার জন্যই অপেক্ষা করেছিল। বলল, আপনার অনেক দয়া। কিন্তু এমন এক জটিল ব্যাপারে জড়িয়ে আছি, মনে হয় না আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারে। তবু আপনি যে সাহায্য করতে চেয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।
বুঝতে অসুবিধে হল না, ও দ্বিধা কাটিয়ে উঠে নিজের সম্পর্কে এই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছে। আমাকে তার আর কিছু বলার নেই।
মিস লেসট্রেঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে নামলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি মিস হার্টনেল এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বলল, দেখলাম লেসট্রেঞ্জের বাড়ি থেকে বেরুলেন। কিছু জানতে পারলেন?
-কি ব্যাপারে? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম।
–ওই রহস্যময়ী লেসট্রেঞ্জ সম্পর্কে? ও কি সত্যিই বিধবা, নাকি স্বামী বাইরে কোথাও থাকে?
মহিলার কৌতূহল অশোভন ঠেকলেও বিস্মিত হলাম না। গ্রামের এসব মহিলার অপরের সম্পর্কে মাত্রাছাড়া কৌতূহল সম্পর্কে আমি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল।
বললাম, এসম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না। এসব কোন কথা উনি আমাকে বলেননি।
ডাক্তার হেডকের সঙ্গে ওর কি অনেক দিনের পরিচয়?
–মাপ করবেন, বলতে পারব না।
মিস হার্টনেল একমুহূর্ত কি ভাবল। কিছু গোপন করছি কিনা সম্ভবত তা আন্দাজ করবার চেষ্টা করল।
আমি তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবার সুযোগ না দিয়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম।
.
গেট খুলে ভিকারেজে ঢুকতে গিয়ে মনে হল লরেন্স রেডিং-এর স্টুডিওটা একবার ঘুরে যাওয়া যাক। গ্রীসলডার ছবি কতটা এগিয়েছে জানা যাবে।
স্টুডিওতে বাইরের কোন লোক থাকতে পারে আমার ধারণা ছিল না। তাছাড়া কথাবার্তার শব্দও কিছু পাইনি। আর ঘাসের ওপর দিয়ে আমার চলাচলও ছিল নিঃশব্দ।
কবাট ঠেলে ভেতরে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হল। দুজন নারীপুরুষ পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে চুম্বনরত।
পলকের দেখাতেও চিনতে ভুল হল না। একজন ছোকরা শিল্পী লরেন্স। অপরজন কর্নেল প্রথেরোর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী।
সাড়াশব্দ না করে নিঃশব্দে পা ফেলে নিজের পড়ার ঘরে ফিরে এলাম।
একটা অস্বস্তিকর মানসিক অবস্থা। এমন একটা অবৈধ সম্পর্ক আবিষ্কার আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল।
ব্যাপারটা আমার কাছে আঘাত হিসেবেই এল। কেন না আজ বিকেলেই লেটিস এসে কিছুক্ষণ বকবক করে গেছে।
যেরকম ঘনিষ্ঠতা ওদের দেখা গেল তাতে বুঝতে পারছি ভদ্রমহিলার সঙ্গে ইতিমধ্যেই একটা বোঝাঁপড়া গড়ে উঠেছে। সত্যায়ের সঙ্গে লরেন্সের এই সম্পর্কের কথা লেটিস নিশ্চয়ই জানে না।
মিসেস প্রথেরো এমন একটা অবৈধ প্রণয়ের সঙ্গে জড়িত; চোখে দেখেছি বলেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে না। নানান রকম চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করতে লাগল।
মিসেস প্রথেরো আচমকা ঘরে ঢুকলেন। তাকে দেখে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। হাসবার চেষ্টা করে সোফায় বসতে বললাম।
তাকালাম মুখের দিকে। চোখ নামিয়ে নিল। মুখ ফ্যাকাশে। ঠোঁট শুকনো। এ যেন খানিক আগে দেখা মিসেস প্রথেরো নয়।
কয়েক মুহূর্ত নীরবে বসে রইল। মনে হল মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করল। তারপর মুখ তুলে বলল, সরাসরি আপনার কাছে চলে আসাটাই ভাল মনে হল। আপনি আমাদের দেখে ফেলেছেন…
আমি নীরবে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও বলতে লাগল, আমরা পরস্পরকে ভালবাসি। বলে পাথরের মূর্তির মতই বসে রইল।
আমি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমার কাছ থেকে কোন ভৎর্সনা আশা করছেন?
-না, তা নয় মিঃ ভিকার।
–আপনি একজন বিবাহিত মহিলা।
–আমি তা ভালরকমেই জানি। তবে আমি উচ্ছঙ্খল নই, আপনি যা ভাবছেন তা ঠিক নয়।
–তা যদি না হয়, আমি আনন্দিত হব।
–বিশ্বাস করুন মিঃ ভিকার, অসুখী মানুষের যন্ত্রণা বড় ভয়ানক। আমি আর পেরে উঠছিলাম না। মুক্তির একটা পথ হাতড়ে মরছিলাম।
বলতে বলতে মিসেস প্রথেরো থামল। তার ঠোঁট কাঁপছে। চোখের পাতা ঘন হয়ে উঠছে।
সহসা যেন সজাগ সচকিত হয়ে উঠল, এভাবে বলে উঠল আমার জীবনের যন্ত্রণার ইতিহাস কেউ জানে না।
বিয়ের প্রথম দিন থেকেই লোকটার সঙ্গ আমার কাছে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে। কোন মেয়েই এমন লোকের সঙ্গে থেকে সুখী হতে পারে না।
আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না আমার ভেতরের অস্থিরতা। আমি মনে প্রাণে চাইছি লোকটা মরে গিয়ে আমাকে মুক্তি দিক। ভালমন্দের কথা জানি না, তবু আমি তাই চাইছি…আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি।
কথা বলতে বলতে মিসেস প্রথেরো দরজার দিকে ঘাড় ফেরালেন। বললেন, মনে হল কারো পায়ের শব্দ…সম্ভবত লরেন্স…
মৃদু একটা শব্দ আমার কানেও পৌঁছেছিল। আমি উঠে ঘরের বাইরে গেলাম। নিচে বাগানের দিকে তাকালাম। কিন্তু কাউকে কোথাও চোখে পড়ল না।
ঘরে ফিরে এলাম। মিসেস প্রথেরো নিচু হয়ে কপালে হাত দিয়ে বসেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বুঝতে পারছি না কি করব। আমাকে বলে দিন…