-হ্যাঁ, এটা তাকে যাচাই করার মোক্ষম ফঁদ। বললেন ইনসপেক্টর, তবে ডাক্তার হেডককে নিয়ে সন্দেহ আছে, তিনি কি এতে রাজি হবেন?
খানিক দূরেই বসেছিলেন ডাক্তার। আমি তার দিকে তাকালাম। মনে হল আমাদের মধ্যে মিস মারপলকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। তাকে খুব ক্লান্তও দেখাচ্ছিল।
ইনসপেক্টর ডাক্তারের দিকে ফিরে বললেন, আমরা কি নিয়ে কথাবার্তা বলছি, আপনি নিশ্চয় শুনেছেন।
এর পর মিস মারপলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ পরিকল্পনার কথাটা তাঁকে জানালেন।
সব শুনে ডাক্তার বললেন, প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ুক সেটা অবশ্যই আমি চাই। হতভাগা হসটার জন্যই আমি ভাবিত। জীবনটাকে কাপুরুষের মত উড়িয়ে দিল।
এর পর ইনসপেক্টর পরিকল্পনা মত যোগাড়যন্ত্র করতে তৎপর হয়ে পড়লেন। মিস মারপল উঠলেন। আমি তাকে এগিয়ে দেবার জন্য ফাঁকা রাস্তা পর্যন্ত বেরিয়ে এলাম। রাত তখন বারোটা।
.
২১.
এই গল্পের আর সামান্যই বাকি আছে। মিস মারপলের পরিকল্পনা যথাসময়েই কার্যকরী করা হয়েছিল এবং সফলও হয়েছিল। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে লরেন্স রেডিং নির্দোষ ব্যক্তি নয়।
তাকে ফোন করে জানানো হয়েছিল যে হস-এর ক্যাসেটের ক্যাপসুল বদল করার ব্যাপারটা একজনের চোখে পড়ে গেছে। শুনেই, মিস মারপল যেমন বলেছিলেন, তেমনি বোকার মত একটা কাজ করতে এগিয়ে এসেছিল।
আমার কল্পনাশক্তি দিয়েই পরের ঘটনাগুলো কি হতে পারে বুঝতে পারি। ফোন পেয়েই লরেন্স খুন করে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। তবে তার আগে সে মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে দেখা করবে ঠিক করে।
সেই রাতেই ওল্ড হল-এ ছুটে যায় সে। সেই সময় ইনসপেক্টরের দুজন অফিসারও যে তাকে আড়াল থেকে অনুসরণ করে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না।
জানালা দিয়ে নূড়ি ছুঁড়ে মিসেস প্রথেরোকে জাগায় লরেন্স। ফিসফিসিয়ে তাকে বলে বাইরে আসার জন্য। লেটিসের জেগে থাকার ভয়ে ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলাই নিরাপদ মনে করে।
তারা যখন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, অনুসরণকারী অফিসার দুজন আড়াল থেকে সবই শুনে নিয়েছিল। মিস মারপলের প্রতিটি হিসেব এভাবেই মিলে গিয়েছিল।
এর পর লরেন্স রেডিং এবং মিস প্রথেরোর বিচার যথারীতি জনগণের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। ওপ্রসঙ্গে আমি কিছু আর বলতে চাই না। আমি কেবল এটুকুই উল্লেখ করতে চাই যে এই মামলার সমস্ত কৃতিত্বটুকু দখল করেছিলেন ইনসপেক্টর মেলচেট। যার উৎসাহ আর বুদ্ধিমত্তা অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সুযোগ করে দিয়েছিল সেই মিস মারপলের ভাগ্যে কৃতিত্বের ছিটেফোঁটাও জোটেনি। এই ঘটনায় খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন মিস মারপল।
বিচারের ঠিক আগের দিন লেটিস এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে আমার সামনে চেয়ারে বসে সে বলেছিল, সৎমায়ের এই অধঃপতনের কথা সে জানত। বলেছিল, আমি তাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতাম।
আমি লেটিসকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখন কি করবে?
লেটিস শান্ত কণ্ঠে বলল, সব যখন শেষ হবে আমি বিদেশে চলে যাব। আমার মায়ের সঙ্গেই যাচ্ছি।
চমকে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। লেটিস বলল, আমার মা কে হতে পারে নিশ্চয় বুঝতে পারছ না তুমি? তোমরা যাঁকে মিস লেসট্রেঞ্জ বলে জান তিনিই আমার মা। সকলে জানে অবশ্য আমার মা মৃত। আমিও তাই জেনে এসেছি।
একমুহূর্ত থেমে সে আবার বলল, মা আমাকে দেখতে এসেছিল। সেজন্যই তাকে অন্য নাম দিতে হয়েছিল। ডাক্তার হেডক অবশ্য তাকে সাহায্য করেছিলেন। উনি মায়ের পুরনো বন্ধু ছিলেন। একসময়ে মায়ের প্রতি ডাঃ হেডকের দুর্বলতা ছিল।
যাইহোক, সেদিন রাতে মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। জানিয়েছিল, মরার আগে তার কিছু জিনিস আমাকে দিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমার বাবা ছিল একটা জানোয়ার। বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছিল আমার ওপর তার কোন অধিকার নেই।
লেটিস থামল। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল যেন কোন কেতাবী গল্প শুনছি।
লেটিস বলতে লাগল, বাবা নিষ্ঠুরের মত তাড়িয়ে দিয়েছিল মাকে। কিন্তু তবু ভেঙ্গে পড়েনি মা। আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। টেনিস খেলা শেষ হবার পর সাড়ে ছটায় আমি মার সঙ্গে রাস্তায় দেখা করলাম। কিন্তু বেশি কথা বলার সুযোগ ছিল না।
.
পরে বাবা খুন হবার পর ভীত হয়ে পড়লাম। বাবার প্রতি মায়ের তো একটা বিদ্বেষ ছিলই। সেই জন্য মাকে যাতে সন্দেহের মধ্যে পড়তে না হয় সেজন্য একদিন রাতে চিলেকোঠায় উঠে মায়ের ছবিটা এমনভাবে কেটেকুটে দিলাম যাতে কেউ চিনতে না পারে। আমার আশঙ্কা ছিল, পুলিস ওই ছবির খোঁজ পেলে তারা মাকে চিনে ফেলবে। ডাঃ হেডকও খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন।
কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে থামল লেটিস। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাকে। লেটিস বলতে লাগল মা আর আমার মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু তেমন সম্পর্ক আমার বাবার সঙ্গে ছিল না। যাই হোক, আমি মায়ের সঙ্গে বিদেশে চলে যাচ্ছি, তার সঙ্গেই থাকব এখন থেকে।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল লেটিস। তার চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি ফুটে উঠল। আমি তার হাত টেনে নিয়ে বললাম, ঈশ্বর তোমার মার মঙ্গল করুন। আশা করি তোমরা একদিন সুখী হবে।
–আশীর্বাদ করো তাই যেন হয়।