নাঃ বক্তৃতাটা লিখতে গিয়ে বড় বাধা পড়ছে। লেটিস যেতে না যেতেই সে এসে হাজির হল। প্রথেরোর সঙ্গে কালকের হিসেবনিকেশে বসার কথাটা জানতে চাইল।
দু-চার কথাটা সংক্ষেপে বলে ওকে বিদেয় করলাম। তারপর চটপট লেখাটা শেষ করলাম। সাড়ে চারটে নাগাদ পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এলাম।, দেখলাম গ্রীসলডার চায়ের আসরের তোড়জোড় চলছে। ইতিমধ্যেই চারজন অতিথি এসে। হাজির হয়েছে।
গ্রীসলডা চায়ের টেবিলের পেছনে চেয়ারে বসে তাদের সঙ্গে গল্প করছে।
উপস্থিত সকলের সঙ্গেই আমি সম্ভাষণ বিনিময় করলাম। তারপর মিস মারপল আর মিস ওয়েদারবাই-এর মাঝখানের চেয়ারে গিয়ে বসলাম।
গ্রীসলডা কৌতুকহাস্যে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছ, ডঃ স্টোন আর মিস ক্রেম-এর কথা?
–কি হল ওদের? জানতে চাইলাম আমি।
জবাব দিলেন মিস ওয়েদারবাই। গ্রীসলডার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওর মত সুন্দরী মহিলার একজন অবিবাহিত পুরুষের সেক্রেটারীর কাজ নেওয়াটা কিছুতেই ঠিক হয়নি।
আমি বললাম, তা কেন, মেয়েরা আজকাল ছেলেদের মতই কাজ করতে পারে।
এর পর অনিবার্যভাবেই আধুনিকতার হালচাল নিয়ে একটা ছোটখাট আলোচনা শুরু হয়ে গেল।
একসময় আমার স্ত্রী বলল, আসলে একটা অভিনব কিছু করার ইচ্ছেতেই মিস ক্ৰেম ডঃ স্টোনের সেক্রেটারীর কাজটা নিয়েছে।
আমাদের দুজনের কথাই দেখলাম অন্য চার মহিলার মনঃপুত হল না।
সব শেষে মিস মারপল আমার স্ত্রীর পিঠে আলতো করে চাপড় দিয়ে বলল, তুমি ভাই বড় সরল। অবশ্য কমবয়সী মেয়েদের মন এমনিই সরল হয়।
গ্রীসলডা সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, সরলতার প্রশ্ন নয়, ব্যাপারটা বাস্তবতার। তুমি কি সত্যি সত্যি ভাবছো, ওরকম টেকো মাথার বেরসিক লোককে মিস ক্রেম বিয়ে করে বসবে?
মিস মারপল বলল, লোকটা কেবল বেরসিক নয়, বদমেজাজীও। কদিন আগেই তো কর্নেলের সঙ্গে একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেল।
মিস ওয়েদারবাই বলল, ওই ছোকরা শিল্পী রেডিং-এর কথা শুনেছো তো; কি একটা গোলমালে কর্নেল নাকি তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে?
মিস মারপল মাথা নেড়ে মিস ওয়েদারবাইকে সমর্থন করল। বলল, লোকটা লেটিসের স্নানের পোশাকে ছবি আঁকতে গেছিল।
–আমার মনে হয় ওদের দুজনের মধ্যে লটঘট কিছু আছে। মিস প্রাইম রিডলে বলল, ওই শিল্পী ছোকরা ওই বাড়িতে ঘুরঘুর করে।
একটু থেমে ফের বলল, মেয়েটারই বা কি দোষ, জন্ম থেকে মায়ের স্নেহ পায়নি, বাপ তো ওই রকম গোঁয়ার গোবিন্দ। সম্মা আর কতটা হবে সেতো বুঝতেই পারছ। ছোকরার সঙ্গে না ঘেঁষে আর কি করে।
মিস ওয়েদারবাই বলল, তবে যাই বল শিল্পী ছোকরাকে দেখতে কিন্তু চমৎকার।
মিস হার্টনেল বলল, শিল্পীটিল্পীরা বরাবরই নারীঘেঁষা হয়। ওদের স্বভাব-চরিত্র ভাল হয়। না।
প্রাইস রিডলে বলল, তা না হলে কি আর স্নানের পোশাকে ছবি আঁকতে চায়।
–আমাকেও তো সে এঁকেছে। আমার স্ত্রী বলল।
মিস মারপল তার দিকে কটাক্ষ করে বললে, এঁকেছে, তবে নিশ্চয় স্নানের পোশাকে নয়।
গ্রীসলডার ভাষায় এই হল তাদের পরচর্চার আসর। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে নির্ভুল।
বড্ড একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। উঠব উঠব মনে করছি। বলতে একদম ভুলে গেছি। ডাক্তার হেডককে মিস লেসট্রেঞ্জের ঘর থেকে বেরুতে দেখলাম।
কথাটা শুনে ওরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল।
মিস প্রাইস রিডলে বলল, তাহলে অসুখ-বিসুখ কিছু করেছে।
-তাহলে হঠাৎ করেই কিছু হয়েছে। আমি তো আজ বিকেল তিনটে নাগাদও ওকে বাগানে বেড়াতে দেখেছি। কই দেখে তো অসুস্থ বলে মনে হয়নি।
ডাক্তার আর লেসট্রেঞ্জ মনে হয় পূর্বপরিচিত। বলল মিস প্রাইস রিডলে।
–ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক। মিস ওয়েদারবাই ফোড়ন কাটল।
গ্রীসলডা সামনের দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল, আমি জানতে পেরেছি একজন মিশনারীর খপ্পরে ও পড়েছিল। কোন কিছুই আর বাকি রাখেনি–বউ করতে চেয়েছিল। শেষে ডাক্তার নাকি ওকে উদ্ধার করে।
সঙ্গে সঙ্গে ওদের আলোচনা বেশ সরস হয়ে ওঠে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ পরচর্চার আসর একসময় ঝিমিয়ে এলো। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে মিস ওয়েদারবাই বলল, তবে যাই বল ভাই, লরেন্স রেডিং-এর সঙ্গে লেটিস থেরোর সম্পর্ক অনেকদূর অবধি গড়িয়েছে। তুমি কি বল মারপল? গ্রামের কিছুই তো তোমার অজানা থাকে না।
মিস মারপল একমুহূর্ত কি ভাবল। পরে ধীরে ধীরে বলল, আমার ধারণা লেটিস নয়, যদি ওই ছোকরার সম্পর্ক হয়েই থাকে তবে সে সম্পূর্ণ অন্য কেউ।
.
০২.
খানিক পরেই আমি চর্চা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথে নামতেই মিস লেসট্রেঞ্জের সঙ্গে দেখা হল। দুজনে গল্প করতে করতে চলতে লাগলাম।
বাড়ির কাছে পৌঁছলে ও অনুরোধ জানাল তার বাড়ি যেতে। আমি আপত্তি করলাম না। দুজনে বাড়ির ভেতরে গেলাম।
কিছুদিন আগে লেসট্রেঞ্জ এই সেন্ট মেরী মিড-এ এসেছে। এখন দেখছি পাকাপাকি ভাবেই রয়ে গেছে।
বুঝতে পারি না ওর মত একজন সুন্দরী আধুনিকা এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে কেন। ওর পক্ষে এই পরিবেশ নির্বাসন ছাড়া কিছুই নয়।
বসার ঘরে পরিষ্কার আলোয় এই প্রথম ওকে সামনাসামনি এত স্পষ্ট করে দেখার সুযোগ পেলাম। ওকে কেবল সুন্দরী বললে কমই বলা হয়। দীর্ঘাঙ্গী, স্বর্ণকেশী। চোখের পাতা ভ্র গভীর কালো ডাগর আয়ত নীল চোখ দুটোকে মায়াময় করে রেখেছে। মুখের ডৌলটিও এককথায় নিখুঁত।