তবে না মানলেও আমার কিছু যায় আসে না। তবে কর্তব্যজ্ঞানেই আমি আমার ভাবনার কথা প্রকাশ করছি।
কথা শেষ করে থামলেন মিস মারপল। চুপ করে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। মনে হয় মনে মনে ঘটনাগুলো সাজিয়ে নিলেন।
-খুনের ঘটনার রহস্য নিয়ে আমি নিজে যে ভাবে ভেবেছি তা এইরকম, মিস মারপল বলতে শুরু করলেন, এই খুনটার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাত্রেই। লরেন্স জানত ভিকার নেই, তবু সে ভিকারের সঙ্গে দেখা করার অছিলা নিয়ে ভিকারেজে আসে। সেই সময় পিস্তলটা সে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল। ফাঁকা লাইব্রেরী ঘরে ঢুকে সে পিস্তলটা জানালার একপাশে লুকিয়ে রেখে দেয়।
ভিকার ফিরে এলে লরেন্স তাকে জানায় যে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখান থেকে চলে যাবে।
এর পর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ লরেন্স নর্থলজ থেকে মেয়েলি গলা নকল করে ভিকারকে ফোন করে।
একটু থেমে গায়ের শালটা ঠিক করে নিলেন মিস মারপল। আমরা যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। নিঃশব্দে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এ তো গেল একদিকের কথা। এবারে অপর দিকটা দেখা যাক। মিঃ এবং মিসেস প্রথেরো গাড়ি করে গ্রামের দিকে বেরিয়ে ছিলেন।
তখন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করবার মত ছিল। মিসেস প্রথেরো বেরোবার সময় কোন হাতব্যাগ সঙ্গে নেননি। কোন মহিলা বাইরে বেরুবার সময় হাতব্যাগ সঙ্গে নেয়নি, এ ঘটনাটা যে খুবই অস্বাভাবিক নিশ্চয় আপনারা তা স্বীকার করবেন।
যাই হোক, মিসেস প্রথেরো আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যখন যায় তখন সময় ছটা বেজে কুড়ি মিনিট।
সে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে গল্পও করে। সঙ্গে কোন অস্ত্র যে নেই এটা আমাকে বোঝাবার জন্যই সে এটা করেছিল। আমার দৃষ্টি যে খুব প্রখর তা তার অজানা ছিল না। তাই পরিকল্পনা করেই ব্যাগছাড়া বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।
এরপর ভিকারেজের বাড়িটা ঘুরে লাইব্রেরী ঘরের পেছনে জানলার দিকে চলে যায়। সে জানত পিস্তলটা কোথায় আছে। সেটা তুলে নেয়।
কর্নেল প্রথেরো সেই সময় লাইব্রেরী ঘরে লেখার টেবিলে বসেছিলেন। ভিকারকে উদ্দেশ্য করে কিছু লিখছিলেন।
আপনারা তো জানেন কর্নেল খানিকটা কানে খাটো ছিলেন। সেই কারণেই তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর স্ত্রী কখন পিস্তল হাতে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
অ্যানা প্রথেরো নির্ভুল নিশায় মাথায় গুলি করে। তারপর পিস্তলটা সেখানেই ফেলে রেখে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। দ্রুতপায়ে বাগানে চলে আসে সে। স্টুডিও ঘরে লরেন্সের সঙ্গে তার দেখা হয়। দুজনে ঘরে ঢুকে যায়।
অ্যানা প্রথেরো যথেষ্ট চতুর। সে জানত আমি বাগানে রয়েছি। আর যতক্ষণ ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে না আসে স্বাভাবিক কৌতূহলের বশেই আমি যে বাগান ছেড়ে নড়ব না তা-ও সে বুঝতে পেরেছিল।
কিছুক্ষণ পরেই ওরা স্টুডিও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের হাবভাব বা ভঙ্গিতে কোনরকম অস্বাভাবিকতা ছিল না। উৎফুল্লভাবেই তারা কথাবার্তা বলছিল।
এ পর্যন্ত সবই ছিল নিখুঁত। কোথাও দৃষ্টিকটু কিছু ছিল না। কিন্তু এর পরেই ওরা পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে চলে না গিয়ে প্রথম ভুলটা করে বসল। স্বাভাবিক দুর্বলতার বশেই খুবই দৃষ্টিকটু ব্যাপার ওরা করে ফেলে।
নিজেদের নির্দোষ দেখাবার জন্য যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গেই ওরা কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গী বজায় রেখে চলছিল।
মিনিট দশেক পরেই লরেন্স হঠাৎ ভিকারেজে ঢুকে পড়ে। সম্ভবত সে দূর থেকেই ভিকারকে আসতে দেখেছিল।
লাইব্রেরী ঘরের মেঝে থেকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা কুড়িয়ে পকেটে চালান করে দেয়। অন্য কালিতে অন্য হাতে লেখা জাল চিঠিটা তার সঙ্গেই ছিল। সেটা টেবিলের ওপরে রেখে দেয়।
এই সময়েই অপ্রত্যাশিতভাবে তার নজরে পড়ে যায় মিঃ প্রথেরোর ভিকারকে লেখা চিঠিটা। সেটা পড়েই সে বুঝতে পারে, ভবিষ্যতে চিঠিটা তার কাজে লাগতে পারে। লরেন্স অসাধারণ বুদ্ধিমান, সঙ্গে সঙ্গে সে চিঠিটা পকেটে পুরে নেয়। তারপর আধঘণ্টা ফার্স্ট চলে ঘড়িটা জেনেও ত্রস্ত হাতে কাটা সরিয়ে দেয়।
ঠিক সময় হিসাব কষেই ঘর থেকে বেরিয়ে লরেন্স ভিকারেজের সদর দরজার দিকে বেরিয়ে যায় যাতে ভিকারের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। নির্ভুল হিসাব ছিল তার। ঠিক গেটের মুখেই দুজনের দেখা হয়ে গেল। উন্মাদের মত অভিনয় করে ভিকারকে কিছু আঁচ করবার সুযোগই দিল না।
কথা বলতে বলতে মিস মারপল আমার আর ইনপেক্টরের মুখের দিকে তাকালেন পর পর। পরে আবার বলতে শুরু করলেন।
–পাকা বুদ্ধির মানুষ লরেন্স। একজন খুনীর মতই পরিষ্কার মাথা। সেই জন্যই নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য স্বেচ্ছায় পুলিসের কাছে স্বীকারোক্তি করতে গেল। সঙ্গে পিস্তলটাও নিয়ে গেল। তবে সাইলেন্সরটা রেখে গেল।
দক্ষ অভিনেতার মত নিজেকে খুনী বলে জাহির করার চেষ্টা করল। বাস্তবিক ওর স্বীকারোক্তি সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছিল।
মিস মারপলের কথার মাঝখানেই আমি বলে উঠলাম, সেদিন রাতে জঙ্গলের মধ্যে একটা শব্দ হয়েছিল, আপনিও তো শুনেছিলেন, সেটা তাহলে কি ছিল? শব্দটা কি আকস্মিক কোন ঘটনা?
না, প্রিয় ভিকার। মিস মারপল বললেন, ওটা অবশ্যই আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। সকলকে শোনাবার জন্যই শব্দটা করা হয়েছিল। তা না হলে মিসেস প্রথেরো সন্দেহের মুখে পড়তেন।