কেননা, ওদের দুজনকেই আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু মানুষের বিচিত্র প্রকৃতির কথা তো আপনার অজানা নয়।
ঘটনার শুরুতেই ওদের দুজনকে বোকার মত স্বীকারোক্তি দিতে দেখে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি ভুল বুঝেছিলাম। দোষী হিসেবে অন্য অন্য লোককে নিয়ে ভাবনা শুরু হয়ে ছিল আমার। কর্নেল প্রথেরো খুন হলে কোন না কোন ভাবে তাদের লাভবান হবার কথা এমন সব লোক।
–একারণেই আপনি বলেছিলেন খুনের ব্যাপারে সাতজনকে সন্দেহ করা চলে? বললাম আমি।
-হ্যাঁ, অনেকটাই তাই, হাসলেন মিস মারপল, ধরুন আপনার ওই আর্চার। মদ খেলে লোকটা খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তারপর ধরুন আপনার ওই মেরী। সে অনেকদিন আর্চারের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে। মেয়েটা খুবই বদমেজাজি। সুযোগ এবং উদ্দেশ্যও অনুকূলে। মেরী বাড়িতে একলাই ছিল। আর ওই বুড়ি আর্চার খুব সহজেই লরেন্সের বাড়ি থেকে পিস্তলটা সরিয়ে নিতে পারত।
এরপর ধরুন লেটিসের কথা। টাকা আর স্বাধীনতার জন্য সে সবকিছুই করতে পারে। ওর মত অনেক সুন্দরী মেয়ে আমি দেখেছি যাদের নৈতিক জীবন বলে কিছু নেই।
ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বোধ করলেও আমরা নিঃশব্দে মিস মারপলের কথা শুনে যেতে, লাগলাম।
মিস মারপল বলে চললেন, টেনিস র্যাকেটের কথাটাই এবারে ধরা যাক।
–টেনিস র্যাকেট?
-হ্যাঁ টেনিস র্যাকেট। ভিকারেজের গেটের কাছে পড়ে ছিল সেটা। মিসেস প্রাইস রিডলের বাড়ির ঝি ক্লারা সেটা কুড়িয়ে পেয়েছিল।
এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে–খেলা থেকে ফেরার যে সময়ের কথা ডেনিস বলেছিল; তার আগেই ফিরে এসেছিল।
আপনারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, বছর খোল বয়সের ছেলেদের ব্যবহার স্বভাবতই খানিকটা সন্দেহজনক আর ভারসাম্যহীন হয়ে থাকে।
উদ্দেশ্যহীন ভাবেও ডেনিসের বয়সী ছেলেরা আপনার কিংবা লেটিসের জন্য অনেক কিছু করে ফেলতে পারে। আর উদ্দেশ্য থাকলে তো রীতিমত বেপরোয়া হয়ে ওঠে–সেই কাজের পরিণতি যাই হোক না কেন।
ডেনিস আর লেটিসের মধ্যে যে প্রেমের একটা ব্যাপার চলেছে আশা করি সেটা আপনারও নজরে পড়েছে।
কথা শেষ করে মিস মারপল অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।
ইনসপেক্টর একপলক আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।
মিস মারপল পুনরায় বলতে শুরু করলেন, এবারে আসি আপনার আর হতভাগ্য হস-এর কথায়।
–আমি! সবিস্ময়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
–হ্যাঁ! ঘাবড়াবার কিছু নেই ভিকার। আপনি যে সত্যই কিছু করেছেন অতটা আমি ভাবছি না। তবে সেই চুরি যাওয়া টাকাটার প্রসঙ্গ আমি মনে করিয়ে দিতে চাইছি।
তার জন্য আপনি অথবা হস দুজনের যে কোন একজন দায়ী।
মিসেস প্রাইস রেডলি কিন্তু আপনাকেই সন্দেহ করেছিল। তার কারণও অবশ্য ছিল। ব্যাপারটা নিয়ে তল্লাসীর কথা যখন সে বলেছিল, একমাত্র আপনিই তখন প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
আমি নিজে অবশ্য সন্দেহ করতাম হস-কেই।
যাই হোক, আমার সন্দেহের আওতার সাত জনের মধ্যে পরবর্তী নামটি হল আপনার স্ত্রী গ্রীসলডা।
মিসেস ক্লেমেট অবশ্যই সমস্ত সন্দেহের বাইরে। বাধা দিলেন ইনসপেক্টর মেলচেট, কেননা তিনি ঘটনার অনেক আগেই শহরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন ছটা পঞ্চাশের ট্রেনে।
মিস মারপল হাসলেন। বললেন, সে তো তার নিজের কথা। একজন যা খুশি বলতেই পারে, তাই বলে সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে কি মেনে নেওয়া ঠিক?
আপনারা জানেন কিনা জানি না, সে রাত্রে ছটা পঞ্চাশের ট্রেন প্রায় আধঘণ্টা দেরি করে এসেছিল। তাছাড়াও, আমি নিজের চোখেই গ্রীসলডাকে রাত সওয়া ছটার সময় ওল্ড হলের দিকে যেতে দেখেছি।
তাহলে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিতে পারি ছটা পঞ্চাশের আগের কোন ট্রেনেই গ্রীসলডা শহর থেকে ফিরেছে।
মিস মারপল অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে কেবল জিজ্ঞাসাই ছিল না। আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করলাম। গ্রীসলডা যে নির্ধারিত ট্রেনের আগে ফিরেছে একথা আমাকে জানায়নি।
অস্বস্তি কাটাবার জন্যই কিছুক্ষণ আগে যে বেনামী চিঠিটা খুলেছিলাম সেটা পকেট থেকে বার করে আনলাম।
চিঠিতে লেখা ছিল, লরেন্স রেডিং-এর বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে গ্রীসলডাকে বেরতে দেখা গিয়েছিল ছটা বেজে কুড়ি মিনিটে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য নানা রকম সন্দেহ খেলে গেল মাথায়। মনে হতে লাগল আমি যেন দুঃস্বপ্ন দেখছি।
একটা দৃশ্য বড় অস্পষ্ট হয়ে উঠল–গ্রীসলডা আর লরেন্স ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর মিঃ প্রথেরো ব্যাপারটা জানতে পেরে গেছেন। তাতে তারা দুজন খুবই ভীত হয়ে পড়েছে।
মিঃ প্রথেরো ঘটনাটা বলে দিতে পারেন সন্দেহ করে দুজনেই মরীয়া হয়ে ওঠে। সেই পথ বন্ধ করার জন্য তারপর গ্রীসলডা মিঃ প্রথেরোকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে এবং লরেন্সের ঘর থেকে তার পিস্তলটা চুরি করে।
সাপের মত জড়িয়ে ফেলবার আগেই এ দুঃসহ ভাবনাটাকে মাথা থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। মিস মারপল, এরকম কোন ভাবনা ভাবছে কিনা বুঝতে পারছি না।
চিঠিটা, মিস মারপলের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়লেন। নীরবেই আমাকে ফেরত দিলেন।
কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থেকে তিনি বলতে শুরু করলেন, এখন এই রহস্য সম্পর্কে আমি যা ভেবেছি তা আপনাদের বলছি। আপনারা আমার কথা মেনে নেবেন এমন কথা আমি বলতে চাই না।