কিন্তু মারপল চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়ালেন। বললেন, যা বুঝতে পারছি, সেজন্যেই ঠিক সময়ে আপনি এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
–ঠিক সময়? কিসের ঠিক সময়? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–হস-এর জীবন বাঁচাবার কথাই বলছি আমি। আর দেরি হয়ে গেলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত না।
-হস বেঁচে উঠলে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে হয়ে উঠবে। কেবল ওর নিজের জন্য নয়, সবার জন্যই ওর বেঁচে ওঠা দরকার। আমরা এখন সত্যটা জানি। আর…
মিস মারপল অদ্ভুতভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, একথাটাই সে আপনাকে এবং অন্য সকলকে ভাবাতে চেয়েছিল। আপনি ভাবছেন সত্যটা জেনে গেছেন। আপনি তাই ভাবছেন হস-এর বাঁচাটা সবার পক্ষে ভাল। সব কিছুই ঘটনার সঙ্গে খাপ খেয়ে যাচ্ছে। চিঠি, অতিমাত্রায় ওষুধ, হস-এর মানসিক অবস্থা আর তার স্বীকারোক্তি–সবই মনে হচ্ছে একই সূত্রে বদ্ধ–কিন্তু এ সবই ভুল…ভুল।
আমরা দুজনেই চমকে মিস মারপলের দিকে তাকালাম।
মিস মারপল বলে চললেন, হসকে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এতে আমি নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি। তার পক্ষে ওই জায়গাটাই নিরাপদ। ওখানে কেউ ওর অনিষ্ট করতে পারবে না।
একটু থেমে ফের বললেন, যদি ঈশ্বরের দয়ায় হস বেঁচে ওঠে তাহলে সত্য রহস্যটা ওর কাছ থেকেই জানা যাবে।
–সত্য রহস্য মানে?
–হ্যাঁ সত্য রহস্য। খুন তো দূরের কথা হস মিঃ প্রথেরোকে ছোঁয়নি পর্যন্ত।
–কিন্তু টেলিফোন, অতিরিক্ত ওষুধ, অসমাপ্ত চিঠি–এসব থেকেই তো আসল রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে।
হাসলেন মিস মারপল। বললেন, সেকথাই তো বলছি। খুনী বড় চতুর, সে একথাটাই আপনাকে বোঝাতে চেয়েছিল।
-খুন বলতে আপনি কাকে বোঝাচ্ছেন? বললাম আমি।
–আমি প্রকৃত খুনীর কথাই বলছি–অর্থাৎ মিঃ লরেন্স রেডিং-এর কথাই বলছি।
.
১৯.
ভীষণভাবে চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। এমন সরাসরি কি করে নাম বলতে পারছেন মিস মারপল? কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এমন অসংযত কথা নিশ্চয় স্বাভাবিক অবস্থায় বলছেন না ভদ্রমহিলা।
আমি এবং ইনসপেক্টর পরস্পর মুখের দিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে রইলাম। অবশেষে ইনসপেক্টরই প্রথম কথা বললেন, এ একেবারেই অসম্ভব মিস মারপল। লরেন্স রেডিং সম্পূর্ণ ভাবেই আমাদের সন্দেহের বাইরে।
-খুবই স্বাভাবিক, বললেন মিস মারপল, লরেন্স বরং নিজেকে খুনী প্রমাণ করবার জন্যই যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল।
-ওটা আমাদের বিভ্রান্ত করার একটা কৌশল ছিল তার, বললেন মিস মারপল, আপনার নিশ্চয় মনে আছে, লরেন্সের স্বীকারোক্তির কথা শুনে আমি খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এই খবর শোনার পর আমার সমস্ত ভাবনা ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। কেননা ওকে বরাবরই আমি নির্দোষ বলে ভেবে এসেছিলাম।
–তাহলে আপনি লরেন্স রেডিংকেই খুনী বলে সন্দেহ করছেন?
–সত্যিকথা বলতে কি, বইতে প্রায়ই দেখা যায়; সন্দেহভাজন নয় এমন ব্যক্তিই শেষ পর্যন্ত খুনী বলে প্রমাণ হয়। কিন্তু বই-এর কোন কিছুই বাস্তবের সঙ্গে আমি মেলাতে যাই না। মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে আমার খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।
সব কিছু দেখে শুনে আমি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলাম, ভদ্রমহিলা পুরোপুরি লরেন্সের কবজায় চলে গেছেন। অবশ্য লরেন্স খুব ভালোভাবেই জানত মিসেস প্রথেরো চালচুলোহীন এক মহিলা। এমন এক সঙ্গিনীকে নিয়ে পালিয়ে যাবার মত বোকা লরেন্স কোনকালেই ছিল না।
সেই কারণেই কর্নেল প্রথেরোকে সরিয়ে দেওয়া তার দরকার হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত করেও ছিল তাই।
আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন যে ওরকম চমৎকার দেখতে একজন মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনা বলতে কিছু ছিল না।
মিস মারপল থামলেন। বোঝা যাচ্ছিল ইনসপেক্টর খুবই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, এ মেনে নেওয়া যায় না। সম্পূর্ণ অসম্ভব। ছটা পাঁচ মিনিট পর্যন্ত লরেন্সের গতিবিধি আমরা খুঁটিয়ে বিচার করে দেখেছি। আর ওই সময়ের মধ্যে কোন মতেই যে মিঃ প্রথেরোকে গুলি করা হয়নি সে-কথা ডাঃ হেডকও বলেছিলেন। একজন ডাক্তারের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আমাদের থেকে বেশিই বলা চলে। তা যদি না হয় তাহলে বলতে হয়, ডাক্তার হেডক মিথ্যা কথা বলেছেন।
–ডঃ হেডকের সাক্ষ্য কোথাও ভুল নেই। বললেন মিস মারপল। ভদ্রলোক সম্পূর্ণ নির্ভেজাল। তবে এটাও সত্যিকথা যে লরেন্স নয় মিঃ প্রথেরোকে গুলিটা করেছিল মিসেস প্রথেরোই।
আরও একবার চমকে উঠলাম আমরা। মিস মারপল মাথা নাড়লেন, শালটা কাঁধে জড়িয়ে নিলেন। পরে বললেন, আমার কথা সম্পূর্ণই ঠিক, এখনো পর্যন্ত অবশ্য বলতে পারছি না। এটাও ঠিক যে কেবল বিশ্বাস দিয়ে কোন অভিযোগ খাড়া করা যায় না। তার জন্য দরকার হয় নির্ভুল প্রমাণ। কারো বক্তব্য বা কাজ যদি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে না মেলে তাহলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
আমার নিজের ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ নয়। একটা বিষয়ে এখনও খটকা লেগে রয়েছে। হঠাৎই সেটা আমার নজরে পড়েছে।
বলে একটু থামলেন মিস মারপল। কি ভাবলেন। পরে বললেন, ভিকারের লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে আচমকা জানলার খোপে একটা কালো মত জিনিস আমার চোখে পড়ে গিয়েছিল।
–অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য সব কথা আপনি শোনাচ্ছেন মিস মারপল। বলে উঠলেন ইনসপেক্টর।
একথায় কান না দিয়ে মিস মারপল বলে চললেন, যা ভেবে বিশ্বাস করেছিলাম তার জন্য আমি দুঃখিত।