চিঠি থেকে মুখ তুলে ইনসপেক্টর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।
চিঠিটা ওখানেই শেষ হয়েছে। শেষ কথাগুলো খানিকটা আঁকাবাঁকা আঁচড়ের মত, লিখতে লিখতে যেন শরীর এলিয়ে পড়েছে; বোঝা যায়।
ইনসপেক্টর মেলচেট একটা গভীর শ্বাস নিল। হস-এর দিকে তাকাল।
-তাহলে এখানেই শেষ হল রহস্য। অনুশোচনায় জর্জরিত হয়েই হস স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হয়েছে।
কথা শেষ করে ইনসপেক্টর হস-এর দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে আলতো করে নাড়া দিল। পরে জোরে ঝাঁকুনি দিতে লাগলেন।
নেশা করেছে। ঘুম নয়।
বলে ডালা-খোলা বাক্সটার দিকে তাকালেন। ঘুরে সেটা তুলে নিলেন।
–এ কি…
-হ্যাঁ, আমারও ধারণা তাই, বললাম আমি, আগে একদিন আমাকে ওটা দেখিয়েছিল। বলেছিল, ওটা বেশি খাওয়া বিপজ্জনক। নিরাপদ পথ ভেবে ওটা খেয়েই নিজেকে শেষ করেছে।
খুনীকে হাতে পেলে পুলিশ অফিসাররা সম্ভবত সকলেই একরকম ব্যবহার করে থাকে। ইনসপেক্টর মেলচেটও অস্বাভাবিক তৎপর হয়ে উঠলেন। কি করে খুনীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবে সেই চিন্তাই মন জুড়ে বসেছে।
দুপা এগিয়ে ঝট করে রিসিভারটা তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর লাইন পেলেন। বললেন, কে ডাঃ হেডক? আপনি এখুনি উনিশ নম্বর হাই স্ট্রীটে চলে আসুন। হ্যাঁ, হস মনে হচ্ছে কোন একটা ওষুধ বেশি খেয়ে ফেলেছে। চটপট চলে আসুন।
চিন্তিত ভাবে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। অস্থিরভাবে ঘরের ভেতর পায়চারী শুরু করলেন।
একসময় আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ওই চিঠিটা কোথায় পেয়েছেন আপনি?
–মেঝেয় পড়েছিল দোমড়ানো অবস্থায়। সম্ভবতঃ হস-এর হাতেই ছিল–
–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। ভিকারেজের ঝি-টাই দেখছি ঠিক ছিল। যে চিঠিটা আমরা পেয়েছিলাম সেটা জালই ছিল। ভাল বলতে হয় যে ও চিঠিটা নষ্ট করেনি।
একটু থেমে কি ভাবলেন। পরে বললেন, যদি এটা পাওয়া না যেত তাহলে খুনীকে ধরা অসম্ভব হয়ে পড়ত। অবশ্য খুনীরা কোন না কোন সময়ে এরকম একটা ভুল করে থাকে। সেই ভুলটাই তাদের ধরিয়ে দিতে প্রধান ভূমিকা নেয়। কি ব্যাপার মিঃ ক্লেমেট, মনে হচ্ছে আপনি খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন।
–হ্যাঁ, তাই, বললাম আমি, অনেক সময় হসকে আমার কেমন সন্দেহজনক মনে হত। কিন্তু এরকমটা কখনো ভাবতে পারিনি…
বাইরে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। ইনসপেক্টর সংক্ষেপে তাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলেন।
ডাক্তার হেডক ভ্রূ কোচকালেন। হস-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। হাত টেনে নিয়ে নাড়ী দেখলেন। চোখের পাতা টেনে পরীক্ষা করলেন।
আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বললেন, ওকে যদি ফাঁসিতে লটকাতে চাও, তাহলে এখনো ক্ষীণ আশা আছে, চেষ্টা করলে হয়তো বাঁচানো যেতে পারে।
সঙ্গে করে আনা বাক্সটা খুললেন ডাক্তার। ঝটপট একটা ইনজেকশান করলেন হস-এর হাতে।
পরে ইনসপেক্টর মেলচেটকে বললেন, এই মুহূর্তে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। আপনারা হাত লাগান একটু আমি ওকে গাড়িতে তুলে নিচ্ছি।
আমরা দুজনে ধরাধরি করে হসকে ডাক্তারের গাড়িতে তুলে দিলাম। ডাক্তার ড্রাইভারের সিটে বসতে বসতে বললেন, তবে মিঃ মেলচেট, মনে হয় আপনারা ওকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারবেন না।
তার মানে ও আর বাঁচবে না বলছেন? বললেন ইনসপেক্টর।
বাঁচা না বাঁচা দুটোই অনিশ্চিত। আমি সেকথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি, হস যদি বেঁচেও যায়, খুনের জন্য ওকে দায়ী করা যাবে না। দরকার হলে তার জন্য আমি সাক্ষ্য দেব।
ডাক্তার গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমরা আবার ঘরে ফিরে এলাম। ইনসপেক্টর বললেন, ডাক্তারের কথা বলার মানে কি ভিকার?
আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। হস যে এনসিথাইসিস ল্যাথার্জীতে ভুগছে সেকথা ওকে বললাম।
-ওটা তো অনেকটা মানসিক অবসাদের রোগ তাই না? স্লীপিং সিকনেস। ইনসপেক্টর বললেন, ডাক্তার কি মনে করছেন, এখনকার দিনে কুকর্মের পেছনে যুৎসই কারণ দেখাতে পারলেই অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে?
আমি জবাবে কিছু বলবার আগেই হঠাৎ দরজা খুলে গেল। মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন।
–আপনাদের কাজের মধ্যে এসে পড়লাম, দুঃখিত। শুনলাম হস অসুস্থ, তাই চলে এলাম। মনে হল, যদি ওর জন্য কিছু করার দরকার হয়।
–এসে ভালোই করেছেন, বললেন ইনসপেক্টর, তবে আপনার করার মত কিছু নেই আপাতত ডাক্তার হসকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেছেন।
মিস মারপল যেন খুশি হলেন কথাটা শুনে বললেন, যা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। হস হাসপাতালে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু ওর জীবনের আশঙ্কা নেই তো?
–তা বলতে পারছি না। বললেন ইনসপেক্টর।
ডালা-খোলা শূন্য বাক্সটার দিকে চোখ পড়ল মিস মারপলের। বললেন, ওটা বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলেছিল মনে হচ্ছে?
আমি এ কথার জবাব না দিয়ে হস-এর অসমাপ্ত চিঠিটা মিস মারপলের দিকে এগিয়ে দিলাম।
চিঠিটা পড়লেন তিনি। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন না।
–এরকম একটা ব্যাপারই নিশ্চয় আপনি অনুমান করেছিলেন? বললাম আমি।
–তা করেছিলাম, বললেন মিস মারপল, আচ্ছা ভিকার, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি
বলে অন্যমনস্কভাবে চিঠিটার দিকে একবার তাকালেন। পরে বললেন, আপনি এখানে এসেছিলেন কেন? এ সময়ে তো আপনার আসার কথা নয়।
ফোনের কথাটা মিস মারপলকে বলতে হল। বললাম, ফোনে হস-এর গলার স্বর ধরতে পেরেছিলাম। তাই ব্যাপারটা কি দেখতে চলে এসেছিলাম।