ঠিক এমনি সময়ে ফোন বেজে উঠল। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম। বললাম, আমি ভিকারেজ থেকে বলছি। আপনি কে কথা বলছেন?
জবাবে একটা অদ্ভুত ত্রস্ত গলা ভেসে এলো। উন্মত্তের মতো কেউ বলে চলল, হে ঈশ্বর আমি স্বীকারোক্তি দিতে চাই–আমি স্বীকারোক্তি দিতে চাই
কথা শেষ হবার আগেই লাইনটা কেটে গেল। বিস্মিত হয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। চেয়ারে ফিরে এসে মিঃ মেলচেটের দিকে তাকিয়ে বললাম, এবারে আপনার পাগল হবার পালা।
–পাগল? আমার, কেন কি হল? বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালেন মেলচেট।
পর পর দুজন খুনের স্বীকারোক্তি দেবার পরে বলেছিলেন মনে আছে যে, এর পরে কেউ স্বীকারোক্তি দিতে এলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন?
-হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কি
স্বীকারোক্তি দিতে চেয়ে আর একজন ফোন করেছিল। কিন্তু মাঝপথেই এক্সচেঞ্জ লাইনটা কেটে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে ইনসপেক্টর চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়াল। আমাকে হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিল।
–এক্সচেঞ্জের সঙ্গে আমি কথা বলছি।
বেশ তো দেখুন চেষ্টা করে। আমি ততক্ষণ বাইরে যাচ্ছি। তবে গলার স্বরটা আমি মনে হয় চিনতে পেরেছি।
আমি দ্রুত পায়ে ভিকারেজ থেকে বেরিয়ে পথে নামলাম। রাত তখন এগারোটা। সেন্টমেরী মীড-এর গোটা গ্রামটাই নিঃঝুম হয়ে আছে। রোববার বলে সকলেই আজ আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েছে।
হস-এর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। একতলায় কেউ জেগে আছে মনে হল। একটা জানালার ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত হসই জেগে রয়েছে। দরজার সামনে গিয়ে বেল বাজালাম।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ফের যখন বেল বাজাতে যাচ্ছি, দরজা খুলল হস-এর বাড়িউলি।
–জানালায় আলো দেখলাম, মনে হয় হস জেগে আছে। একবার দেখা করে যাই ওর সঙ্গে। বেশ তো যান। রাতের খাবার পরে আমি আর ওর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। ভদ্রমহিলা বলল।
জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে?
না–বাইরের কেউ আসেনি। পুরো সন্ধ্যাটাই ঘরে একা ছিল।
আমি ভেতরে পা বাড়ালাম। এক তলায় দুটো ঘর নিয়ে হস থাকে। একটা শোবার ঘর। দ্বিতীয়টা বসার ঘর। আমি দ্রুতপায়ে সেই ঘরে ঢুকলাম।
বড় একটা চেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে হস। দেখে মনে হল ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল না।
পাশেই টেবিলে একটা ছোট ডালা খোলা বাক্স। আর অর্ধেক জলভর্তি একটা গ্লাস।
ঘরের চারপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজ চোখে পড়ল ওর পায়ের কাছে।
এগিয়ে গিয়ে পোঁটলা পাকানো কাগজটা তুলে সোজা করে নিয়ে পড়লাম।
পাশেই টেলিফোনটা ছিল। রিসিভার তুলে ভিকারেজে ফোন করলাম। কিন্তু লাইন পাওয়া গেল না। এনগেজড।
এক্সচেঞ্জে নাম্বারটা জানিয়ে রাখলাম। বলে দিলাম, পরে ফোন করতে।
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে চিঠিটা বার করলাম। ইনসপেক্টর মেলচেটকে দরজা খুলে দেবার সময়ে চিঠির বাক্সে পেয়েছিলাম এটা। তখন আর পড়ার সুযোগ হয়নি। এবারে সেটা খুললাম।
হস্তাক্ষর পরিচিতই মনে হল। কিন্তু ভাষার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এরকম হস্তাক্ষর কোথায় দেখেছি মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলাম। মুহূর্তের মধ্যেই স্মরণে এসে গেল। হ্যাঁ, হুবহু একই রকম হস্তাক্ষরে লেখা ছিল মিঃ প্রথেরোর মৃতদেহের পাশ থেকে যে চিরকূটটা পাওয়া গিয়েছিল তাতে।
দুর্বোধ্য চিঠিটা আরো কয়েকবার পড়লাম। কিন্তু কিছুই বোধগম্য হল না। ঠিক এমনি সময়ে ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভারটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে, ইনসপেক্টর মেলচেট কথা বলছেন কি?
-হ্যাঁ, অপর পাশ থেকে জবাব এলোে; আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন? আমি কিন্তু একটু আগের ফোনটার সন্ধান পেয়ে গেছি।
–জানি আমি নাম্বারটা। বললাম।
–তাই বুঝি! তাহলে কি সেই জায়গা থেকেই এখন কথা বলছেন?
–হ্যাঁ, আমি সেখানেই আছি।
–তাহলে স্বীকারোক্তির কি হল?
–স্বীকারোক্তি পেয়েই গেছি বলতে পারেন।
–তার মানে, ইনসপেক্টরের স্বর উত্তেজিত শোনালো, তাহলে কি খুনীকে পেয়ে গেছেন?
আমিও যথেষ্ট উত্তেজনা বোধ করছিলাম। চেয়ারে শায়িত হস-এর দিকে একপলক তাকালাম। তারপর ভাজ খাওয়া চিঠিটা, ডালা-খোলা ছোট্ট বাক্সটা–সব কিছুর ওপরেই দৃষ্টি ঘুরে এলো আমার। বাক্সটার ওপরে সিরুবিম নাম লেখা।
ইনসপেক্টরকে বললাম, এখনো সঠিক বলতে পারছি না। আপনি এখুনি এখানে চলে আসুন।
এরপর ঠিকানাটা দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। দেখি, ইনসপেক্টর আসুক।
হস-এর উল্টো দিকে একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পরেই দরজায় ইনসপেক্টর মেলচেটের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
ঘরে পা দিয়ে ইনসপেক্টর প্রথমে নিদ্রিত হস-এর দিকে তাকালেন। পরে আমার দিকে ফিরে বললেন, কি ব্যাপার? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
আমি হস-এর ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া চিঠিটা বাড়িয়ে দিলাম। চিঠিটা উঁচু গলায় পড়তে লাগলেন তিনি প্রিয় ভিকার,
খুবই অপ্রিয় একটা বিষয় আমাকে বলতে বাধ্য হতে হচ্ছে। তবে লিখেই জানাব ঠিক করেছি। পরে আমরা কোন এক সময়ে এ নিয়ে আলোচনা করতে পারি। সাম্প্রতিক খুনের ঘটনার সঙ্গে এটার যোগ রয়েছে।
কোন নিযুক্ত যাজককে দোষী করা খুবই যন্ত্রণাদায়ক বলে আমার মনে হচ্ছে। তবে কষ্ট হলেও ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেওয়া আমার কর্তব্য। যেমন ধরুন…