টেবিলের ওপরে অকারণে আঙুল ঘষল ও। তারপর বলল, ভাবছি ওকে বলেই আসব। মহিলা কেমন যেন অদ্ভুত।
–কি রকম?
-এই দেখনা এখানে এসে থেকেই গেল। তারপর বাইরেও ক্কচিৎ কখনো বেরয়। সর্বদাই কেমন বিষণ্ণ ভাব।
গ্রীসলডা বকবকানির সুযোগ পেলে থামতে চায় না। তার ওপরে পরচর্চার সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। আমি মজা করে বললাম, থেমে গেলে! বলে যাও।
ও হেসে বলল, তুমি এই কথাটাকে হাল্কাভাবে নিলে। তলিয়ে দেখলে না। ওই সুন্দরী মহিলা সত্যি সত্যি আমাদের কাছে রহস্যময়ী হয়ে আছে। তার অতীত ইতিহাস এখানে কেউ জানে না। তার প্রকৃত পরিচয়ও অজানা।
একটু থেমে অন্তরঙ্গ সুরে বলল, তবে আমার মনে হয় ডাক্তার হেডক ওর সম্পর্কে কিছু জানে।
–কথাটা তো গোয়েন্দার মত হয়ে গেল। ওসব গল্প আজকাল খুব পড়ছ মনে হচ্ছে।
এবারে চোখ বড় বড় করে গ্রীসল আমার দিকে তাকাল। বলল, কি ব্যাপার বলতো। কয়েকদিন আগে সিঁড়িতে দাগ বইটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিশ্চয় তুমি সরিয়েছিলে?
হেসে বললাম, পরে তো পেয়েছ। খানিকটা লেখা আমার চোখে পড়েছিল বলে বইটা তুলে রেখেছিলাম।
–আমি জানি লেখাটা কি।
বলতে বলতে আমার প্রতি মোহনীয় কটাক্ষপাত করে ঘর থেকে চলে গেল।
লাঞ্চের পরেই এ ঘরে চলে এসেছিলাম মেনস সোসাইটির চার্চের জন্য একটা বক্তৃতা লিখব বলে। গ্রীসলমবার্ড চলে যেতে এবারে কাগজ কলম টেনে নিয়ে বসলাম।
কিন্তু দুর্দৈব যাকে বলে। ঠিক এই সময় এসে হাজির হল লেটিস। ও হলো কর্নেল প্রথেরোর প্রথম পক্ষের মেয়ে।
আমাকে জিজ্ঞেস করল, ডেনিস কোথায়?
লাঞ্চের পর কোথায় বেরিয়ে গেল। তোমাদের ওখানেই তো টেনিস খেলতে যাবে বলেছিল।
এরপর লেটিস গ্রীসলডার খোঁজ করল।
বললাম, বাগানের স্টুডিওর ঘরে পাবে। লরেন্স ছোকরা ওর ছবি আঁকছে।
লেটিস বলল, বাবার সঙ্গে লরেন্সের সেদিন খুব একচোট হয়ে গেছে।
–সেকি! কেন?
–সাঁতারের পোশাকে ওকে দিয়ে একটা ছবি আঁকাতে চেয়েছিলাম। তাইতেই বাবা যা-নয়-তাই বলে বাড়ি মাথায় করল।
দেখ, ওই পোশাকে বিচে যেতে পারি, তখন কোন দোষ হয় না, ছবি আঁকতে চাইতেই যত দোষ হয়ে গেল।
আমি কি বলব। চুপ করে রইলাম।
লেটিস ফের বলল, বাবা লরেন্সকে সোজা বলে দিল বাড়িতে না আসার জন্য। ওতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। তোমার স্টুডিওতে এসেই আমি ছবি আঁকিয়ে যাব।
-তা তো হয় না লেটিস, আমি বললাম, বিশেষ করে তোমার বাবার যখন আপত্তি রয়েছে।
–তোমরা দেখছি সবাই একই রকম। বড্ড সেকেলে। দিনরাত শাসনে শাসনে থেকে আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছি।
যদি হাতে টাকা থাকতো, তাহলে এখান থেকে চলে যেতাম।
একটু থেমে ও আবার বলল, ভাল ব্যবহার তো কোনকালেই করবে না, বাবা যদি মারা না যায় তাহলে এখানে আমি স্বস্তিতে থাকতে পারব না।
–ওভাবে তোমার বলা উচিত হচ্ছে না, লেটিস।
–কেন বলব না, কোনদিন আমার হাতে একটা টাকা দেবে না। কঞ্জুসের হাড়।
লেটিসের গলায় ক্রমশ উত্তেজনা বাড়ছিল। একটু থেমে পড়ে বলল, মা বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে শুনে আমি একটুও অবাক হইনি। তুমি তো জান না, ছেলেবেলা থেকে আমাকে শোনানো হয়েছে, আমার মা মৃত। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারি যে পুরুষকে তার স্ত্রী ছেড়ে চলে যায় সে কি প্রকৃতির পুরুষ।
আমি কি বলতে যাচ্ছিলাম, বাধা দিয়ে লেটিস ফের বলতে লাগল, আমার সম্মা অ্যানা, জেনে রেখো, সে-ও বেশিদিন নেই। খুব শিগগিরই কারো প্রেমে জড়িয়ে পড়বে।
জানো, অ্যানা আমাকে ঘৃণা করে। অথচ ভাল ব্যবহার দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
ওর কথার তোড় যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, আমি শঙ্কিত না হয়ে পারলাম না। আমার লেখাটা বরবাদ হয়। ভাগ্য ভাল, লেটিস নিজেই সেই আশঙ্কা দূর করল।
হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে বসল, আমার গ্রামোফোন রেকর্ডগুলো তোমার চোখে পড়েছে?
-কেন কি হল সেগুলো?
–আমিই রেখেছি, কিন্তু কোথায় যে তা আর খুঁজে পাচ্ছি না। দিন দিন অন্যমনস্কতা কেমন বেড়ে যাচ্ছে। বড্ড বিশ্রী লাগছে। নাঃ এখন উঠি। তিনটের সময় আবার ডঃ স্টোনের গাড়ি দেখতে যাবার কথা।
আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। চারটে বাজতে পঁচিশ মিনিট বাকি। হাসতে হাসতে ওকে সময়টা জানালাম।
–সর্বনাশ, বুঝতেই পারিনি। ওরা কি আর এতক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। তবু একবার ঘুরে আসি গে।
ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, তুমি ডেনিসকে বলে দিও।
কি বলতে হবে বুঝতে পারলাম না। তবু ঘাড় নেড়ে সায় জানালাম।
ডঃ স্টোনকে আমি জানি। তিনি একজন সুপরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক। আমাদের ব্লু বারে থাকবার জন্য কিছুদিন হল এসেছেন। কর্নেল প্রথেরোর জমিতে লোকজন নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছেন।
ইতিমধ্যেই লেটিসকে তার কাজ দেখাতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে কর্নেলের সঙ্গে বারকয়েক ডঃ স্টোনের বিসংবাদ হয়ে গেছে। খবরটা শুনে অবশ্য আমার বেশ মজাই লেগেছিল।
ডঃ স্টোনের সেক্রেটারী মিস ক্রেমের সঙ্গে শুনেছি লেটিসের ভাব জমেছে। মহিলার বয়স পঁচিশ ছুঁয়েছে। বেশ স্বাস্থ্যবতী আর আমুদে ধরনের।
লেটিস যেরকম বাঁচাল আর চঞ্চল কি করে সেই মহিলার সঙ্গে তার পটলো বুঝতে পারি না। তাছাড়া তার সম্পর্কে গ্রামের মানুষের বিভিন্ন ধারণা। লেটিসেরও সে সব না জানার কথা নয়।
লেটিসের কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বছর পাঁচেক হল কর্নেল প্রথেরো ফের বিয়ে করেছিল। দ্বিতীয় বউ সুন্দরী। মেয়ে আর সম্মায়ের মধ্যে যে সম্পর্ক সুখের নয় তা আমি আঁচ করতে পারতাম।