রবার্ট যেদিন মারা যায় সেদিন সকালে আকাশ ভালো ছিল। দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ থেমে থেমে বৃষ্টি ঝড় শুরু হয়। পোয়ারো আগেই এসব খবর আবহাওয়া অফিস থেকে জেনেছিল।
তাই এমন দিনে বিশেষ করে লোকাল ট্রেনে লোক কম হওয়া স্বাভাবিক, এটা তার অনুমান মাত্র। পরের কথায় যৌক্তিকতা আছে কী না জানতে নর্থ রোড স্টেশনের মাস্টারের সঙ্গে কথা বলায় সে ঐ একই কথা জানিয়েছে।
এটা ডিনসমেডের কাজ কিনা জানার জন্য এবং নিঃসন্দেহ হবার জন্য তার অফিস ঘরটা খোঁজা দরকার। হয়তো ডিনসমেড নিজের অফিস ঘরেই রহস্যের চাবি কাঠি লুকিয়ে রেখেছে।
.
৩১.
পোয়ারো সেখানকার স্থানীয় থানার সামনে গাড়ি পার্ক করে রেখে সেই থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে তার ঘরে যায়।
অফিসার পরিচিত না হলেও বয়স্ক অফিসার পোয়ারার নাম জানে এবং চেনে কারণ একাজে তার যেমন অভিজ্ঞতা, তেমন ব্যাপক পরিচিত গণ্ডী। তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বলে-মিঃ পোয়ারো? আমার এখানে?
–আমায় একটু সাহায্য করতে হবে।
নিশ্চয়ই আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়েই বসে আছি।
-হিল ভিউ রোড আপনার এরিয়ার মধ্যে তো তাই না। ওখানকার একটা দোকানে সার্চ করতে যেতে হবে।
–আচ্ছা দোকানটা কী এখন ভোলা পাবো?
–এখন একটা বাজে, ভোলা থাকারই কথা।
–তাহলে একটু অপেক্ষা করুন আমি সব ব্যবস্থা করছি।
তারপর মিনিট দশেকের মধ্যে বেরিয়ে ডিনসমেডের দোকানের সামনে উপস্থিত হয়ে দেখে দোকানের একটা পাল্লা ভেজানো আর দারোয়ান বেচারা টুলে বসে ঝিমচ্ছে।
-এই। অফিসার পুলিশী মেজাজে রুল দিয়ে দারোয়ানকে একটা গোত্তা মারে।
–স্যার, বলে লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু ডিনসমেডের বদলে পুলিশকে দেখে ভিমরি খাবার যোগাড় এবং কাঁদো কাঁদো গলায় বলে–আমি চুরি করিনি।
–মানছি তুমি চুপি করোনি, আমরা এ দোকান সার্চ করতে এসেছি।
–ও কিন্তু এখানো..দারোয়ান ইতস্তত করে-তো স্যার আসেনি।
–অন্যদিন কখন আসে?
–এই ধরুন দশটার মধ্যে।
–যা মাইনে ঠিক মতো পাও?
–না স্যার দুমাসের মাইনে বাকি। খাতাতেও তাই আছে।
হিসেবের খাতাগুলো কোথায়?
–ঐ আলমারিতে। কিন্তু চাবি স্যারের কাছে।
–সত্যি বলছ?
–হ্যাঁ স্যার।
পোয়ারো দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে–এখানকার চাবির দোকানটা কোথায়?
কয়েকটা দোকানের পরেই।
–চাবিওয়ালাকে আমাদের কথা বলে ডেকে আনো। ওর সঙ্গে একটা পুলিশ দিন।
একটু পরেই চাবিওয়ালা মাস্টার-কি নিয়ে এল এবং একটু পরেই আলমারি খুলে দিল।
পোয়ারো দেখল আলমারিতে বেশ কিছু ফাইল ও কাগজপত্র। তবে আলমারির চারিদিকে অপরিষ্কার ও অব্যবহারের চিহ্ন জানিয়ে দিচ্ছে ব্যাবসার দুরবস্থার কথা।
এর মধ্যে কোথায় খুঁজবেন? এ তো দেখছি খড়ের গাদায় আলপিন খোঁজার মতো ব্যাপার।
-তা ঠিক তবু একবার চেষ্টা করতে হবে। পোয়ারো দারোয়ানকে বলে-মাইনে নেবার সময় কী কর?
-খাতায় স্ট্যাম্প দিয়ে সই করে মাইনে নিই।
–তাহলে তো খাতাটা চেনো। বার করো তো।
–স্যার এক্ষুণি বার করছি।
পোয়ারো ভাবে রবার্ট মারা গেছে দশই মার্চ, সোমবার। তাহলে মার্চ মাসের হিসেবটা দেখতে হবে।
এদিক ওদিক-খুঁজে একটা খাতা বার করে দারোয়ান বলে–ওটা তিন বছর আগের খাতা স্যার।
–এইরকমই পনেরো ষোলো বছরের পুরোনো খাতা তোমায় বার করতে হবে।
–ওরে বাবা।
–তবে বেশি খুঁজতে হবে না। একটা খাতায় বছর তিন-চারেকের হিসেব আছে।
–হা স্যার।
–তাহলে সেই ভাবে খোঁজ।
তারপর ময়লা ঝুলে ভর্তি একটা খাতা মুছে দারোয়ান বলে, এটা হতে পারে।
থ্যাঙ্ক ইউ। পোয়ারো একটা টেবিলে বসে বসে আগ্রহের সাথে খাতাটা দেখতে থাকে। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি করে সে মার্চ মাসে এসে থমকে দাঁড়ায়। এ মাসের দশ তারিখে কী লেখা আছে সেটাই তার জানা দরকার।
পোয়ারা বেশ উত্তেজিত হয়ে দশ তারিখের ব্যয়ের জায়গাটা দেখে–একটাই হিসেব লেখা আছে–টি, এক্সপেন্টা–বাইশ টাকা দশ পয়সা। তবে পোয়ারোর তীক্ষ্ণ নজরে আরো একটা জিনিস স্পষ্ট হল–টি, একপেন্ট লেখাটা একসঙ্গে হয়নি। হয়েছে বেশ কয়েকদিন পর। কারণ দশ তারিখে যে কালির ব্যবহার করা হয়েছে তার দাগ এগারো, বারো, তেরো, চোদ্দোতে নেই। পোয়ারোর মনে সন্দেহে ভরে ওঠে। এবার তাকে বাইশ টাকা দশ পয়সার হিসাব বার করতে হবে। অফিসারের দিকে তাকিয়ে–এই খাতাটা সিজ করুন।
–কিছু পেয়েছেন বুঝি?
–হ্যাঁ, আর একটা সিজার্স লিস্ট তৈরি করে দারোয়ান এবং স্থানীয় কয়েকজনকে রেসপেক্টেবল লোক দিয়ে সই করিয়ে নিন। অবশ্য আপনি একজন অভিজ্ঞ অফিসার এগুলো ভালোই জানেন।
থ্যাঙ্ক ইউ। আর দোকানটাও সিল করছি।
–হা আর একটা অনুরোধ।
এই কথাটা শুনে অফিসার লজ্জিত হয় এবং নিজেকে ধন্য বলে জাহির করে। পোয়ারো বলে-খাতাটার আট থেকে পঁচিশ তারিখ পর্যন্ত একটা ফটো স্টার্ড করে নিতে। অফিসার নিজে গিয়ে তাকে দিয়ে আসবে জানায়। তারপর পোয়ারো বিদায় নিয়ে চলে যায়।
পোয়ারো গাড়িতে বসে পকেট থেকে একটা ছোটো ডায়েরি বার করে নির্দিষ্ট জায়গাটা পেয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো আনন্দে চিকচিক্ করে ওঠে।
পোয়ারো ভাবে ডিনসমেডই যে রবার্টের খুনী তা প্রমাণ হয়ে গেল। তার একমাত্র ক্লু ঐ টি, এক্সপেন্টা-বাইশ টাকা দশ পয়সা।
পোয়ারোর বিশ্বাস রবার্ট উঠেছে হিল রোড থেকে আর নেমেছে নর্থ রোডে। অবশ্য যদি নামতে সেদিন পেরেছিল। কারণ এর মধ্যে একটা অ্যাক্সিডেন্টের প্রশ্ন জড়িত ছিল। হয়তো ডিনসমেড সেদিন পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছে, কিংবা কাজটা নিজেই ঘটিয়েছে।