পাহাড়টার ভিত্তিমূল কেঁপে উঠছিল আর দোল খাচ্ছিল তার উপরকার পাথরগুলো। প্রচণ্ড স্নায়বিক আলোড়নে আমি পাহাড়ের চূড়ায় শুয়ে পড়লাম আর কাছেই ছোটখাটো যে দু’ একটা বোপ ছিল সেগুলোকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে ভয়ের হাত থেকে মুক্ত করতে চাইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটু সামলে নিয়ে বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে আমি বলে উঠলাম, ‘এ সেই উপকূলবর্তী বিখ্যাত জলাবর্ত ছাড়া আর কিছু নয়।
–হ্যাঁ একে তাই বলে বটে। মস্কো দ্বীপ আর উপকুলের মাঝ খানে এর উৎপত্তি বলে আমরা নরওয়ের অধিবাসীরা একে মস্কো আবর্ত বলি।
আগে এই ঘূর্ণাবর্ত সম্পর্কে কিছু জানলেও আজকের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। জোনাস রেমাসের বর্ণনা যতই নিখুঁত হোক না কেন আজকের এই দৃশ্যের বিরাটত্ব বা ভয়াবহতার ক্ষীণতম ধারণাও তা আমাদের দিতে পারেনা। এঈ দৃশ্যের অভিনবত্ব আর হিংস্রতা মানুষকে সম্পূর্ণরূপেই বিভ্রান্ত করে ফেলে। আমি জানিনে লেখক কোথা থেকে আর কোন সময় এই ঘূর্ণাবর্তের দৃশ্য দেখেছিলেন। তবে এ কথা নিশ্চয়ই যে ঝড়ের সময় হেলসেগগেনের চুড়ো থেকে তাকে তিনি দেখেননি। তার বর্ণনা থেকে কয়েকটা অনুচ্ছেদ উদ্ধত করে এর খুঁটিনাটি দিকগুলো বোঝনোর চেষ্টা করা যায় ঠিকই, তবু এই দৃশ্যের প্রকৃত স্বরূপটিকে পাঠকের উপলব্ধির মধ্যে পৌঁছে দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না।
তিনি বলেছেন, ‘লোফোডেন আর মস্কোর মধ্যবর্তী অংশে সমুদ্রের গভীরতা দু’শ থেকে আড়াইশ’ ফুটের মত। ভার্গের দিকে গভীরতা ক্রমশ কমে এসেছে। সে দিকটায় জাহাজ যাতায়াতের পক্ষেও যথেষ্ট গভীরতা নেই। খুব শান্ত আবহাওয়ার মধ্যেও ওদিকটায় পাহাড়ে ধাক্কা খাবার ভয় থাকে জাহাজগুলোর। বন্যার সময় লোফোডেন আর মস্কোর মধ্যে জল বেড়ে দ্বীপগুলোর অনেক খানি অংশ ডুবিয়ে ফেলে। কিন্তু ভাটার সময় যে প্রচণ্ড গর্জনে জল ছুটে যায় তার সঙ্গে জলপ্রপাতের প্রবল গর্জনেরও তুলনা হয় না। সে গর্জন শোনা যায় বহু দূর থেকেই। এই সময় যে ভয়ানক ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয় তার মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে কোন জাহাজও যদি গিয়ে পড়ে, সেটা অবলীলায় জলের তলায় তলিয়ে যায়। ঘূর্ণির আবর্তে পড়ে সেটি ডুবন্ত পাহাড়ের ওপর আছাড় খায়, আর চুরমার হয়ে যায়। ঘূর্ণির এই উদ্দামতা যখন শান্ত হয়ে আসে তখন জাহাজের এই ভাঙা টুকরোগুলো ভেসে ওঠে। কিছু কিছু এসে তটভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই অঞ্চলের সমুদ্রের শান্ত অবস্থাটি শুধু জোয়ার আর ভাটার মাঝখানে মাত্র দেখতে পাওয়া যায়। সেটি তাই স্থায়ী হয় প্রায় মিনিট পনেরোর মত। তার পরেই তার তীব্রতা ফিরে আসতে শুরু করে। এর পর যখন তার মত্ততা প্রবল হয়ে ওঠে তখন যদি ঝড়ে হাওয়া বইতে থাকে তা হলে ওর কয়েক মাইল দূরত্বের মধ্যেও তখন আসা নিরাপদ নয়। এর থেকে নিরাপদ দূরত্বে না-থাকার দরুণ বহু নৌকো, বোট, জাহাজ এর কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। বড় বড় তিমিগুলোও এর আওতার মধ্যে এসে কাবু হয়ে পড়েছে। তখন তাদের বেঁচে থাকবার জন্যে যে কি প্রাণান্তকর ব্যর্থ চেষ্টা। একবার লোফোডেন থেকে একটা ভালুক সঁতরে আসছিল মস্কো দ্বীপটার দিকে। বেচারা গিয়ে পড়ে ঘূর্ণির মধ্যে আর তলিয়ে যায়। তখন তার আর্ত চীৎকার উপকূল অঞ্চলে স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল। পাইন আর ফার গাছ প্রচুর সংখ্যায় এই ঘূর্ণির মধ্যে গিয়ে পড়ে। স্রোতের ভয়ঙ্কর আবর্তে সেগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যখন ভেসে ওঠে তখন জলের ওপরটা ওদের টুকরোতে ভর্তি হয়ে থাকে। এ থেকে অনুমান করে নেওয়া সহজ যে এই অঞ্চলে জলের তলায় অজস্র পাহাড় আছে। আবর্তের মধ্যে যা কিছু পড়ে ডুবে যায়, সেগুলো গিয়ে এদিকে ওদিকে ওদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়। এই অঞ্চলে প্রতি ছ’ ঘণ্টা অন্তর জোয়ার ভাটা। ১৬৪৫ খ্রীষ্টাব্দের এক উৎসবের দিনে রোববারে এই ঘূর্ণির প্রচণ্ডতা আর গর্জন এমন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল যে উপকুলের কয়েকটা বাড়ীঘরের দেয়ালই ভেঙে পড়েছিল।
ঘূর্ণির খুব কাছাকাছি এলাকার গভীরতা কী ভাবে স্থিরীকৃত হয়েছিল জানিনে। দু’শ থেকে আড়াই’শ ফুট’ বলে গভীরতার যে পরিমাণ উল্লিখিত হয়েছে, তা লোফোডেন বা মস্কোর তীরভূমি বরাবর যে প্রণালীগুলো রয়েছে তারই গভীরতা হয়তো বা। মস্কো ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্র অঞ্চলের গভীরতা যে পরিমাপের বাইরে তাতে সন্দেহ কি! হেলসেগগেনের উচ্চতর চূড়ো থেকে ঘূর্ণির দিকে তাকিয়ে দেখেই যা বোঝা যায় তার চাইতে বেশী নির্ভরযোগ্য প্রমাণের প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে ওঠে না। প্রকৃতপক্ষে এই চূড়া থেকে ঐ ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্তের দিকে তাকিয়ে জোনাস রেয়াসের সহজ সবল বর্ণনা আর তিমি ভালুকের কাহিনী অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকরই মনে হয়েছে। এ কথা প্রমাণের অপেক্ষা রাখেনা যে সমুদ্রগামী বৃহত্তর জাহাজও যদি এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে গিয়ে পড়ে, মুহূর্তের মধ্যে তা ঝড়ের মুখে পালকের মতে তলিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
এই বর্ণনা যখন অতীতে আমি পড়েছিলাম তখন অনেকখানি বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়েছিল, আজ চোখের সামনে এ দৃশ্য দেখে ঐ বর্ণনাকে নিতান্তই ভিন্ন আর অকিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল। এই বিশাল আবর্তটি আর ফেরো দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে যে আরো তিনটি ছোট ঘোট আবর্ত আছে সেগুলো সম্পর্কে সাধারণ অভিমত এই যে জোয়ার ভাটার সময় জলমগ্ন শৈলশ্রেণীর সঙ্গে উত্তাল তরঙ্গের যে সংঘর্ষ ঘটে তারই ফলে স্বাভাবিক ভাবে জলপ্রবাহের উচ্চাবচ অবস্থাটি এই ঘূর্ণি সৃষ্টি করে। অস্বাভাবিক পরিমাণে বিশালকায় চোষণ ছাড়া এই ঘূর্ণির অন্য কোন পরীক্ষিত কারণ নেই। কথা গুলো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার। কিরচার এবং অন্যান্যেরা মনে করেন যে এই ঘূর্ণাবর্তের অতল গহ্বর পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত আর এই প্রসঙ্গে বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত বোথনিয়া উপসাগরের সঙ্গে এর সম্পর্কের কথা এক জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিতও হয়েছে। এই সব মন্তব্য কতখানি সমর্থনযোগ্য সে সন্দেহ আমার চিরদিনই ছিল, তবু আজ পর্বতচূড়ার উচ্চতম স্থান থেকে ঘূর্ণির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, ঐ ধারণা একান্ত সত্য। বৃদ্ধ ভদ্রলোককে জানালাম আমার তদানীন্তন মনের কথা। উনি সব শুনে যা বললেন তাতে আমি রীতিমতো বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। উনি বললেন, এই অভিমত নরওয়েবাসীরা প্রায় সকলেই স্বীকার করে নিলেও, উনি স্বয়ং এ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন। ঘূর্ণির কারণ সম্বন্ধে যে ধারণা উল্লিখিত হয়েছে সে সম্পর্কেও তিনি যে আস্থাহীন তাও অকপটেই প্রকাশ করলেন।