আমার পথপ্রদর্শক বললেন, ‘তোমার ওই অলস কল্পনাগুলোকে জয় করা উচিত। ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিল সেই জায়গাটা যাতে তুমি পুরোপুরি দেখতে পাও সেজন্যেই তোমাকে আমি এখানে এনেছি। তুমি জায়গাটি দেখবে আর সেই সঙ্গে তোমাকে আমি কাহিনীটি শোনাব।’
যে বিশিষ্ট ভঙ্গীতে কথা বলার জন্য তিনি অন্যান্যদের থেকে পৃথক, সেই বিশেষ ভঙ্গীতেই তিনি বলে উঠলেন, নরওয়ের যে এলাকা অক্ষাংশ থেকে আটষট্টি ডিগ্রী দূরে, বিখ্যাত সেই নডল্যাণ্ড এলাকার নির্জন নিরানন্দ অঞ্চল লফোডেনে এসেছি আমরা। মেঘাচ্ছন্ন যে পর্বতচূড়ায় আমরা বসে আছি সেটার নাম হেসেগুগেন। যদি নীচের দিকে তাকাতে তোমার ভয় করে বা মাথা ঘোরে তাহলে ঘাসগুলো ধরে তুমি একটু মাথা তুলে দেখ, তোমার সামনেই কুয়াশা ঘেরা সমুদ্র।
আমার মাথা ঝিম ঝিম করছিল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সমুদ্রের বিশাল বিস্তার। ঘন কালির মত এই দৃশ্য দেখে মুবিয়ানের ভূগোলে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমুদ্রের বর্ণনা আছে সেইটে হঠাৎ আমার মনে পড়ল। এর চাইতে নিরানন্দকর আর শোচনীয় ভাবে নির্জন দৃশ্য মানুষ কোনদিনই কল্পনা করতে পারবে না। ডাইনে বাঁয়ে যেদিকেই চোখ ফেরাই সেদিকেই দেখি অসীম বিস্তৃত সমুদ্র। পৃথিবীর চারদিকে প্রাচীরের মত কালো ভয়ঙ্কর বড় বড় পাহাড় দাঁড়িয়েছিল আর তারই পটভূমিতে বিষাদময় চিত্র এঁকে চলেছিল সমুদ্রতরঙ্গের ওপরে জেগে থাকা সাদা রঙের ফেনা। তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সমুদ্রের অবিরাম তীক্ষ্ণ উন্মাদ আর্তনাদ। আমাদের পর্বতচূড়াটা থেকে পাঁচ ছ’ মাইল দূরে সমুদ্রের বুকে ঘোট কালো ফোঁটার মত একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল। ওটার চারদিকে তরঙ্গের প্রচণ্ড বিক্ষোভই ওটাকে ভালো করে চিনিয়ে দিচ্ছিল। সমুদ্রের তীর থেকে মাইল দুয়েকের মধ্যেও একটা আরও ছোট আর অজস্র পাহাড়ে পরিপূর্ণ নিষ্প্রাণ দ্বীপ ছিল। ওটার বুকের ওপর একটুখানি অন্তর বেশ কয়েকটা করে কালো রঙের পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল।
দূরের দ্বীপ আর তীরভূমির মধ্যেকার সমুদ্রকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত বলে মনে হচ্ছিল। আমরা যখন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তার কিছুক্ষণ আগে থেকে তীরের দিকে প্রবল ঝড় বয়ে আসছিল। দূরে দেখা যাচ্ছিল দু’পালওয়ালা একটা জাহাজকে। উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে ওটার অধিকাংশ দেহটাই চোখের আড়ালে চলে চাচ্ছিল মধ্যে মধ্যে। সমুদ্রে যে প্রচণ্ড জোয়ার এসেছিল তা নয়, তবু তার ঘোট ঘোট ঢেউগুলো বাতাসের আঘাতে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল আর যেখানে যা পাচ্ছিল তারই ওপর আছড়ে পড়ছিল। পাশের পাহাড়গুলোর ওপর ছাড়া ফেনা কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না।
বৃদ্ধ তাঁর বক্তব্য আবার শুরু করলেন, “দূরের দ্বীপটাকে নরওয়ের লোকেরা ভার্গ বলে। মাঝখানেরটাকে বলে মস্কো। উত্তর দিকে মাইল খানেক দূরে আছে আম্বারেণ। আরো দূরে ওদিকে আছে ইফেসেন, হোইহোমু, কিয়েল্ডহোম, সোয়ারভেন আর বাহোম। আরও বেশ দূরে মস্কো আর ভাগের মধ্যে আছে অটার হোম, ফ্লিমেন, স্যাণ্ড ফ্লেসেন আর স্কারহোম। এ সবই ওই দ্বীপগুলোরই নাম কিন্তু ওগুলোর নামকরণের প্রয়োজনীয়তা কী ছিল তা তুমি বা আমি কেউই বুঝতে পারবোনা। কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছ তুমি? সমুদ্রের কোন পরিবর্তন কি চোখে পড়ছে?
মিনিট দশেক হল আমরা হেলসেগগগনের চূড়ায় এসে বসেছি। আসবার সময় আমরা লোফোডেনের ভেতরদিক দিয়ে উঠে এসেছি বলে সমুদ্র আমাদের মোটেই চোখে পড়েনি। এখন পাহাড়ের চুড়া থেকে পুরো সমুদ্রটা আমাদের চোখে পড়ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলার পর একটা ক্রমবর্ধমান তীব্র শব্দ সম্পর্কে আমি ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠতে লাগলাম। আমেরিকার কোন এক তৃণাচ্ছন্ন প্রান্তরের মধ্যে একপাল মহিষের চীৎকারের সঙ্গেই শুধু তার তুলনা চলে। নাবিকেরা সমুদ্রের যে চরিত্রকে ধ্বংসশীল বলে বর্ণনা করে সেই চরিত্র আমি পালটে যেতে দেখলাম। মনে হল ঢেউয়ের উত্তাল থেমে গিয়ে দ্রুতগতিতে একটা বিরাট শ্রোতোধারা পূর্বমুখী হয়ে ছুটে চলেছে। দেখতে দেখতে তার গতি অকল্পনীয় প্রচণ্ডতা লাভ করে প্রতিমুহূর্তে ভীষণ থেকে ভীষণতর হয়ে উঠতে লাগল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভাগ পর্যন্ত পুরো সমুদ্রটা অশান্ত উন্মত্ততায় বীভৎস হয়ে উঠল। অবশ্য এই বীভৎসরূপের চরম প্রকাশ ঘটল মস্কো আর তীরভূমির মধ্যে। এদের ভেতরকার সমুদ্র হঠাৎ প্রবল স্রোতে ছুটে চলল পূর্বমুখী হয়ে আর তার সেই উন্মত্ত দ্রুতগামিতার সঙ্গে গর্জন আর উচ্ছ্বাস মিশে গিয়ে যে ভীষণরূপ ধারণ করল, সাধারণত ঘূর্ণাবর্ত ছাড়া অন্য কোথাও ওরকমের ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যায় না।
পরের কয়েক মিনিটের মধ্যে দৃশ্যটার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেল। জলের ওপর যে আলোড়ন দেখা যাচ্ছিল তা অনেকখানি থেমে গেল আর তার পরিবর্তে মাঝে মাঝে অনেকখানি করে ফেনা জমে উঠল। পরমুহূর্তে সেই ফেনপুঞ্জগুলি অনেকদূর ছড়িয়ে পড়ে একটি ঘূর্ণাবর্তের আকর্ষণে আবর্তিত হতে থাকল আর সৃষ্টি করল একটি বিশালতর ঘূর্ণাবর্তের। একটু পরেই হঠাৎ স্পষ্টতর হয়ে উঠল প্রায় আধ মাইলের বেশী: ব্যাসের একটা বিরাট আবর্ত। এই ঘূর্ণাবর্তের মাঝখানটা গড়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর একটা ফানেলের মত আর এর প্রান্ত ভাগ বেশ চওড়া হয়ে জল ছড়াতে ছড়াতে ছুটে চলেছিল তীব্র বেগে। ভেতরের দিকে যতদূর দৃষ্টি চলে তাতে দেখা যাচ্ছিল কালো মসৃণ চকচকে জলরাশি, আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণ করে দিচক্রবালের দিকে বেঁকে উঠে গেছে আর প্রবল বেগে আবর্তিত হয়ে চলেছে। সেই আবর্তনের বিপুল আবেগে কিছুটা আর্তনাদের আর কিছুটা গর্জনের মত এমন একটা শব্দ সৃষ্টি হয়ে আকাশে উখিত হচ্ছিল যার কাছে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের ধ্বনিও ম্লান হয়ে যায়।