কিন্তু এর পরই আমার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হোল । ধীরে ধীরে আমার চিন্তার মধ্যে এক ধরণের ভীতিপ্রদ ও যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি গড়ে উঠল। আমার মন থেকে ওটাকে দূর করতে পারছিলাম না বলেই বড় বেশী যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছিল সে চিন্তা। এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে আমি দূরে রাখতে পারছিলাম না। স্মৃতির মধ্যে যা সঞ্চিত ছিল অত্যন্ত সংগোপনেই তাকে জাগিয়ে তুলছিল কোন গানের একটা কলি বা কোন নাটকের একটি ছোট্ট দৃশ্য। আর যন্ত্রণায় আমি কাতর হয়ে পড়ছিলাম। সেই গান আর নাটক যত উচ্চশ্রেণীর হোক না কেন যন্ত্রণার পরিমাণ তাতে হ্রাস পেত না। ধীরে ধীরে আমার নিরাপত্তার চিন্তা আমার মনকে অধিকার করে বসল আর কখনো কখনো নীচু গলায় নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিতে থাকলাম ‘তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
পথে বেড়ানোর সময় একদিন মনে হল সেই স্বগতোক্তির অভ্যাস আর একটু বেড়েছে–আমার কণ্ঠস্বর উচ্চতর হয়েছে আর বক্তব্যেরও কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আমি মাঝে মাঝে বলছি, আমি যদি নিজে মূখের মতো খোলাখুলি ভাবে অপরাধ স্বীকার না, করি, আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
হঠাৎ মনে হোল এই কথাগুলো উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের মধ্যে একটা হিমপ্রবাহ বয়ে গেল। এই ধরণের বিকৃত অনুভূতির অভিজ্ঞতা আমার ছিল তাই একে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলাম প্রাণপণ শক্তিতে। বার বার মনে হোল নিহত ব্যক্তির আত্মা আমাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করছে আর সম্ভবত কোন এক দুর্বল মুহূর্তে আমি অপরাধ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করেই বসব।
এই চিন্তাকে প্রথমে সবলে পরিহার করতে চাইলাম আর পথচলার গতি দিলাম বাড়িয়ে। কিন্তু সে চিন্তা ক্রমশ প্রবলতর হয়ে উঠল আর আমি একসময় দৌড়াতে শুরু করলাম। পরপর কতকগুলো চিন্তা আমাকে উত্তেজিত করে তুলল আর নিজের ওপর কর্তৃত্বও যেন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। গতিবেগ তখন আরও বেড়েছে। পথের জনস্রোত ভেদ করে উন্মাদের মত তখন প্রায় দৌড়ে চলেছি আমি। পরমুহূর্তে জনসাধারণের মধ্যেও ভীতির সঞ্চার হোল আর তারাও আমাকে অনুসরণ করতে শুরু করল।
বুঝলাম, নিয়তি আমাকে চরম অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি যদি আমার জিহ্বাটিকে ছিন্ন করে ফেলতে পারতাম, হয়ত এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমার কানে কানে কে যেন নির্মমকণ্ঠে কী বলে উঠল, আমার গতি মন্দীভূত হোল। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। পেছন ফিরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে চাইলাম সহজভাবে কিন্তু পরমুহূর্তেই শ্বাসরোধ হয়ে অসার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লাম। আমি যেন একই সঙ্গে অন্ধ, বধির আর মূছাহত হয়ে গেলাম আর ঠিক তখনই কে যেন আমার পেছনে প্রবল আঘাত করল। সুদীর্ঘকালীন অবরুদ্ধ গুপ্ত তথ্য সম্পূর্ণভাবেই প্রকাশিত হয়ে গেল ।
ওরা বলে, আমি নাকি খুব স্পষ্টভাবে একটু দ্রুতগতিতে সব কথা জানিয়েছিলাম। পাছে বক্তব্য শেষ করার আগে কেউ বাধা দেয় তাই আবেগের সঙ্গে আমি নাকি সবটুকু তাড়াতাড়ি বলে নিয়েছিলাম। আর তার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ আজ আমার নিয়তি যুপকাষ্ঠের সঙ্গে নিবদ্ধ হয়ে গেছে। আমার আইনসঙ্গত বিচারের জন্য যেটুকু ‘ক্তব্য প্রকাশ করা দরকার তা করার পরই আমি নাকি সংজ্ঞাহীন হরে যাই। আর কিছু বলার কি প্রয়োজন আছে? শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় আমি এখানে আছি। আগামী কাল এ শৃঙ্খল আমার থাকবে না কিন্তু তখন আমি থাকবো কোথায়?
ঘূর্ণাবর্তের অতলে
সব চাইতে উঁচু পাহাড়ের চূড়োয় আমরা তখন পৌঁছে গেছি। বৃদ্ধ বড্ড বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মিনিট তিনি কোন কথাই বলতে পারছিলেন না।
‘খুব বেশী দিন আগের কথা নয়’, বৃদ্ধ বলে উঠলেন, তোমাকে, এমন কি আমার কনিষ্ঠ পুত্রটিকেও আমি এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আসতে অনায়াসে সাহায্য করতে পারতাম। বছর তিনেক আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মানুষের জীবনে অতবড় দুর্ঘটনা কখনও ঘটে না, ঘটে থাকলে তার বর্ণনা দেবার জন্যে সে বেঁচে থাকেনা। ঘণ্টা ছয় ধরে যে ভয়ঙ্কর পরিবেশের সঙ্গে আমাকে লড়াই করতে হয়েছিল তাতেই আমার দেহমন পুরো ভেঙে পড়েছে। আমাকে যতটা বৃদ্ধ মনে হচ্ছে আসলে আমি ততটা বৃদ্ধ নই। পুরো চব্বিশ ঘণ্টাও লাগেনি তারও আগে আমার ঘন কালো চুল সাদা হয়ে গেল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হয়ে গেল শিথিল আর স্নায়ুর দৌর্বল্য আমাকে– পুরো পেড়ে ফেলল। আজ আমি অল্প পরিশ্রমে ভেঙে পড়ি, ছায়া দেখলেও শঙ্কিত হই। এখান থেকে তলার দিকে তাকালে আজ আমার মাথা ঘুরে যায়, এ তুমি বিশ্বাস করতে পার?
পাহাড়ের যে ছোট্ট চুড়োটার ওপর তিনি অত্যন্ত অসাবধানে নিজের ভারি শরীরটাকে বিশ্রামের জন্য টেনে এনে ফেলেছিলেন, সেটার ওপর তার শরীরখানা আলতোভাবে ঝুলে ছিল। কনুই দিয়ে পিছল চুড়ো থেকে পতনের সম্ভাবনাটাকে তিনি কোনরকমে রোধ করছিলেন। যেটাকে আমি ছোট চূড়ো বলছি সেটা ছিল একটা কালো চকচকে গিরিচূড়া। উচ্চতায় পনেরো থেকে ষোল শ’ ফুট। এই চুড়োটা অনেকগুলো চূড়োর রাজ্যে বেশ খানিকটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে গজ ছয়েক দূরে সমতল অংশটা ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গী যে বিপজ্জনক অবস্থায় বসেছিলেন সেইটের দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। এই উত্তেজনার ফলে আকস্মিকভাবেই আমি পিছলে পড়লাম, আর বহু কষ্টে পাশের ঝোঁপঝাড়গুলোকে আঁকড়ে ধরে একেবারে নীচে গড়িয়ে পড়ার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখলাম। উঁচুতে আকাশের দিকে তাকানোর মত সাহস তখন আর আমার ছিলনা। মনে হচ্ছিল বাতাসের প্রচণ্ড বেগে পাহাড়ের ভিতটাই কেঁপে উঠছে যেন। একটু পরে দুর্বলতা কাটিয়ে আর সাহস সঞ্চয় করে আমি উঠে বসলাম আর দূরের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।