ঐটুকু সময়ের মধ্যে যে যন্ত্রণাভোগ আমাকে করতে হয়েছিল তা কবরের যন্ত্রণারই সমতুল্য। তেমনি জঘন্য আর ভীতিপ্রদ কিন্তু এই চরম যন্ত্রণার অধ্যায় থেকেই জন্ম নিয়েছিল একটি অপূর্ব সুন্দর পরিচ্ছেদ। যন্ত্রণার অসহনীয় অবস্থার মধ্যে আমার সব কিছুই সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আমার দেহমন এক নতুন অধ্যায়ে উপনীত হল। আমি বিদেশে চলে গেলাম। প্রচুর পরিমাণে ব্যায়াম করা শুরু করলাম আর এর ফলে নির্মল আনন্দ উপভোগ করার শক্তি অর্জন করলাম আমি অল্প দিনের মধ্যেই। মৃত্যুপ্রসঙ্গ বর্জন করে আমি অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম। চিকিৎসা সংক্রান্ত যে বইখানা আমার ছিল সেটি আমি পুড়িয়েই ফেললাম। “রাত্রির চিন্তা বা এতক্ষণ যে সব কাহিনীর কথা বললাম এসব কাহিনী পরিপূর্ণ পুস্তক পুস্তিকা আর আমি খুলিনি। সংক্ষেপে বলা যায় যে আমি আমার জীবনের পথ সম্পূর্ণভাবেই পরিবর্তিত করে মানুষের মত বাঁচার চেষ্টায় নিযুক্ত হলাম। সেই রাত্রির পর থেকে মৃত্যুর চিন্তা আর কবরভীতি চিরদিনের মত অন্তর্হিত হোল আর সেই সঙ্গে মুক্ত হলাম চেতনালোপ ঘটিত ব্যাধি থেকে।
যুক্তিনির্ভর চিন্তাও কোন কোন দুর্বল মুহূর্তে এই জগতে নরকের চিত্ৰই দেখে। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে মনের মধ্যে যে সব গুহা গহর আছে তার সন্ধান নিতে গেলে তাকে শাস্তি পেতেই হয়। কবরখানার ভীতিকে তত সম্পূর্ণ অলস কল্পনা কখনই বলা যায় না। তবুও প্রার্থনা করি, ওখানে যারা আছে তারা শান্তিতে নিদ্রা যাক, নইলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
আশ্চর্য মানসিকতা
আমরা পাহাড়ের চূড়ায় বিপজ্জনকভাবে একটি প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের দৃষ্টি দূরবর্তী তলদেশে নিবদ্ধ। এর ফলে আমরা অসুস্থ আর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ি। আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তিকামনাটিই প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সে অবস্থা বর্ণনাতীত। ধীরে ধীরে আমাদের ভীতি, অসুস্থতা আর অপ্রকৃতিস্থতা স্তিমিত হয়ে বিশেষ এক ধরণের অনুভূতিতে পরিণত হয়। আরব্যরজনীর মধ্যে বোতল থেকে ভৌতিক আবির্ভাবের যে বর্ণনা আছে অনেকটা তারই মত পূর্ববর্ণিত অনুভূতি আমাদের চিন্তার মধ্যে ধীরে ধীরে একটা রূপ পরিগ্রহ করে। গল্প-কাহিনীর মধ্যে বর্ণিত ভৌতিক মূর্তির তুলনায় এই চিন্তালগ্নরূপটি কিন্তু অনেক বেশী ভয়ঙ্কর। সেই ভয়ঙ্কর একধরণের আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রনে যে ভীষণতা লাভ করে তার সামগ্রিক প্রভাবে আমাদের অস্থিমধ্যস্থিত মজ্জাও হিম হয়ে আসে। পর্বতশিখর থেকে পতনের মুহূর্তে আমাদের অনুভূতির স্বরূপটি এই শ্রেণীর। এই পতন, ধ্বংসের অনিবার্য পরিণতির দিকে এই দুর্বার যাত্রা প্রকৃত মৃত্যুর চাইতেও জঘন্য ও বীভৎস। এর চাইতে জঘন্যতর মৃত্যু অকল্পনীয়। হয়ত এই জন্যেই পতনের মুহূর্তে মৃত্যুকামনাটি এত তীব্র হয়ে ওঠে। আমাদের ভাবরুজগতে এর চাইতে ভয়ঙ্কর এবং ধৈর্যহীন আবেগ আর কিছু নেই।
এই অনুভূতির স্বরূপ পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে যে এ সবই চরিত্র-বিকৃতির লক্ষণ। কাজটা করা উচিত নয় একথা জানি বলেই যেন কাজটা করার জন্যে আমাদের আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে। এর পেছনে বোধগম্য কোন রকমের যুক্তিই নেই। সম্ভবত আমাদের ভেতরে যে অস্থির বুদ্ধি আছে এর মধ্যে তারই প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
আমি এখানে কেন আছি তার কৈফিয়ত হিসেবে আমার কথাগুলোকে গ্রহণ করলে আমার বন্দীদশার একটা অর্থ বুঝতে পারা যাবে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দীর সঙ্কীর্ণ কক্ষের মধ্যে আমার উপস্থিতির কারণগুলো পূর্বাপর চিন্তা না করতে পারলে আমাকে হয়ত উন্মাদই ভাববেন আপনারা।
যে পরিমাণ সুচিন্তিত পরিকল্পনার সাহায্যে বর্তমান কর্মটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা তুলনাহীন। হত্যা করার পূর্বে তার উপায় সম্পর্কে আমি সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস চিন্তা করেছি। হাজারটা পথ আমি এই জন্যেই পরিত্যাগ করেছি যে সেগুলোর ক্ষেত্রে ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। শেষে একটা ফরাসী পত্রিকায় মাদাম পিলোর মারাত্মক অসুস্থতার কথা পড়ি। আকস্মিকভাবে একটা মোমবাতি বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার দরুণ এটা ঘটে। কাহিনীটি পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি পথের সন্ধান পেয়ে যাই। আমি যাকে হত্যা করতে চাইছিলাম রাত্রে বিছানার মধ্যে কিছু পড়াশোনা করার অভ্যাস ছিল তার। আর এ খবরও আমার জানা ছিল যে তার শয়নকক্ষ অপরিসর আর বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা সেখানে অপ্রচুর।
যাক, এসব ছোটখাটো অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই। যে কোন উপায়ে হোক আমি ওর বিছানার পাশে রাখা বাতিদান থেকে বাতিটি সরিয়ে আমার নিজের তৈরী একটা বাতি সেখানে বসিয়ে দিতে পেরেছিলাম। পরের দিন বিছানায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। করোনারের রিপোর্টে এ মৃত্যুকে ঈশ্বরদত্ত স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই বর্ণনা করা হয়েছিল।
তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার পর বেশ কয়েক বছর আনন্দেই কেটে গেল। কোন দিন যে আমার অপরাধের সন্ধান কেউ জানতে পারবে ঘুণাক্ষরেও সে চিন্তা আমার মস্তিষ্কে স্থান পায়নি। মারাত্মক সেই মোমবাতির অবশিষ্টাংশ আমি সযত্নে নষ্ট করে ফেলেছিলাম। আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার বা সাজা দেবার মত কোন সাক্ষ্যপ্রমাণই আমি রাখিনি। আমি নিরাপদ–এই চিন্তা আমাকে কী পরিমাণ পরিতৃপ্তি দিয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারবো না। এই আত্মতৃপ্তি নিয়ে কেটে গেল দীর্ঘকাল। সম্পত্তির উত্তরাধিকার যে সব পার্থিব ভোগবিলাসের আনন্দ আমাকে এনে দিয়েছিল, এ আনন্দ তার চাইতেও বড়।