আগে যেমন ঘটেছে ঠিক তেমনি করে রোগ ভোগের পর ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে আসতে লাগল। বিলুপ্ত চেতনার রাজ্য থেকে একটা দুর্বল আর অনিশ্চিত অস্তিত্বের জগতে প্রত্যাবর্তন ঘটতে থাকল আমার। সে প্রত্যাবর্তন এমন কুর্ম-গতির মন্থরতায় আমার মনোরাজ্যের উষালোক সৃজন করল যাতে আমার মধ্যে একধরণের নতুন অস্বস্তির সৃষ্টি ঘটল। চেষ্টাহীন, যত্নহীন, নৈরাশ্য-পীড়িত একধরণের মানসিকতা আমাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই অস্বস্তির যন্ত্রণা সহ্য করতে বাধ্য করল। এরপর দীর্ঘ বিশ্রামের অবসানে শুরু হোল কানের মধ্যে ঘণ্টাধ্বনি, আবার কিছু সময়ের পর সমস্ত শরীরের মধ্যে একটা অবর্ণনীয় অনুভূতি। এরপর কিছু সময় অতিবাহিত হোল অবিচ্ছিন্ন শান্ত আনন্দময় মানসিকতার মধ্যে কিন্তু তারপরই চলে গেলাম বিস্মৃতির অন্ধকারময় জগতে। এ থেকে মুক্তি এলো অনেক পরে। এ সময় চোখের পাতাগুলো নড়ে উঠত আর মারাত্মক অথচ অনিশ্চিত ভাতির আত্যন্তিকতায় দেহের সমস্ত রক্ত যেন বুকের মধ্যে গিয়ে সঞ্চিত হয়ে যেত। একটু চিন্তা, একটুখানি স্মৃতির প্রত্যাবর্তন, তারপর স্পষ্টতর চেতনার রাজ্যে ফিরে গিয়ে অনুভব করা যে এ জাগরণ সাধারণ নিদ্রার আলিঙ্গন থেকে নয়, চেতনাশূন্যতার আক্রমণ থেকে। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের মত আবার সেই ভীতি ফিরে আসত, আবার আচ্ছন্ন করে ফেলত আমার চিন্তা জগৎকে।
অলস কল্পনাগুলোর এই সব মুহূর্তে আমি নড়াচড়াও করতাম না শুধু এই জন্যেই যে তা করার সাহস আমার থাকত না। কে যেন আমার কানে কানে বলে যেত যে আমি বেঁচে আছি তবু আমি অচল অনড় অবস্থায় পড়ে থাকতাম। এই দীর্ঘ বিমূঢ় অবস্থার অবসানে হতাশা নিয়েই চোখ মেলে চাইতাম। আমি জানতাম যে ব্যাধির আক্রমণ থেকে আমি সাময়িকভাবে মুক্ত তবু আমার চারদিকে শুধু অন্ধকারই দেখতাম আমি। আমার দৃষ্টি শক্তি অক্ষত থাকা সত্ত্বেও সেই নিরন্ধ্র অন্ধকারের যন্ত্রণা আমাকে সহ্য করতেই হোত। বুকের ওপর জগদ্দল পাথরেরবোঝা অনুভব করতাম। শুকনো জিভ আর ঠোঁট নেড়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত গলা দিয়ে কোন শব্দই বেরুত না। আমার প্রাণপণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেত।
গলা ছেড়ে কেঁদেও উঠতে পারতাম না আমি। তা করবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেছি মৃত ব্যক্তির মতই আমার মাড়ি দু’টো আটকে আছে। মনে হোত আমি কোন কঠিন বস্তুর ওপর শুয়ে আছি আর আমার চারপাশও সেই রকম বস্তু দিয়ে আটকানো। এ পর্যন্ত আমার শরীরে কোন চাঞ্চল্য ছিল না। এখন আড়াআড়িভাবে হাত দু’টোকে আলগা করে নিয়ে ওপরে ওঠাতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। আমার মুখের ওপর প্রায় ইঞ্চি ছয়েক উঁচুতে নিরেট কাঠের কোন জিনিসে সেগুলো গিয়ে ঠেকল। এখন আর আমার সন্দেহ রইল না যে আমি কফিনের মধ্যেই রয়েছি।
আমার নিঃসীম দুঃখের জগতে হঠাৎ আশার আলো জ্বলে উঠল। যে সব সাবধানতা আমি অবলম্বন করেছিলাম, সেগুলোর কথা মনে পড়ল এক এক করে। শরীরটাকে একটুখানি নড়িয়ে আমি প্রথমেই কফিনের ডালাটা খুলে ফেলতে চাইলাম কিন্তু তা সম্ভব হোল না। আমার হাতে নিশ্চয় ঘণ্টার দড়ি জড়ানো আছে। আমি চাইলাম সেটি স্পর্শ করতে। তার নাগাল পেলাম না আমি। আশার আলো নিভে গেল পর মুহূর্তেই আর সেখানে বিস্তৃত হোল বিজয়ী হতাশার স্থায়ী রাজত্ব। কোথায় গেল অত্যন্ত সাবধানে বানিয়ে রাখা সেই আরামদায়ক উষ্ণ নরম আস্তরণ? কিছু নেই। তার বদলে আম্রাণ পেলাম ভিজে মাটির সুতীব্র দুঃসহ গন্ধের। এরপর তো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে বিলম্ব হওয়া উচিত নয়। আমার কফিন পারিবারিক ভল্টের মধ্যে নেই। বাড়ীর বাইরে কখনো কোন এক জায়গায় আমি চেতনা হারিয়েছি সম্পূর্ণ অপরিচিতদের মাঝখানে। ওরা সাধারণ একটা কফিনের মধ্যে বন্ধ করে ভালোভাবে পেরেক ঠুকে মরা কুকুরের মত অজ্ঞাত কোন কবরের অনেক অনেক গভীরে পুতে ফেলেছে আমাকে।
এই ভীতি যখন হৃদয়ে পূর্ণ বিশ্বাসের স্তরে গিয়ে পৌঁছল তখন আর একবার চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে চাইলাম আমি। এবার কিন্তু আমি সফল হ’লাম। ভূগর্ভস্থ রাত্রির বুক চিরে একটা দীর্ঘ আর্তনাদ ধ্বনিত হোল। একটি রূঢ় কণ্ঠস্বর পর মুহূর্তেই শোনা গেল, হালদা কে সে? ঠিক পরেই দ্বিতীয় কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কিসের গোলমাল শুরু হোল এখানে? তৃতীয় কণ্ঠস্বরও শোনা গেল, বেরিয়ে যাও সব এখান থেকে। এইখানেই থেমে গেল না সবাই, পরের কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করল, এ রকম বিশ্রীভাবে যে সব চেঁচিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার মানেটা কী? এর পরমুহূর্তে কয়েকজন রুক্ষমূর্তির মানুষের একটি দল দেখে আমি নিতান্তই ভীত হয়ে পড়লাম। আমি জেগেই ছিলাম তাই আমাকে নতুন করে জাগিয়ে তোনার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু ওরা আমার স্মৃতিশক্তির প্রত্যাবর্তনে সহযোগিতা করল।
ঘটনাটা ঘটেছিল ভার্জিনিয়া এলাকার রিচমণ্ডের কাছে। জেমস্ নদীর তীর বরাবর বেশ কয়েক মাইল নীচের দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে আমি সেদিন শিকারে বেরিয়েছিলাম। সন্ধ্যের দিকে আমরা হঠাৎ একটা ঝড়ের মুখে পড়ি। পাশেই নদীতে একটা নৌকো নোঙর করা ছিল। আমরা সেখানে রাতের মতো আশ্রয় নিলাম। নৌকোটাতে বাগানের জন্য ছাতাধরা ভেজা মাটি ভর্তি ছিল। দুটো মাচানের মধ্যে আমি একটা শোবার জন্যে দখল করলাম। ওটা শোবার মত জায়গাই নয়। চওড়ায় হাতখানেক আর নৌকোর তলা থেকে ও হাতখানেক উঁচুতে ওই মাচানে শুতে গিয়ে নিজেকে অনেকখানি সঙ্কুচিত করে নিতে হয়েছিল আমাকে। অবশ্য ঘুম আমার হয়েছিল বেশ ভালোই কিন্তু আমি যা দেখছিলাম তা পুরোটাই আমার পরিবেশ, স্বপ্ন নয়। এটা ঠিক যে কোন কিছু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা আমার অভ্যাস। এর ফলে আমার পরিবেশ আর দৈহিক অসুবিধেগুলো নিয়ে আমি নিজের মত করে চিন্তা করে চলেছিলাম। আগেই বলেছি ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরও স্মৃতিশক্তির পুরোটা ফিরে পেতে চিরকালই আমার বিলম্ব হোত। যারা আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল তারা ছিল সবাই নৌকোর লোক। নৌকো থেকে বাগানের জন্যে মাটি নাবিয়ে নেবার জন্য তারা নিযুক্ত হয়েছিল। যে গন্ধ আমার নাকে লাগছিল তা ছিল ঐ নৌকোর মধ্যেকার মাটিরই। মাথায় রাত্রে পরবার মত টুপী ছিলনা বলে আমিই মাথা আর চিবুকের ওপর দিয়ে নিজের রুমালখানাকে বেঁধে নিয়েছিলাম।