সাময়িকভাবে চেতনাহীন হওয়া ছাড়া আমার দেহে অন্য কোন প্রকার ব্যাধি ছিল না। সাধারণভাবে বরং আমার স্বাস্থ্য ভালোই ছিল। আমি তখন বুঝতে পারিনি যে আমার ঘুমের মধ্যেই ঐ ব্যাধির বীজ নিহিত। আমার ঘুম ভাঙলে আমি কখনোই দ্রুতগতিতে চেতনা ফিরে পাইনি। বেশ কয়েক মিনিট কেটে যেত আচ্ছন্ন অবস্থায়। মানসিক ক্রিয়া, বিশেষ করে স্মৃতিশক্তির প্রত্যাবর্তন ঘটত অত্যন্ত বিলম্বে।
এসবের জন্যে আমার দৈহিক কষ্ট কিছুই ছিল না, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা ছিল অপরিসীম। আমার কল্পনার জগতে একটি কঙ্কাল শালা গড়ে উঠেছিল, যার ফলে আমার আলাপ-আলোচনার মধ্যে অনিবার্য ভাবেই ‘কবর’, ‘কীট’, ‘কবরের প্রস্তর ফলক’ এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হোত। মৃত্যু, অকাল সমাধি–এই সব চিন্তা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ালো। দিনের বেলা এগুলো নিয়ে চিন্তা করতাম, ফলে রাত্রে সেগুলো মনের ওপর পাথরের মত চেপে বসে থাকত। যেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসত পৃথিবীর ওপর, আমার সমস্ত শরীর শবাধারের মোমবাতির সামনে কম্পমান পালকের মত কেঁপে কেঁপে উঠত। জেগে থাকার মত শক্তি যখন আর থাকত না তখনই ঘুমুতে বাধ্য হতাম আমি। কিন্তু ঘুমুতে যাবার সময় এই ভীতিটিই প্রবল হয়ে উঠত যে হয়ত ঘুম ভাঙলে দেখব আমি কবরের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েছি। ঘুমের মধ্যে আমি অনতিবিলম্বেই চলে যেতাম একটা অলীক ছায়ামূর্তির জগতে, যেখানে কেবলমাত্র সমাধিক্ষেত্রের চিন্তা আমার মনের মধ্যে কৃষ্ণবর্ণের পক্ষবিস্তার করে উড়ে বেড়াত। মৃত্যুর যে বিভিন্ন রূপ আমার মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াতে তার মধ্যে একটির কথাই এখানে উল্লেখ করছি। যদ্দর মনে পড়ে আমি একবার চেতনাহীন অবস্থায় দীর্ঘতর সময় অতিবাহিত করে ছিলাম। সেই অবস্থার মধ্যে হঠাৎ একটা হিমশীতল হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম আর শুনতে পেলাম দ্রুততার সঙ্গে উচ্চারিত কিছুটা অস্পষ্ট একটি আদেশ, ‘জেগে ওঠ’ । ঘন অন্ধকারের মধ্যে আমি সোজা হয়ে উঠে বসলাম। যে আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল তাকে দেখতে পেলাম না। আমি ঠিক কোথায় আছি আর কতক্ষণই বা আমার চেতনা লোপ পেয়েছিল, কিছুই স্মরণ করতে পারলাম না। স্থিরভাবে বসে থেকে আমি প্রাণপণ শক্তিতে যখন আমার স্মৃতিশক্তি ফিরে পেতে চেষ্টা করছি, তখন সেই ঠাণ্ডা হাতটি আমার কব্জি জোর করে চেপে ধরল আর তেমনি দ্রুত ও অস্পষ্ট কণ্ঠে আদেশ ধ্বনিত হোল, “ওঠ! তুমি কি শুনতে পাচ্ছনা যে তোমাকে জেগে উঠতে বলছি?
‘কিন্তু আপনি কে?’ প্রশ্ন করলাম আমি। শোকক্লিষ্ট কণ্ঠের উত্তর শোনা গেল, আমার যে জগতে বাস, সেখানে কোন নাম নেই আমার। ছিলাম মানুষ কিন্তু হয়েছি দানব। ছিলাম দয়ামায়াহীন, হয়েছি স্নেহপ্রবণ। আমি যে কঁপছি তা তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। কথা বলতে গিয়ে র্দাতে দাঁত ঠেকে যাচ্ছে। কিন্তু তার কারণ আজকের এই শীতল রাত্রিটি নয়, সীমা সংখ্যাহীন রাত্রিই তার কারণ। এ অবস্থা অসহনীয়। কেন তুমি শান্তিতে ঘুমোতে পার না? তোমাদের মানসিক কষ্টের অভিঘাতে আমার শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। তোমাদের যন্ত্রণাভোগের দৃশ্যও আমি সহ্য করতে পারিনা। উঠে দাঁড়াও। আমার সঙ্গে বাইরে রাত্রের পরিবেশে বেরিয়ে এসো। সেখানে তোমাকে কবরগুলোর ভেতরের দৃশ্য দেখাব। বড় শোচনীয় দৃশ্য! তবু দেখ তুমি!
যে অদৃশ্য মূর্তি আমার হাতটিকে তখনো মুঠো করে ধরে রেখেছিল, সে মুহূর্তের মধ্যে অতীতমানব সম্প্রদায়ের সমস্ত কবর উন্মোচিত করে ফেলল। আমি তাকিয়ে দেখলাম প্রতিটি কবর থেকে মৃদু আলোর রশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর সেই আলোতে কবরগুলোর শোকাবহ নীরব আবেষ্টনীর মধ্যে দেখতে পেলাম নিদ্রিত মানুষ আর কৃমিকীটের সহাবস্থান। কিন্তু হায়, নিদ্রিত মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত অল্পই দেখা গেল। লক্ষ লক্ষ মানুষ মোটেই নিদ্রিতাবস্থায় ছিল না। তারা চাইছিল কবরের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে। সেই চেষ্টার ফলে সমস্ত এলাকা জুড়ে একটা চাঞ্চল্য আর বেদনাময় পরিবেশ সৃজিত হয়েছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শবাচ্ছাদন-বস্ত্রনির্গত মর্মর শব্দ। যারা তখনো নিদ্রিত তাদের কিন্তু দেহভঙ্গীর পরিবর্তন স্পষ্টই দেখতে পেলাম। সাধারণত যে অনমনীয় আর অস্বস্তিকর ভঙ্গীতে মানুষকে কবরস্থ করা হয়, তার পরিবর্তন ঘটেছিল কমবেশী প্রায় সকলেরই।
আমি যখন এই সব দৃশ্য দেখছি তখন আবার শুনতে পেলাম, এগুলো মোটেই কি করুণ দৃশ্য নয়? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই কিন্তু সেই মূর্তি আমার হাত ছেড়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষীণ আলোর রশ্মি মিলিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই সমস্ত কবরের দরজা একই সঙ্গে রুদ্ধ হয়ে গেল আর সেগুলি থেকে হতাশামিশ্রিত সমবেত কণ্ঠে প্রশ্ন ধ্বনিত হল, হায় ভগবান, এই দৃশ্য কি করুণ নয়?
এই ধরণের অলীক স্বপ্ন রাতের বেলায় দেখলেও তার প্রভাব দিনের জাগ্রত মুহূর্তগুলোকেও আচ্ছন্ন করে রাখত। এর ফলে আমার এলো স্নায়বিক দৌর্বল্য আর ভীতিপ্রবণতা। যে কোন প্রকার শারীরিক ব্যায়ামের জন্যে ঘরের বাইরে যেতে হয় বলেই আমি ঘোড়ায় চড়া এমন কি বেড়ানোও পরিত্যাগ করলাম। প্রকৃতপক্ষে যারা আমার রোগের কথা জানে তাদের ছেড়ে বাইরে পা বাড়াতেই আমার ভয় হচ্ছিল তখন। কেবল ভয় হোল এদের অনুপস্থিতিতে যদি আমি চেতনা হারাই সেই অবস্থায় হয়ত আমাকে অন্যের কবরে শুইয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত যারা আমার প্রিয়তম বন্ধু তারা কতটা বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমার যত্ন নেবে, সে বিষয়েও সন্দেহ সৃষ্ট হোল। সাধারণ অপেক্ষা দীর্ঘতর সময়ের জন্য চেতনাহীন থাকলে ওরা হয়ত ধরে নেবে যে আমার চেতনা আর ফিরবে না। এমন ভয়ও করতে শুরু করলাম যে আমার অসুস্থতার সময় তারা খুবই বিব্রত হয়ে পড়ে তাই হয়ত দীর্ঘসময়ের চৈতন্যহীনতার সুযোগে তারা আমার হাত থেকে মুক্তি পেতেই চাইবে। আন্তরিক প্রতিশ্রুতি দিয়েও বন্ধুরা আমার মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে পারছিল না। ওদের দিয়ে আমি এই শপথ করিয়ে নিলাম যে আমার শরীর যতক্ষণ না পচে ওঠে আর দেহটাকে ঘরে রাখা অসম্ভব মনে না-হয়, ওরা আমাকে কবরে শুইয়ে দেবেনা। কিন্তু তবুও এই মারাত্মক ভীতি আমার রয়েই গেল। কোন রকমের সান্ত্বনাই আমি পেলাম না। আমি কিছু কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে লাগলাম। আমাদের যে পারিবারিক ভল্টটা ছিল সেটাতে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করলাম যাতে প্রয়োজন হলে ভেতর থেকেও কেউ সেটাকে খুলে ফেলতে পারে। একটা লম্বা হাতল এমন করে লাগিয়ে নিলাম যে কফিন রাখার জায়গা থেকে হাত বাড়িয়ে একটু চাপ দিলেই লোহার দরজা যেন খুলে যায়। ওর মধ্যে যাতে যথেষ্ট পরিমাণে আলো বাতাস যায় তার ব্যবস্থা করা হোল আর কিছু খাদ্য-পানীয় এমনভাবে রাখা থাকল যাতে আমার জন্য নির্দিষ্ট কফিন থেকে হাত বাড়িয়ে সেগুলোর নাগাল পাওয়া যায়। কফিনের ভেতর উষ্ণ আর নরম কাপড়ের আস্তরণ লাগানো হোল আর ওর ঢাকনাটায়ও ওই লোহার দরজা খোলার মত ব্যবস্থা রইল। এমন স্প্রীংয়ের কজা ওতে লাগানো হোল যাতে শরীরের অল্প একটু নড়াচড়াতেই কফিনের ঢাকনা পুরো খুলে যায়। এরপর ভল্টের ছাদে একটা ঘণ্টা লাগিয়ে তার দড়িটা একেবারে কফিনের ভেতর নিয়ে গিয়ে মৃতদেহের হাতের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা হোল। কিন্তু এসব দিয়েই কি মানুষের দুর্ভাগ্যকে সত্যিই ঠেকিয়ে রাখা যায়? এত আয়োজন, এত সাবধানতা সত্ত্বেও চিন্তার রাজ্য থেকে জীবন্ত কবরের ভীতি দূরীভূত হল না। সেই আশঙ্কাজনিত মানসিক যন্ত্রণা আমাকে অহরহ পীড়া দিতে থাকল।