প্রিন্স এই সময় দাঁড়িয়ে পূর্বপ্রান্তের নীলরঙের ঘরটিতে। উনি হাত নেড়ে সঙ্গীত বন্ধ করে দিয়েছিলেন অনেক আগে। এর ফলে ওঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সবক’টি কামরার মধ্যে পরিস্কার ভাবে ছড়িয়ে পড়ল। তার আদেশ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা কিছুটা সেই অবাঞ্ছিত প্রবেশকারীর দিকে অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। দেখা গেল সেই অবাঞ্ছিত মুখোশধারী ধীর রাজকীয় পদক্ষেপে, প্রিন্সের দিকে এগিয়ে আসছে। এমন এক অস্বাভাবিক আর অবর্ণনীয় ভীতিতে সমস্ত মানুষ অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে মুখোশধারীর গায়ে হাত দেবার শক্তিটুকুও কারো ছিল না। সে অগ্রসর হয়ে এলো আর সমগ্র জনতা একই আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে দেয়ালের দিকে সরে গিয়ে ঘরের মাঝখানে এর জন্যে স্থান করে দিল। এগিয়ে চলল সে মুখোশধারী, চলল সেই উদ্ধত রাজকীয় ভঙ্গীতে। নীল ঘরের প্রান্তে সে পৌঁছল গিয়ে বেগনীলাল ঘরের মধ্যে। তারপর সবুজ, কমলা, সাদা আর বেগনী রঙের ঘরে পৌঁছনো সত্ত্বেও ওকে বন্দী করার কোন চেষ্টাই হলনা।
প্রিন্স প্রস্পেয়ো নিজের সাময়িক কাপুরুষতার জন্যে বোধহয় লজ্জিত আর ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। একটা উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে প্রিন্স সব ক’টি কামরা পেরিয়ে একাই ঐ মুখোশধারীর কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। ভীত সন্ত্রস্ত জনতা থেকে একজনও কিন্তু তাকে অনুসরণ করেনি। সেই মূর্তির তিনচার ফুটের মধ্যে যখন প্রিন্স গিয়ে পড়েছেন তখন সে কালো ভেলভেট মোড়া কামরার মধ্যে পৌঁছেছে। হঠাৎ সে ফিরে তার অনুসরণকারীর মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাতের তলোয়ার মেঝের ওপর খসে পড়ল আর চীৎকার করে প্রিন্সও লুটিয়ে পড়লেন মেঝের ওপর। তখন তার মৃত্যু হয়েছে। সমবেত জনতা তখন হতাশার মধ্যেও সমষ্টিগত সাহস সংগ্রহ করে কালো কামরার মধ্যে দৌড়ে গিয়ে কালো ঘড়ির তলায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মুখোশধারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদের ক্রুদ্ধ হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা পড়ল কবরখানার কাপড়চোপড় আর তাই দিয়ে বানানো মৃতব্যক্তির মুখোশ। স্পর্শযোগ্য কোন দেহই সেই পোষাকের মধ্যে ছিলনা।
লাল মৃত্যুর উপস্থিতি এবার সমষ্টিগতভাবেই স্বীকৃত হল। রাত্রের অন্ধকারে সে এসেছে চোরের মত। রক্ত সিঞ্চিত কামরা গুলোর মধ্যে আনন্দোৎসবে যোগদানকারী প্রতিটি নরনারী একে একে মৃত্যুর শীতল কোলে লুটিয়ে পড়ল। সব শেষে স্তব্ধ হয়ে গেল সেই বিরাটকায় কৃষ্ণবর্ণ ঘড়িটি। তেপায়ার ওপর অগ্নিকুণ্ডগুলি নির্বাপিত হল। অন্ধকার, ধ্বংস আর লাল মৃত্যুর সীমাহীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হল সেখানে।