এত সব সত্ত্বেও আনন্দোৎসবের উচ্ছলতা বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায়নি। প্রিন্সের রুচির বৈশিষ্ট্য ছিল। কোন রঙ কী ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সে সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল নিখুঁত। তার পরিকল্পনার মধ্যে সাহসিকতা আর মাদকতা, ধ্যানধারণার মধ্যে আদিমতার ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করার মতো ছিল। কেউ কেউ অবশ্য তাকে উন্মাদ ভাবত। তার সর্বক্ষণের সঙ্গীরা কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করত না। প্রকৃত পক্ষে তিনি যে উন্মাদ নন এই সত্যটুকু উপলব্ধির জন্যে তাঁকে দেখা, তাঁর কথা শোনা আর সান্নিধ্যলাভের প্রয়োজন ছিল।
এই বিরাট উৎসব উপলক্ষে সাতটি ঘরের সাজসজ্জা সম্পর্কে প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন তিনিই। মুখোশনাচের প্রয়োজনগত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও মুখ্য অবদান ছিল তার। এটা ঠিক যে পুরো ব্যাপারটাই ছিল অদ্ভুত। এত আড়ম্বর, জাঁকজমক, তীব্রতা আর অলৌকিকতা সৃজিত হয়েছিল যা একমাত্র অতীতেই কিছু কিছু দেখা গিয়েছে। অসঙ্গত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট অদ্ভুত-দর্শন মানুষদের বিচিত্র কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সর্বত্র যে অসঙ্গতচিন্তার ছাপ পড়েছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল সমগ্ৰ পরিকল্পনাটি কোন বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তিরই। সেখানে সৌন্দর্যের পাশে উচ্চঙ্খলতা, উদ্ভটের সঙ্গে ভীতিপ্রদ বস্তু আর সবকিছু জড়িয়ে অনেকখানি বিরক্তিকর পরিবেশ সৃজিত হয়েছিল। তবে এ কথাও সত্যি যে ঐ সাতটি কামরার মধ্যে একটা অভূতপূর্ব স্বপ্নের জগৎ সৃজিত হয়েছিল। সে স্বপ্নালু পরিবেশ বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছিল বিচিত্র বর্ণময় প্রাসাদকক্ষগুলোর সাহায্যে আর তারা গতিশীল হয়ে উঠেছিল ঐকতান সঙ্গীতহিল্লোলে। এ সবের মাঝখানে নিয়মিত ভাবে ধ্বনিত হচ্ছিল ভেলভেটমোড়া কামরার কালো ঘড়িটি। কিন্তু তার ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব ধ্বনিই কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আনন্দ শীতল কঠিন স্পর্শে নিপ্রাণ হয়ে যাচ্ছিল, আবার সেই প্রতিধ্বনিটি যাচ্ছিল মিলিয়ে, সাময়িকভাবে স্তব্ধীভূত আনন্দের হাস্যধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল কামরাগুলোর মধ্যে। আবার সেই সঙ্গীত, সেই স্বপ্নালু পরিবেশ, তেপায়ার ওপর বসানো আগুনের শিখার জানালা দিয়ে কামরার মধ্যে এসে সেই অস্বাভাবিক বর্ণ বহুলতার সৃষ্টি সবই যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠছিল পরক্ষণেই। এখন রাত ভোর হয়ে আসছিল তবু ঐ পশ্চিমের কামরাটিতে মুখোশ ধারীদের কেউই ঢুকতে সাহস পায়নি। রক্তবর্ণ কাঁচের জানালাগুলো দিয়ে গাঢ় লাল আলো কালোরঙের কামরার কালো ভেলভেটপর্দায় প্রতিফলিত হয়ে একটা বীভৎস পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। কেউ ও ঘরের ঘন কালো কার্পেটের ওপর গিয়ে দাঁড়ালেই দূরবর্তী অন্য কামরাগুলোর আনন্দধ্বনি ছাপিয়ে ওর কানে বেজে উঠছিল ঘড়িটির চাপা অথচ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ টিক টিক শব্দ।
অন্য কামরাগুলোর মধ্যে উচ্ছল আনন্দ কিন্তু সীমাহীন উত্তেজনার মধ্যে উপচিয়ে পড়ছিল যেন। মধ্য রাত্রির ঘণ্টাধ্বনি শ্রুত হওয়া পর্যন্ত তার মধ্যে বিরাম ছিল না এক বিন্দুও। তারপরই আগে যেমন বলেছি ঠিক তেমনি ভাবেই যুগলনৃত্যের বৃত্তাকার পরিক্রমা, সঙ্গীত, সব কিছু অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। এবার কিন্তু বাবোটি ঘণ্টাধ্বনির জন্যে সময় লাগল একটু বেশী তাই আনন্দোৎসবের জন্য সমবেত জনতার মধ্যে যারা একটু চিন্তাশীল তারা সেই অবসরে একটু বেশী সময়ের জন্যে চিন্তা করে নিতেও সময় পেল। ঠিক অবকাশের মুহূর্তেই, ঘড়ির শেষ ধ্বনির প্রতিধ্বনিটি মিলিয়ে যাবার পূর্বেই একটি মুখোশধারীমূর্তির দিকে নজর পড়ল অনেকেরই। এর আবির্ভাব ইতিমধ্যে কারও দৃষ্টিগোচর হয়নি তাই মৃদু কণ্ঠে এ সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে পড়ল ছড়িয়ে আর সমবেত উৎসবকারীদের ভেতর থেকে উখিত হল মৃদু গুঞ্জন। সে গুঞ্জনের মধ্যে অসম্মতি, বিস্ময় আর সেই সঙ্গে ভীতি আর ঘৃণা।
যে ছায়াময় ভৌতিক পরিবেশের ছবি আমি একেছি তার মধ্যে খুব একটা অস্বাভাবিক দৃশ্যের অবতারণা না হলে যে বড় ধরণের উত্তেজনা সৃজিত হতে পারে না, এ কথা সহজেই অনুমান করা যায়। এই রাত্রির মুখোশনাচিয়েদের প্রায় অবাধ স্বাধীনতাই দেওয়া হয়েছিল আর প্রিন্সের পরিকল্পনারও বিস্তৃতি ছিল সীমাহীন। যারা উজ্জ্বল তাদের হৃদয় আবেগের প্রচণ্ডতায় মাত্র আলোড়িত হতে পারে। যাদের কাছে জীবন আর মৃত্যু রসিকতারই সমার্থক, সেই সব মানুষের কাছে রসিকতার জন্যে নির্দিষ্ট কোন বিষয়বস্তুই নেই। তবু সমবেত সমস্ত মানুষই স্বীকার করতে বাধ্য হলেন বর্তমান মুখোশ ধারীর চরিত্রে এবং পোষাকে কোন চাতুর্য বা যৌক্তিকতা ছিল না। নোগা আর লম্বা এই চেহারাটি আগাগোড়া কবরের পোষাকে আবৃত ছিল। মুখোশটি তৈরী হয়েছিল মৃতদেহের বিশুষ্ক মুখমণ্ডলের অনুকরণে। সে অনুকরণ এতই নিখুঁত হয়েছিল যে নিপুণভাবে খুঁটিয়ে দেখেও কোন ত্রুটি বার করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু মূকাভিনেতা লালমৃত্যুর চরিত্র অনুকরণ না করলে হয়ত বা এই আনন্দার্থীরা সমর্থন না-করুক সমস্ত ব্যাপারটা সহ্য করতে পারত। সমস্ত পোষাকে রক্ত ছিটিয়ে, প্রশস্ত ভুরুতে আর মুখমণ্ডলে রক্ত মাখিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা এক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর করে ভোলা হয়েছিল।
ধীর আর সংযত পদক্ষেপে দ্বৈতনৃত্যের সঙ্গে ছন্দ বজায় রেখে এই ভৌতিক মূর্তিটি এগিয়ে চলেছিল, এমন সময় ওর ওপর নজর পড়ল প্রিন্স প্রস্পেয়োর। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সমস্ত শরীর প্রথমে ভয়ে বা ঘৃণায় থরথর করে কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই ক্রোধে তাঁর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল। পাশে যে সভাসদরা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, কে এ? কার এত দুঃসাহস যে এইভাবে ঈশ্বরদ্রোহী চরিত্রে অভিনয় করে? এই মুহূর্তে ওকে বন্দী করে ওর মুখোশ খুলে নাও। দুর্গ প্রাকারে কাল সূর্যোদয়ের সময় যার ফাঁসি হবে সে কে, তা আমাদের এক্ষুণি জানা দরকার।