প্রিন্স প্রস্পেরো স্থির বুদ্ধি সম্পন্ন সুখী মানুষ। তিনি রোগের প্রাদুর্ভাবে ভীত হননি অথচ তার রাজ্যের প্রায় অর্ধেক লোক তখন প্রাণ হারিয়েছে। উনি শেষ পর্যন্ত একদিন তার বন্ধুদের ভেতর থেকে বেছে বেছে সুস্থ সবল আর হাসিখুশী হাজার খানেক ভদ্রলোক আর মহিলাকে ডেকে পাঠালেন আর তাদের নিয়ে দুরের একটা দুর্গের মত বিরাট বাড়ীতে বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের জন্য চলে গেলেন। প্রিন্স খুব খেয়ালী মানুষ হলেও উচ্চ শ্রেণীর রুচিবান মানুষ ছিলেন। বিরাট বাড়ীটার চারদিকে মজবুত উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছিল আর ছিল একটা লোহার বড় দরজা। পারিষদদের নিয়ে প্রিন্স ভেতরে চলে আসার পর আগুন আর বিরাট বিরাট হাতুড়ী এনে দরজাটা পুরোপুরি ঝালাই করে বন্ধ করে দেওয়া হল। হতাশার কোন দুর্বল মুহূর্তে ভেতরের কোন মানুষ যাতে বাইরে বেরিয়ে যেতে না পারে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা হল। ভেতরে খাদ্য আর পানীয়ের কোন অভাব ছিলনা। প্রিন্স প্রস্পেনোর ধারণা হয়েছিল এভাবে এরা সবাই ঐ ব্যাধির স্পর্শ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। রোগ নিয়ে থাকুক বাইরের জগৎ। ওর জন্যে দুঃখ বা চিন্তা কোনটাই যুক্তিযুক্ত নয়। দুর্গের ভেতর আনন্দের উপকরণ ছিল প্রচুর। ওর মধ্যে ছিল ব্যালে নর্তকী, গায়ক, সুন্দরী নারী, প্রচুর মদ, অভিনয়ের মঞ্চ এমনকি হাসির খোরাক যোগানোর জন্যে ভাড়ও ছিল বেশ কয়েকজন। এই সব আর নিরাপত্তার সুদৃঢ় ব্যবস্থা নিয়ে দুর্গে রইলেন প্রিন্স আর তার পারিষদেরা। লালমৃত্যু রইল বাইরে। দুর্গের মধ্যে নির্বাসিত জীবন যাপনের পঞ্চম কি ষষ্ঠ মাসে প্রিন্স বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে একটা মুখোশনাচের আয়োজন করলেন। তাতে তার ঐ একহাজার পারিষদ সবাই যোগ দিলেন। ওদিকে বাইরে ঠিক তখনই ঐ মহামারীর প্রকোপ ভয়ানকভাবে দেখা দিয়েছে।
মুখোশনাচের ঐ আয়োজন ইন্দ্রিয়তৃপ্তির দিক থেকে ছিল অনন্যসাধারণ। যেখানে তার আয়োজন হয়েছিল সেই কক্ষগুলোর বর্ণনা আগেই দেওয়া প্রয়োজন। এখানে সাতটা রাজকীয় সুইট ছিল। সাধারণতঃ এরকম প্রাসাদে এরকম সুইটগুলো একটানা একটা দীর্ঘ জায়গা জুড়ে থাকে আর প্রত্যেকটি কক্ষের দরজা হয় ভাঁজ করা। দরজাগুলোকে খুলে দেওয়ালের গায়ে পুরো ঠেকিয়ে রাখা যায় আর এতে পুরো প্রাসাদটা যে কোন দিক থেকে বিনা বাধায় দেখা যায়। আমাদের এই প্রিন্সের চিন্তাভাবনা ছিল উদ্ভট ধরণের তাই দুর্গটিও তার তৈরী হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। কামরাগুলো এমন এলোমেলো ভাবে ছড়ানো ছিল যে একটার বেশী কামরা একবারে নজরেই পড়ত না। বিশ তিরিশ হাত দূরে দূরে বারান্দা হঠাৎ ঘুরে গেছে ভিন্ন দিকে। ডাইনে বাঁয়ে দেওয়ালের গায়ে বেশ বড় পুরোনো আমলের জানালা। তা দিয়ে ইটগুলোতে যাবার ঘুরপথ বেশ নজরে পড়ে। জানালাগুলো আবার ভিন্ন ভিন্ন রঙের। যে কামরাগুলোর মধ্যে ওই জানালাগুলো খুলছে সেই কামরার রঙের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে। সব জানালায় রঙীন কাঁচ। যেমন একেবারে পূর্ব দিকের কামরা। ওটার রঙ নীল, তাই জানালার কাঁচগুলোও নীল। পরের কামরা, তার সাজ সজ্জা সব কিছুর রঙ ছিল বেগনীলাল, তাই ওটার জানালার কাঁচও ছিল ওইরকম। তৃতীয় কামরা আর তার জানালার রঙ ছিল সবুজ। চতুর্থ, পঞ্চম আর ষষ্ঠ কামরা আর তার জানালার রঙ ছিল যথাক্রমে কমলা সাদা আর বেগনী। সপ্তম কামরার রঙ ছিল কালো। ওর মোটা মোটা পর্দাগুলো পর্যন্ত ঘন কালো রঙের আর সেগুলো লুটিয়ে পড়েছিল ঐ কালো রঙের কার্পেটের ওপর। শুধু এই কামরার রঙের সঙ্গে এর জানালার সাদৃশ্য ছিলনা। এর জানালাগুলোর রঙ ছিল ঘন লাল। এই সাতখানা কামরার কোনটিতেই কিন্তু আমোর ব্যবস্থা ছিলনা। অথচ এগুলোর মধ্যে অজস্র স্বর্ণালঙ্কার ছড়ানো ছিল, কোথাও বা ছাদ থেকে বোলানো ছিল তার কিছু কিছু। লণ্ঠন বা মোমবাতি থেকে একটুকুও আলো পাওয়ার উপায় ছিলনা কোথাও। কিন্তু এই কামরাগুলোর মুখোমুখি লম্বা টানা বারান্দায় প্রত্যেকটি জানালার বিপরীত দিকে মস্তবড় তেপায়ার ওপর বসানো ছিল পেতলের আগুনদান। সেই আগুনের শিখা কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে কামরার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। এর ফলে কামরাগুলোর মধ্যে বর্ণবহুল অদ্ভুত একধরণের আলো পাওয়া যেত। পশ্চিমদিকের সব শেষের কালোরঙের কামরায় লাল জানালার ভেতর দিয়ে কালো পদায় যখন আগুনের রশ্মি প্রতিফলিত হোত তখন একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্যের অবতারণা করত। ও ঘরে প্রবেশকারীদের মুখের ওপর ওই আলো যে ভীষণ প্রতিচ্ছায়া নিক্ষেপ করত তাতে যে কোন ব্যক্তিই ওর ত্রিসীমানার মধ্যে যেতেও ভয় পেত।
এই কামরারই পশ্চিম দেওয়ালে কালো কাঠের বিরাট ফ্রেম ওয়ালা একটা দেওয়াল ঘড়ি লটকান ছিল। একঘেয়ে গম্ভীর টিক্ টিক শব্দ করে দোকটার এদিক ওদিক যাওয়া, মিনিটের কাঁটা পুরো একপাক ঘুরে ঘণ্টার নির্দেশ দিলে ঘড়িটার ধাতব অন্তরের ভেতর থেকে সংগীতের মত মধুর অথচ সুউচ্চ ধ্বনির প্রবাহ বেরিয়ে আসার মধ্যে এমন একটা বৈশিষ্ট্য আর গুরুত্ব ছিল যার ফলে ঘণ্টা বেজে ওঠবার মুহূর্তে ঐকতান বাদকের দল স্বল্পকালীন নীরবতা পালনে বাধ্য হোত, থেমে যেত দ্বৈতনৃত্যের দ্রুতপদচারণা তাদের বৃত্তপরি ক্রমার মধ্যপথেই হয়তবা। আনন্দময় পরিবেশের মধ্যে অকস্মাৎ ঘটত ছন্দপতন তবু ঘড়ির বাজনা বেজে চলত নিয়মিত ভাবেই। এই মুহূর্তগুলিতে যারা আনন্দোচ্ছল তাদের মুখে নেমে আসত পাণ্ডুরতা, যারা বয়োবৃদ্ধ স্বপ্নবেশের আচ্ছন্নতায় তাদের হাত দ্রুতগতিতে পরিক্রমা করে আসত নিজেদের মুখমণ্ডল। বাজনার প্রতিধ্বনিটি মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু হালকা হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ত সকলের মুখে। একধরণের নির্বুদ্ধিতা বা দুর্বলতারই সাময়িক প্রভাবে ওরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল–এমনি একটা চিন্তা দ্রুতবেগে খেলে যেত গায়ক-বাদকদের মনের মধ্যে। ওরা পরস্পরের কাছে নীচুগলায় প্রতিজ্ঞা করে এর পরের ঘণ্টাধ্বনি যখন শুরু হবে তখন কোনক্রমেই এইরকম আবেগ সৃষ্টি করতে ওরা কিছুতেই দেবে না। কিন্তু তিন হাজার ছ’শ সেকেণ্ড দিয়ে গড়া ষাট মিনিট দ্রুত বেগে উধাও হয়ে যায়, ঘড়ির বাজনা আবার শুরু হয় আর ঠিক আগের মতই সব কিছুর মধ্যে ছন্দপতন ঘটে, আকস্মিকভাবে সবাই ভীরু আর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে।