লাফানে ব্যাঙের পরামর্শমতই দুপুর রাত পর্যন্ত ঐ আটজন ওরাঙ, ওটাঙ, বাইরে অপেক্ষা করছিল। ও চেয়েছিল এই যে ঘরটা মুখোশনাচের লোকে ভরে উঠুক তার পর ওরা ঢুকবে। রাত বারোটা বাজার ধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে পড়ল–বরং বলা উচিত শেকলে বাঁধা ছিল বলে ওরা আটজন গড়িয়ে এসে পড়ল হলের ভেতর।
মুখোশনাচের আসরে যারা এসেছিল তাদের উত্তেজনা আর রাজার আনন্দ সবই হয়ে দাঁড়িয়েছিল অপর্যাপ্ত। ওখানে এমন লোক প্রায় ছিলই না বলা যায় যারা ওই আটজনকে ওরঙ, ওটাঙ, বা ঐ ধরনের কোন জন্তু ভাবেনি। অবশ্য এই রকম আশাই করা গিয়ে ছিল। মেয়েদের অধিকাংশই জ্ঞান হারালেন। রাজা আগেই আসরে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আসা বারণ করে দিয়েছিলেন। তা না করলে ওঁদের এই মজা দেখানোর বদলে হয়ত অনেক রক্তই ঝরে পড়ত সেদিন।
সবাই এবার দৌড় দিতে শুরু করল দরজার দিকে। ওদিকেও পথ ছিল বন্ধ, রাজা আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন ওঁরা ঢুকে পড়ার পরই যেন দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা লাফানে ব্যাঙের কাছে জমা দিয়ে দেওয়া হয়।
সবাই যখন আত্মরক্ষার জন্যে ব্যস্ত তখন বোধ হয় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলোবার শেকলটার দিকে নজর পড়ল অনেকের। ওটা ওপর থেকে তলায় নেমে এসেছিল আর ওর আংটাটি মেঝে থেকে ফুট তিনেক ওপরে ঝুলছিল।
রাজা আর তার সাত সঙ্গী হলঘরের চারদিকে পাক খেয়ে এসে পৌঁছনো মাত্রই সেই ঝাড়লণ্ঠনের শেকলটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। লাফানে ব্যাঙ, ওঁদের অলক্ষে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। যেই রাজা আর মন্ত্রীদের শেকল ঝাড়লণ্ঠনের শেকলের সঙ্গে জড়িয়ে গেল অমনি ব্যাঙ, এমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লণ্ঠনের শেকল ধরে টান লাগালো যাতে ওটা আরও খানিক উপরে উঠে গেল আর আটজন একসঙ্গে জড় হয়ে গিয়ে পরস্পরের মুখোমুখী হয়ে পড়লেন।
ততক্ষণে মুখোশধারীরা কিছু পরিমাণে ভয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে আর পুরো ঘটনাটার মজা উপভোগ করতে আরম্ভ করেছে। ওরা তখন বাঁদরগুলোর বিবাদ দেখে হো হো করে হাসতেও শুরু করেছে। ওদের হাসির ভেতর থেকেই হঠাৎ ব্যাঙের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন দেখি। আমি বোধ হয় ওঁদের সবাইকে চিনিয়ে দিতে পারব। তবে কিনা ওঁদের একটু ভাল করে দেখতে হবে আমাকে।
ভিড় পেরিয়ে ব্যাঙ, গিয়ে পৌঁছল দেয়ালের কাছে। একটা মূর্তির হাত থেকে জ্বলন্ত মশাল তুলে নিয়ে ও এসে গেল হলঘরের মাঝখানে। তারপর বাঁদরের মত অবলীলাক্রমে লাফিয়ে রাজার মাথায় পৌঁছে সেখান থেকে ঝাড়লণ্ঠনের শেকলটা ধরে কয়েক ফুট ওপরে উঠে গেল সে। সেখান থেকে জ্বলন্ত মশালটা ওরাঙ, ওটাঙ, দলের ওপর ঝুলিয়ে ব্যাঙ, চেঁচিয়ে বললে, “দাঁড়ান, এবার ঠিক বলতে পারব কোনটি কে।
ব্যাঙের এই রসিকতায় ওরাঙ ওটাঙরা আর অন্যেরা তখন হেসেই অস্থির। এমন সময় ব্যাঙ, তীক্ষ্ণ একটা শিস দিয়ে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠনের শেকলটা প্রায় ফুট ত্রিশ ওপরে উঠে গেল। শেকলটা এতটা উঠে যাবার পরও ব্যাঙ, আর আটটি ওরাং ওটাঙের মধ্যে দূরত্ব একই রইল আর তখনো ওদের চিনিয়ে দেবার জন্যে সে সমানে জ্বলন্ত মশাল রাজা আর তার সাত জন সঙ্গীর ওপর দুলিয়ে চলেছে।
উত্তেজিত ভাড়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘হ্যাঁ, ঠিক, আমি ঠিক মতোই চিনতে পেরেছি এঁদের। এঁরা কারা এখন আর চিনতে বাকী নেই আমার। চেনবার চেষ্টা করছে এ রকম ভান করে সে তখন মশাল দুলিয়ে চলেছে। পর মুহূর্তে রাজাকে খুটিয়ে দেখার উদ্দেশ্যেই যেন, মশালটি তার ওপর নামিয়ে আনল ব্যাঙ। সঙ্গে সঙ্গে আলকাতরা মাখা শনের জামায় আগুন লেগে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আটটি ওরাঙ, ওটাঙ, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আর দর্শকেরা আর্তনাদ করে উঠল ভীষণ ভাবে। তলা থেকে কোন সাহায্যই ওদের কাছে পৌঁছে দেবার উপায় ছিল না।
আগুন আরো যখন বেড়ে উঠল তখন ব্যাঙ, শেকল বেয়ে আরও খানিক ওপরে উঠে গেল। সে তখন সকলের নাগালে বাইরে। যখন ব্যাঙ, ওই ভাবে শেকল বেয়ে উঠে যাচ্ছিল তখন হলঘরের মধ্যে সবাই নীরবে ঘটনাটা লক্ষ্য করছিলেন। এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে সে আবার বলে উঠল, এখন আমি নির্ভুল ভাবেই সব কিছু দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি কী ধরনের মানুষ ওঁরা। এঁরা হলেন মহামান্য রাজা আর তার সাতজন মাননীয় মন্ত্রী-যে রাজা আত্মরক্ষায় অসমর্থ একটি মেয়েকে নির্মম ভাবে আঘাত করেন আর যে মন্ত্রীরা সেই জঘন্য কাজে রাজাকে আনন্দের সঙ্গে সাহায্য করেন। আমি? আমি হলাম লাফানে ব্যাঙ, একটা ভাড় মাত্র, আর এইটিই আমার শেষ ভাড়ামী।’
আলকাতরা আর শনের অসম্ভব পরিমানে দহনশীলতার জন্যেই ব্যাতৈর ছোট্ট বক্তৃতা শেষ হতে না-হতেই আটটি বীভৎস দগ্ধ মৃতদেহ একটি বিরাট কৃষ্ণকায় পিণ্ডের মত দুলতে লাগল। ওটা থেকে কাউকেই তখন আর চেনবার উপায় ছিল না। বিকলাঙ্গ মানুষটি ওই শবপুঞ্জের ওপর জ্বলন্ত মশালটি ছুঁড়ে ফেলে ধীর স্থির গতিতে শেকল বেয়ে ছাদে উঠে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই অনুমান করেন যে এই জ্বলন্ত প্রতিহিংসার জন্য সহায়তা করেছিল ট্রিপেট্টা আর এই জন্যেই সে হলঘরের ছাদে কোথাও লুকিয়ে ছিল নিশ্চয়ই। এই ঘটনার পর ওদের কাউকেই আর ও অঞ্চলে দেখা যায়নি। মনে হয় ওরা দুজন ওদের দেশেই পালিয়ে গিয়েছিল।
লাল মৃত্যুর মুখোশ
লাল মৃত্যুর কবলে পড়ে দেশটা ধ্বংস হচ্ছে। এ রকম ঘৃণ্য আর মারাত্মক ব্যাধি এর আগে দেখা যায়নি। এর সমস্তটুকু ক্রিয়া রক্তেরই ওপর–তার লাল রঙের ভীতিটিই এ ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর প্রভাব বিস্তার করে। প্রথমটা সারা শরীরে প্রবল যন্ত্রণা, তারপর মাথা ঝিম্ ঝিম্, সমস্ত লোমকূপ দিয়ে অজস্র রক্তক্ষরণ আর মৃত্যু। সমস্ত শরীরে, বিশেষ করে মুখের ওপর রক্তের লাল দাগ রোগীকে তার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সাহায্য আর সহানুভূতি থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঐ চিহ্নটি হল রোগের নিষেধাজ্ঞা যেন। আসলে এই রোগের সূত্রপাত, চূড়ান্ত আক্রমণ আর মৃত্যু সব কিছু ঘটে যেতে সময় লাগে বড়জোর আধ ঘণ্টা।