ঘটনাটার একটা মনের মত ব্যাখ্যা পেয়ে রাজা খুশী হলেন। তবুও তিনি বলে উঠলেন, ‘ঠিকই, তবে কি জানেন, আমি মনে করছিলাম ঐ শয়তানটা দাঁত কড়মড় করছে।
এবার ব্যাঙ, হো হো করে হেসে উঠল আর সেই সুযোগে তার বড় বড় আর কুৎসিত দাঁতগুলো সব বেরিয়ে পড়ল। রাজা ত নিজেই ভাঁড়ের মত কাজ করছিলেন তাই অন্যের হাসিতে আপত্তি করার শক্তিও ছিল না তাঁর। তাছাড়া মদও গিলেছিলেন প্রচুর। এবার তিনি শান্ত হলেন আর আরো একগেলাস মদ অবলীলা
ক্রমে গলায় ঢেলে ফেললেন। ততক্ষণে ব্যাঙ, প্রকৃতিস্থ হয়েছে আর মুখোশনাচের মতলব তার মাথায় এসে গিয়েছে।
যেন মদ সে ছোয়নি এমনি শান্ত ভাবেই ব্যাঙ বলে উঠল, ‘ঠিক কী ভাবে ধারণাটা মাথায় এলো বলতে পারিনে কিন্তু আপনি যখন মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আর জানালার ওপাশে টিয়ে পাখী কিম্ভুতকিমাকার শব্দ করে উঠল তখনি অন্য একটা চিন্তা আমার মাথায় এসে গেল। আমরা যখন মুখোশ নাচে নাচি তখন কিন্তু এই চরিত্রগুলোতে অভিনয় করি। কিন্তু সে যাই হোক এক্ষেত্রে অসুবিধে হোল এই যে এর জন্যে দরকার আটজনালোক আর–
বেঁটের উদ্ভাবনী শক্তিতে রাজা তখন ভীষণ প্রীত। উনি হেসে বললেন, ‘কেন? আমরা ত আটজনই আছি এখানে, সাতজন মন্ত্রী আর আমি। এখন বল দেখি তোমার চিন্তাটা কী?
বিকলাঙ্গটি বলে উঠল, ‘আমরা একে শৃঙ্খলাবদ্ধ আটটি ওরাঙ, ওটাঙ, বলি। ঠিকমত অভিনয় করলে এ একেবারে তুলনাহীন।
‘আমরা তাই করব, ঐটেই অভিনয় করব আমরা বেশ শান্ত ভাবে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলেন রাজা।
লাফানে ব্যাঙ, বলল, ‘এই অভিনয়টার সৌন্দর্য কোথায় জানেন, তা হোল ওটায় মেয়েদের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার হয়, সেইখানে।
‘বাঃ, সুন্দর’-রাজা আর মন্ত্রীরা একই সঙ্গে বলে উঠলেন।
ব্যাঙ বলে চলল, ‘আপনাদের ওরাং ওটাঙ সাজানোর ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। ও আমি এমন নিখুঁত ভাবেই করে দেব যে এখানে যারা আসবে তারা আপনাদের জন্তু ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবে না। এতে ওরা বিস্মিত হবে আর ভয়ও পাবে ভীষণ।
রাজা ভীষণ খুশী হলেন আর বললেন, ‘এ একেবারে অতুলনীয়। জানো লাফানে ব্যাঙ, আমি তোমার ভাগ্য ফিরিয়ে দোব, মানুষের মত মানুষ বানিয়ে দোব তোমাকে। আমরা যে চেনটা ব্যবহার করব তার ঝন্ ঝন শব্দ সব কিছুকে আরো দুর্বোধ্য করে তুলবে। আপনারা এমন ভাব করবেন, যেন মালিকের কাছ থেকে
একসঙ্গে সবাই পালিয়ে এসেছেন। যেখানে সুন্দর সুন্দর পোষাক পরা উঁচুদরের ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলারা জমায়েত হন, সেখানে এই মুখোশ নাচটা যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আপনারা অনুমানই করতে পারবেন না। এর বৈসাদৃশ্যটি অসাধারণ।
‘এইটিই করব আমরা’–বললেন রাজা। তারপর বেলা হয়ে যাচ্ছিল বলে সবাই উঠে পড়লেন আর ব্যাঙের প্রস্তাবটিকে কার্যকরী করে তোলার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
আটজনকে ওরা, ওটাঙসাজানো এমন কিছু কঠিন ব্যাপার ছিল না কিন্তু উদ্দেশ্য সাধনের দিক থেকে পরিকল্পনাটি বাস্তবিকই অপূর্ব হয়েছিল। আমি যে সময়ের কাহিনী বলছি তখন সভ্যদেশে ঐ জন্তু দেখা যেতো না। বেঁটে মানুষটি যেভাবে ওদের সাজিয়েছিল তাতে আকৃতিগত সাধ তো ঘটেছিলই কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা ওঁরা সৃজন করেছিলেন একটা ভয়াবহ ঘৃণ্য পরিবেশ।
রাজা আর মন্ত্রীদের প্রথমে খুব আঁটসাট পোষাক পরিয়ে তার ওপর আলকাতরা লাগানো হোল। এর পর কেউ কেউ বললেন তার ওপর পালক লাগালে বেশ মজার হবে। প্রস্তাবটা কিন্তু ব্যাঙ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিল ও বলল জন্তুগুলোর গায়ের লোম সম্পর্কে ধারণা দিতে গেলে এ ক্ষেত্রে শণই ব্যবহার করতে হবে। আলকাতরার ওপর পুরু করে শণ বসিয়ে দেওয়া হোল। এর পর আনা হোল মস্ত বড় একটা শেকল, ওটাকে প্রথমে রাজার কোমরে বাঁধা হোল তারপর এক এক করে বাকী সাতজন মন্ত্রীকে বাঁধা হোল ঐটেতে। আটজন শেকলে বাঁধা অবস্থায় যখন দাঁড়ালেন তখন একটা বৃত্তই সৃষ্ট হোল।
সিম্পাঞ্জী বা ঐ ধরণের বড় বড় বাঁদর ধরে বাঁধার জন্যে বোর্নিও প্রভৃতি দ্বীপের লোকেরা যে ধরনের বাঁধন ব্যবহার করে, ব্যাঙ শেকলের শেষ অংশটুকু নিয়ে ঐ ভাবে ওঁদের আটজনকে বেঁধে ফেলল। এতে ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক লাগল দেখতে।
যে বিরাট হলঘরটাতে মুখোশ নাচের ব্যবস্থা হয়েছিল সেটি ছিল গোলাকার। ঘরটির দেওয়াল খুব উঁচু আর ওপরের একটি জানালা দিয়েই সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়ত। একটা বিরাট ঝাড়লণ্ঠন শেকল দিয়ে ঘরের মাঝখানে ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওটার ভারসাম্য ঠিক রাখবার জন্য একটা ভারি জিনিস ব্যবহার করা হয়েছিল কিন্তু ঘরের মধ্যে ওটা থাকলে বিশ্রী দেখাবে বলেই ওটাকে গম্বুজের ওপর ছাদে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
হলঘরটাকে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ট্রিপেট্রার ওপর। কতকগুলো খুটিনাটি ব্যবহারে সে অবশ্য বেঁটের পরামর্শ নিয়েছিল। তারই পরামর্শমত এই মুখোশনাচ দিনটির জন্যে ঝাড়লণ্ঠনটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার বক্তব্য ছিল এই যে ঘরে খুব ভিড় হবেই আর তাই বহু লোক ঘরের মাঝখানে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। ঝড় লণ্ঠন থেকে গরমের দিনে মোম গলে পড়ে ওঁদের দামী পোশাক সব মাটি করে দেবে। তার বদলে হলের মধ্যে কিছু দেওয়ালগিরি বসানো হয়েছিল আর ঘরের দেওয়ালে গোটা পঞ্চাশ ষাট যে মূর্তি ছিল তাদের ডান হাতে সুগন্ধি জ্বলন্ত মশাল রেখে দেওয়া হয়েছিল।