প্রথমটায় উপস্থিত সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ রোগীর জন্যে সেই মুহূর্তেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার আবশ্যকীয়তাই ওঁদের আবার চাঙ্গা করে তোলে। আসলে মিঃ স্টেপলটনের মৃত্যু হয়নি, উনি সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন মাত্র। ইথার ব্যবহারের পর তার সংজ্ঞা ফিরে এলো, তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে আত্মীয়বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন। পাছে তাঁর শরীরে আবার কোন উপসর্গ দেখা দেয় এই জন্যে কিছুদিন পর্যন্ত তাঁর এই পুনর্জন্ম লাভের ঘটনাটি গোপন রাখা হয়েছিল। পরে যখন আত্মীয়েরা মিঃ স্টেপলটনকে ফিরে পান তখন তাঁরা কী পরিমাণে আনন্দিত হয়েছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এই ঘটনার সবচাইতে রোমাঞ্চকর অংশটি মিঃ স্টেপলটনের কাছ থেকেই জানা যায়। উনি বলেছেন যে পুরো ঘটনার কোন অধ্যায়েই উনি একেবারে চেতনাহীন ছিলেন না। অসুস্থ অবস্থায় যখন চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন তখন থেকে বেসরকারী হাসপাতালের মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত সমস্ত ক্ষণ তার চেতনা ছিল। অবশ্য এটা ঠিক যে সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা অস্পষ্টতা ছিল আর সবটাই যেন গোলমেলে মনে হচ্ছিল। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে যে কথাটা তিনি বলতে চাইছিলেন তা হোল, ‘আমি বেঁচে আছি।
এ ধরণের বহু ঘটনারই ইতিহাস এখানে উল্লেখ করা যায় অত্যন্ত সহজেই। কিন্তু মানুষের অকাল সকারও করা হয়ে থাকে সেইটে প্রমাণ করবার জন্যে এত ঘটনার উল্লেখ নিস্প্রয়োজন। যখনই ভাবি যে এরকমের ব্যাপারগুলোকে ভালো করে বুঝে দেখবার শক্তি আমাদের কত কম তখনই মনে হয় এরকম ঘটনা অসংখ্য ঘটে যাচ্ছে। কোন বিশেষ প্রয়োজনে কবরখানা খোলর পর নরকঙ্কাল গুলোকে ঠিক শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায় নি, এ অভিজ্ঞতার পরিমাণ অল্প নয়। ফলে আমাদের মনে একটা ভয়াবহ সন্দেহ অবশ্যই জাগে।
আমাদের পক্ষে এগুলো যতই ভয়াবহ হোক না কেন, কবরস্থ হতভাগ্যের মৃত্যুযন্ত্রণা তার চাইতে অনেক বেশী ভয়ঙ্কর। মৃত্যুর পুর্বেই কাউকে সমাহিত করলে তাকে যে দৈহিক আর মানসিক পীড়ন ভোগ করতে হয় তা অকল্পনীয়। পৃথিবীর মুক্ত বায়ুর জন্য দুঃসহ দৈহিক আক্ষেপ, প্রদীপ শিখার শ্বাসরোধকারী প্রভাব, শবাচ্ছাদন বস্ত্রসমূহের অসহনীয় স্পর্শ, কফিনের হিমশীতল আলিঙ্গন, চিরন্তন রাত্রির নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, সমুদ্রের গভীরতম নিস্তব্ধতা, দেহটিকে ধ্বংস করে ফেলার জন্যে অজস্র মৃত্যু-কীটের দুঃসহ স্পর্শ আর সেই সঙ্গে শম্পশ্যাম পৃথিবীর প্রিয়জন–যারা অবহিত হলে এই মুহূর্তেই সমাহিত মানুষটিকে উদ্ধার করবার জন্যে ছুটে আসত, সব মিলেমিশে যে চিন্তা ঐ মানুষটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, কোন অসীম সাহসী মানুষও তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে না। পৃথিবীর বুকের ওপর এইসব মর্মান্তিক যন্ত্রণার কোন খবরই আমরা রাখি না। কল্পনা করতে পারি না মাটির তলায় নরক যন্ত্রণার যে স্বরূপ তার অর্ধাংশও। এ ঘটনাগুলোর কাহিনীতে আমাদের আকর্ষণ অপরিসীম আর শ্রদ্ধামিশ্রিত ভীতিও আছে প্রচুর শুধু এই কারণেই যে এই কাহিনীতে আমরা আস্থাবান। সব শেষের যে কাহিনীটি বলছি তা সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-নির্ভর।
বেশ কয়েক বছর ধরে আমি যে বিশেষ একটি রোগে ভুগছি চিকিৎসকরা তাকে অন্য কোন নির্দিষ্ট নামে অভিহিত না করে শারীরিক কাঠিন্যযুক্ত সাময়িক চেতনালোপ বলছেন। কেন এই ব্যাধির আক্রমণ ঘটে বা প্রকৃত উৎস কোথায় সে সব কিছুই রহস্যাবৃত থাকা সত্ত্বেও ব্যাধির আক্রমণ মুহূর্তে কী ঘটে সে সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। বিভিন্ন সময়ের আক্রমণগুলির মধ্যে পার্থক্য শুধু পরিমাণগত। কখনো কখনো রোগী একটি দিন, তারও কম সময়ের জন্যে ভয়ানক ক্লান্তিজনিত অবসন্নতার মত অচেতন থাকে। এই অচেতন অবস্থায় তার অতিক্ষীণ হৃদ্স্পন্দন ছাড়া দৈহিক স্পন্দন আর মোটেই থাকে না। সামান্যতম দৈহিক উত্তাপ, চিবুকের ওপর কোন একটি কেন্দ্রে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অক্ষুণ্ণ দেহবর্ণ আর অধরোষ্ঠের কাছে দর্পণ সংলগ্ন করে ফুসফুঁসের ক্ষীণতম ক্রিয়াও লক্ষ্য করা যেতে পারে। কখনো কখনো কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত এই চেতনাহীন অবস্থার জের চলে। এই সময় অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের খুঁটিনাটি পরীক্ষা বা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সাহায্যেও এই অবস্থার সঙ্গে মৃত্যুর লাক্ষণিক পার্থক্য বোঝা যায় না। বন্ধুবান্ধবেরা এ ধরণের আক্ৰমণ সম্পর্কে পূর্ব থেকেই সচেতন আর দেহে পচনক্রিয়ার লক্ষণ থাকে না বলেই রোগীকে অকালে সমাহিত করা হয় না। সৌভাগ্যের কথা, এসব ব্যাধির ব্যাপ্তি ঘটে ক্রম পর্যায়ে। প্রথম যখন ব্যাধির লক্ষণ দেখা যায় তখন সে সম্পর্কে মতদ্বৈধ থাকে না। এরপর সময়ের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে আর রোগের লক্ষণগুলোও স্পষ্টতর হতে থাকে। রোগীকে যে প্রকৃত মৃত্যুর আগেই সমাহিত করা হয় না তার কারণই এই। যে হতভাগ্যের প্রথম আক্রমণটি গুরুতর প্রকৃতির তার ভাগ্যে অকাল সমাধি সুনিশ্চিত।
চিকিৎসা শাস্ত্রে এ রোগের যে ধরণের বর্ণনা আছে আমার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। কখনো কখনো বাহ কোন কারণ ছাড়াই আমি এলিয়ে পড়তাম আর ধীরে ধীরে চেতনাহীন অবস্থায় উপনীত হতাম। এই সময় কোন প্রকার দৈহিক যন্ত্রণা আমার থাকতে না ঠিকই, কিন্তু আমি কথা বলতে, নড়াচড়া করতে এমনকি কোন কিছু চিন্তা করতেও পারতাম না। আমার মধ্যে এক ধরণের অস্পষ্ট চেতনা কাজ করত আর তারই সাহায্যে যারা তখন আমার বিছানার আশেপাশে থাকত, তাদের উপস্থিতিটি বুঝতে পারতাম। যতক্ষণ রোগের আক্রমণ অন্তর্হিত হোত ততক্ষণ চেতনা আর চেতনহীনতার মোহানায় আমার সময় কাটত। কখনো বা নিতান্তই আকস্মিক দ্রুততার সঙ্গে আমার শরীর শীতল হয়ে যেত, আমার চেতনা সম্পূর্ণভাবেই লুপ্ত হয়ে যেত আর আমি মৃতের মত কয়েক সপ্তাহ পড়ে থাকতাম। এই সময় আমার কাছে সবই মনে হোত শূন্য, অন্ধকার আর নীরব। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তখন আমার কাছে অর্থহীন হয়ে যেত। জগৎসংসার ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমার কাছে এমন কিছু বড় ঘটনা নয় তখন। এ সব ক্ষেত্রে ব্যাধির আক্রমণ সম্পূর্ণ আকস্মিক এবং সর্বাত্মক হলেও, আমার জ্ঞান ফিরে আসত, আনুপাতিকহারে অত্যন্ত মন্থর গতিতে। এ যেন সুদীর্ঘ নির্জন শীতরাত্রির একক ভ্রমণের পর, গৃহহীন বন্ধুহীন এক ভিক্ষুকের জীবনে ক্লান্ত মন্থর গতিতে আনন্দময় নবসূর্যোদয়ের মতো আমার দেহের মধ্যে আত্মার প্রত্যাবর্তন।