মুখোশনাচের রাতের জন্য ট্রিপেট্টার ব্যক্তিগত তত্ত্ববধানে অপূর্ব সজ্জায় সজ্জিত হোল একটি হলঘর। উৎসবকে সফল করতে পারে এমন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা থেকে কেউই বিরত:,রইল না। রাজসভার প্রতিটি মানুষ নতুন কিছুর আশায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। কে কোন মুখোশ পরে কোন চরিত্রে অভিনয় করবে সে কথা স্থির হয়েছিল একসপ্তাহ, কোন কোন ক্ষেত্রে একমাস আগেই। সু সিদ্ধান্তের অভাব কোথাও বিন্দুমাত্রও ছিল না, শুধু রাজা আর তার সাতজন মন্ত্রী কী করবেন সেইটি তারা স্থির করতে পারছিলেন না। এ যে কেন পারছিলেন না তারা তা বলা শক্ত তবে মনে হয় বড় বাধা এসেছিল তাদের অস্বাভাবিক আকারের মোটা শরীরের দিক থেকে। যাই হোক তাঁরা শেষ পর্যন্ত পরামর্শের জন্যে লাফানে ব্যাঙ আর ট্রিপেট্টাকে ডেকে পাঠালেন।
দুটি ছোট্ট বন্ধ যখন রাজ দরবারে হাজির হোল তখন রাজা মন্ত্রীদের নিয়ে মদ্যপানে নিরত। তবু রাজার মেজাজ যে ভাল নেই তা দেখেই বোঝা গেল। রাজা জানতেন লাফানে ব্যাঙ মদ খায় না। মদ খেলে ও এত বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়ত যা তার ছোট্ট শরীরের পক্ষে নিতান্তই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত। তবু রাজা তাকে মদ খেতে আদেশ করলেন। রাজা কিন্তু এই ধরনের রসিকতাই পছন্দ করতেন তাই ব্যাঙকে বাধ্য করলেন মদ খেতে।
ব্যাঙ, অর ট্রিপেট্টা দরবারে প্রবেশ করতেই রাজা বলে উঠলেন, ব্যাঙ নাও দেখি এই এক পাত্র মদ, চট করে তোমার অনুপস্থিত বন্ধুদের স্বাস্থ্য কামনা করে গিলে ফেল আর তারপর একটু চিন্তা করে বল দেখি কী করা যায়। আমরা চাই নতুন নতুন চরিত্র, বুঝলে, শুধু চরিত্র। সেগুলো এমন হবে যা একেবারে অসাধারণ। একঘেয়ে চরিত্র দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। মদটা খেলে তবেই তোমার বুদ্ধি খুলে যাবে।
সাধারণত এই রকম পরিস্থিতিতে ব্যাঙ রাজার কথা নিয়ে রসিকতাই করে, কিন্তু আজকের পরিবেশটাই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। দিনটি ছিল ব্যাঙের জন্মদিন তাই অনুপস্থিত বন্ধুদের উদ্দেশে মদ খেতে গিয়ে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। অত্যাচারী রাজার হাত থেকে সবিনয়ে মদের গেলাসটি ধরে নেবার পর উষ্ণ কয়েক ফোঁটা চোখের জল ওরই মধ্যে ঝরে পড়ল।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেঁটে মানুষটি যখন মদটুকু গলায় ঢেলে দিচ্ছিল তখন রাজা হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘ব্যাস, এবার দেখ, ভালো এক গেলাস মদ কী বিরাট কাজ করতে পারে। এই তোত, তোমার চোখ চক্ চক্ করতে শুরু করেছে। হতভাগ্য ব্যাঙের চোখ কিন্তু চক্ চক্ নয় বরং মৃদুই হয়ে আসছিল মদের তীব্র ক্রিয়ায়। মদের গেলাসটা টেবিলে রেখে ও এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করল প্রায় উন্মাদের মতোই। রাজার রসিকতা খুব ভালো কাজ করেছে দেখে মন্ত্রীদের তখন কী আনন্দ।
সব চাইতে মেদবহুল ছিলেন প্রধান মন্ত্রী। তিনি বলে উঠলেন, ‘এবার কাজের কথা হোক।’ রাজা বললেন, ‘নিশ্চয়ই। এবার বল দেখি ব্যাঙ কী করা যায়। আমরা ভালো ভালো চরিত্র চাই, হ্যাঁ চরিত্রই। রাজা আবার হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসলো ব্যাঙও কিন্তু সে হাসির মধ্যে স্বাভাবিকতা ছিলনা, কেমন যেন অর্থহীন হাসি।
রাজা প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়েছেন তখন। বললেন, ‘বল, বল, তাড়াতাড়ি বল, কী ভাবতে পারছ না কিছু?
–আজ্ঞে না। আমি কিন্তু খুব নতুন কিছু ভাবতে চেষ্টা করছি । ব্যাঙ কথা বলল কিছুটা দুর্বোধ্য ভঙ্গীতে। মদের ঘোরে সে যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।
–চেষ্টা করছি মানেটা কী? চেঁচিয়ে উঠলেন বদরাগী রাজা। পরক্ষণেই বললেন, ‘ও বুঝতে পেরেছি। তুমি একটা গোমড়ামুখো মানুষ। তোমার আরও মদ দরকার। এই নাও, আরো খানিকটা গিলে ফেল।’ বলেই রাজা গেলাসে বেশ খানিকটা মদ ঢেলে বিকলাঙ্গ মানুষটির দিকে এগিয়ে দিলেন। বেচারার তখন দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে শুধু বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
দৈত্যের মত হুঙ্কার ছেড়ে রাজা বলে উঠলেন ‘খাচ্ছে না যে? শীগগির খাও বলছি, না হলে তখন কিন্তু ব্যাঙ ইতস্তত করছে।
রাজা রাগে লাল হয়ে উঠেছেন তখন। মন্ত্রীরা বোকা হাসি হাসছেন আর ওদিকে ট্রিপেট্টার মুখ প্রাণহীন পাণ্ডুর হয়ে উঠেছে। সে ধীরে ধীরে রাজার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বন্ধুর জন্য মার্জনা ভিক্ষা করল।
মেয়েটির স্পর্ধায় রাজা কিছুটা বিস্মিত হলেন। কিভাবে নিজের ঘৃণা প্রকাশ করবেন, সেই চিন্তাই তার কাছে বড় হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত কোন কথা না বলে উনি মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আর তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন গেলাসের সবটুকু মদ।
একটি দীর্ঘশ্বাসও ফেলল না মেয়েটি। একবার উঠে দাঁড়িয়ে পূর্বের মতই টেবিলের তলায় হাঁটু গেড়ে বসল সে।
সারা হলঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা জমাট বেঁধে উঠল এমন ভাবে যে একটা পাতা বা পালক খসে পড়লেও তার শব্দ অনায়াসে শোনা যেত। কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভেতর থেকে একটা খরখরে কর্কশ শব্দ শোনা গেল শুধু। বেঁটে লোকটির দিকে ফিরে উত্তেজিত কণ্ঠে রাজা প্রশ্ন করলেন, “কেন, কেন ওরকম শব্দ করছ তুমি?
মদের ঝোঁক তখন অনেকখানি কমে এসেছে। ক্রুদ্ধ রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘আমি? আজ্ঞে না, আমার সে সাহস মোটেই নেই। একজন মন্ত্রী বললেন, ‘আমার মনে হয় শব্দটা বাইরে থেকেই আসছে। যতদূর মনে হয় ওখানে একটা টিয়া পাখী তার খাঁচাটায় ঠোঁট ঘষছে।