শুনুন সেই শব্দ! শুনতে পাচ্ছেন? শব্দটা বাড়ছে। বাড়ছে! বাড়ছে!
‘শয়তানের দল’, চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। আর কপটতার প্রয়োজন নেই। অপরাধ আমি স্বীকার করছি । মেঝের তক্তাগুলো সরিয়ে ফেলুন। হ্যাঁ, এইখানে–এইখানে। শব্দটা বেরুচ্ছে ঐ ঘৃণ্য হৃদযন্ত্র থেকেই।
লাফানে ব্যাঙ
রাজার মতো রসিকতা উপভোগ করার মানসিক শক্তি আমি অন্য কারোর মধ্যে দেখিনি। ওঁর জীবনে প্রিয়তম বস্তুই ছিল ঐ রসিকতা। ওঁর আনুকূল্য পাবার সর্বোত্তম পন্থা ছিল যে কোন মজার গল্প ওঁকে সুন্দর করে শোনানো। হয়তো এরই জন্যে ওঁর সাত সাতজন মন্ত্রীই ভঁড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ওঁরা সবাই রাজার মত বেশ নাদুসনুদুস্ তেল চক্চকে দেহের অধিকারী আর রসিকতা প্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি জানিনে রসিকতা করতে গিয়ে মানুষ মোটাসোটা হয় না দেহের মধ্যে চর্বি বেশি হলে মানুষ রসিক হয়ে ওঠে। তবে এ আমি জানি যে রোগা পাতলা রসিক মানুষ দুর্লভ।
ওই মন্ত্রীদের রাজা রসিকপ্রবর মনে করতেন আর রসিকতার মধ্যে শালীনতার প্রশ্ন তার কাছে কোনদিনই বড় ছিল না। তাই খুব বড় রকমের রসিকতা উপভোগের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা রাজার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। এ বিষয়ে কলাসম্মত সূক্ষ্মতা প্রভৃতি তার ভালোই লাগতো না তাই ভলতেয়ারের ‘জাডিগ’ তাঁর ভালো লাগতো না, লাগত রাবোর ‘গারগাতুয়া অনেক বেশী ভালো। তা ছাড়া মৌখিক বা বাচনিক রসিকতার চাইতে তার আকর্ষণ ছিল রসিকতাপূর্ণ ঘটনার ওপর অনেক বেশী।
আমি যে সময়ের ঘটনা বর্ণনা করছি তখনো বৃত্তিধারী ভাড়ের রাজদরবারের নিয়মমাফিক কাজ করে চলছিলেন। ইয়োরোপের বহু রাজা তখনো ভাড় পুষছিলেন। সেই সব ভাড়েরা আগেই মতই ময়লা পোষাকের ওপর ঘণ্টা বাঁধছে আর কোমরবন্ধ ব্যবহার করছে পূর্বপ্রথারই অনুসরণে। রাজাদের অনুগ্রহের দান কুড়িয়ে নিতে তখনো ওরা তাদের মনোরঞ্জনের আশায় মজার মজার কাজ করবার জন্যে প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তুত থাকছে।
আমাদের গল্পের নায়ক যে রাজা তিনিও প্রথানুযায়ী ভাড় রেখেছিলেন একজন। ওঁর যে সাতজন মন্ত্রী গুরুগম্ভীর উপদেশাবলী বর্ষন করতেন তাদের সেই জ্ঞানগর্ভ বিষয়গুলির ভার কমানোর জন্যই বোধহয় তিনি ভাড়টির কাছ থেকে কিছু হাল্কা কথাবার্তা আশা করতেন। মনোরঞ্জনের জন্য নিযুক্ত ঐ ব্যক্তিটি শুধু ভাড় বলেই যে রাজার প্রিয়পাত্র ছিল তা নয়, সে তার স্নেহ বেশী করে আকর্ষণ করেছিল খর্বকায় বিকৃতাঙ্গ মানুষ বলে। রাজদরবারে খর্বকায় মানুষের আধিক্যও দেখা যেত, রাজদরবারের দীর্ঘ কর্মবহুল সময় এই সব বেঁটেখাটো মানুষ আর ভাড়দের সঙ্গ ছাড়া তাদের কাটতোনা। ভাড়দের সঙ্গে এক হয়ে তারা এই বামনদের হাসিঠাট্টা করতেন। আমি আগেই বলেছি যে পরিহাসপ্রিয় মানুষেরা মোটাই হন শতকরা নিরানব্বই ক্ষেত্রে। মনে হয় আমাদের কাহিনীর রাজা এই জন্যেই আত্মপ্রসাদ বোধ করতেন যে তার ভাড়ের একই সঙ্গে তিনটি গুণ আছে। প্রসঙ্গত বলি, এই ভাড়টিকে তিনি ‘লাফানে ব্যাঙ,” বলেই সম্বোধন করতেন।
আমি হলফ করে বলতে পারি যে ঐ ভঁড়টিকে এই ‘লাফানে ব্যাঙ’ নামটি তার জন্মের পর নামকরণের সময় দেওয়া হয়নি। আসলে এ লোকটি সাধারণ অন্য দশজন মানুষের মত স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারতো না বলে মন্ত্রীসপ্তকের পরামর্শক্রমে এই বিশেষ নামটি ভাড়টিকে দেওয়া হয়েছিল। লোকটি লাফিয়ে লাফিয়ে অদ্ভুতভাবে চলত আর ঐ ভাবে চলবার সময় যে সব শব্দ করত তাতেই কাজ হোত। রাজার ছিল প্রকাণ্ড ভুড়ি আর বিরাট একটা মাথা। তবু দরবারের সবাই রাজার অপূর্ব সুন্দর শরীরের প্রশংসা করত। রাজা তাই তাঁর দরবারে এই বিকলাঙ্গ মানুষটিকে দেখে অসীম আনন্দ অনুভব করতেন।
আমাদের লাফানে ব্যাঙের পাগুলো ছিল বিকৃত। পথে বা ঘরের মেঝেতে চলতে হলে তার তাই খুব কষ্ট হোত। বেচারার এই ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য প্রকৃতি ওর হাতগুলোকে অদ্ভুত শক্তিশালী করে গড়ে দিয়েছিল। গাছে চড়ে বা দড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার কাজে ও যে দক্ষতার পরিচয় দিত তা ছিল দেখবার মত। লাফানে ব্যাঙের দেশ কোথায় জানিনে তবে এটুকু জানি যে বহু দূরের কোন অনুন্নত দেশ থেকেই সে এসেছে। রাজার কোন এক শক্তিমান ও বহু যুদ্ধজয়ী সেনাপতি কোন দূর দেশ থেকে এই মানুষটিকে আর একটি বালিকাকে জোর করে নিয়ে এসে এই রাজাকে উপহার দেন। বালিকাটি বেঁটে খাটো চেহারার হলেও কুৎসিত-দর্শন ছিল না। বরং তার হাত পা খুবই সুন্দর ছিল আর নাচিয়ে হিসেবে সে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
দুই বন্দীর মধ্যে তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই একটি অত্যন্ত হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বস্তুত সেই সম্পর্ক তারা পরস্পর স্বীকার করে নিয়েছিল। লাফানে ব্যাঙ অনেক কায়দা কসরৎ করেও কারো মনোরঞ্জন করতে পারতোনা তাই ট্রিপেট্টার কোন সাহায্যেও আসতো সে। অপরপক্ষে ট্রিপেট্টা তার ছোট শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে সকলেরই প্রীতির পাত্রী হয়ে উঠেছিল আর রাজদরবারে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। এর ফলে লাফানে ব্যাঙকে সাহায্য করার কোন সুযোগ পেলেই সে তার সদ্ব্যবহার করত।
ঠিক মনে নেই কেন, তবে কোন এক ঘটনা উপলক্ষে রাজা একবার মুখোশ পরা বলনাচের ব্যবস্থা করলেন। মুখোশ নাচ বা ঐ রকমের কোন আনন্দোৎসবের আয়োজন হলেই তার সাফল্যের জন্য অনেক খানি দায়িত্ব নিতে হোত লাফানে ব্যাঙ আর ট্রিপেট্টাকে। এসব ব্যাপারে আবার লাফানে ব্যাঙের যে উদ্ভাবনী প্রতিভা ছিল তা অস্বাভাবিক। মূকাভিনয়ের আয়োজন, নতুন নতুন চরিত্র সৃষ্টি, অপূর্ব দর্শন পোষাকের পরিকল্পনা–সবকিছুতে ও ছিল অসাধারণ। তাই লাফানে ব্যাঙ ছাড়া এই ধরনের উৎসব কল্পনাই করা যেতো না।