চোখটা খোলা ছিল, পুরোপুরি ভোলাই ছিল, আর সেই জন্যই ওটার ওপর আমার দৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম। সেই হাঙ্গা নীল রঙের ঘৃণ্য পর্দাপড়া চোখটাকে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার অস্থি-মজ্জার মধ্যে একটা শীতল শিহরণ অনুভব করছিলাম। সেই জঘন্য চোখটা ছাড়া বৃদ্ধের শরীর বা মুখ কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, কারণ আলোটার সূক্ষ্ম রশ্মি আমি ওঁর চোখের ওপরই নিবদ্ধ রেখেছিলাম।
তবু, আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসও প্রায় রুদ্ধ হয়েই ছিল। লণ্ঠনটাকে স্থিরভাবে ধরে আমি আলোর রশ্মিটাকে অকম্পিত চোখের ওপর ফেলে রেখেছিলাম। ওদিকে বৃদ্ধের সেই নারকীয় হৃদ্স্পন্দন বেড়েই চলেছিল, আর তার ধ্বনি দ্রুততর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্টতর হয়ে উঠছিল। প্রতিটি মুহূর্তে সেই ধ্বনি উচ্চতর হয়ে উঠছিল হয়ত এইজন্যেই যে বৃদ্ধ নিশ্চয়ই ক্রমশ ভীত হয়ে পড়ছিলেন। আমি তো আগেই স্বীকার করেছি যে, আমি নিতান্তই ভীতু প্রকৃতির মানুষ। গভীর রাত্রে নিস্তব্ধ গৃহের সেই অদ্ভুত শব্দ আমাকে দুর্দমনীয় ভীতিতে উত্তেজিত করে তুলল। তবু আমি নিজেকে সংযত করে স্থির হয়ে পঁড়িয়ে রইলাম। সে শব্দ কিন্তু বেড়েই চলল এবং এক সময় মনে হোল বৃদ্ধের বুকখানা ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। এ-ও মনে হোল এই শব্দ বৃদ্ধের প্রতিবেশীও শুনতে পাবে। ওঁর চরম মুহূর্ত সমাগত। বিকট চীৎকার করে আমি পুরো লণ্ঠনটার আচ্ছাদন খুলে ওঁর ঘরের মধ্যে দৌড়ে গেলাম। উনি একবার হ্যাঁ, মাত্র একবারই ভয়ার্ত চীৎকার করে উঠলেন। পরমুহূর্তে আমি ওঁকে মেঝেয় টেনে ফেলে তার ওপর ভারী বিছানাটা চাপা দিয়ে দিলাম । সব কাজ এ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবেই সম্পাদিত হয়েছে দেখে আমি মৃদু হাসতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু এই ঘটনার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই হৃদস্পন্দন মৃদুভাবে হলেও শোনা যাচ্ছিল। এতে আমি কিন্তু বিচলিত হই নি। জানতাম এ শব্দ দেওয়ালের ওপারে কেউ শুনতে পাবে না। কিছুক্ষণ পরে সেই ধ্বনি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মৃত্যু হয়েছে বুঝলাম। বিছানাটা সরিয়ে ফেলে মৃতদেহটাকে পরীক্ষা করে বুঝলাম মৃত্যুর পর তার শরীর পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে। ওঁর বুকের ওপর বেশ কিছুক্ষণ হাত রেখেও স্পন্দন অনুভব করতে পারলাম না। বৃদ্ধের মৃত্যু সম্পর্কে আমার আর কোন সন্দেহ রইল না। নিশ্চিন্ত হলাম, সেই নারকীয় চোখ আর আমাকে কোনদিনই বিচলিত করবে না।
এখনো যদি আপনি আমাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি মনে করেন, করুন। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, মৃতদেহটাকে কী পরিমাণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আমি লুকিয়ে ফেলেছিলাম তা শুনলে আপনার ধারণার পরিবর্তন হবেই হবে। ভোর হয়ে আসছিল বলে আমি দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু নিঃশব্দে কাজ করে চললাম। মৃতদেহটাকে আমি প্রথমে টুকরো টুকরো করে ফেললাম। মাথা, হাত, পা–সব কিছু পৃথক করে নিয়ে মেঝে থেকে তিনখানা তক্তা সরিয়ে তার তলায় সব কিছু চাপা দিয়ে দিলাম। কাজটা এত নিখুঁতভাবে করেছিলাম, যে কোন মানুষের পক্ষেই সন্দেহ করার মত কিছু ছিল না। বৃদ্ধের চোখেও কোন অসঙ্গতি খুঁজে পেত না। কোথাও কোন রক্তের দাগ ছিল না, তাই ধোয়ামোছর প্রশ্নও ছিল না। পুরো কাজটা একটা টবের মধ্যে করেছিলাম কিনা তাই।
আমার কাজ যখন ফুরুল তখন ভোর চারটে। তখনো বেশ অন্ধকার ছিল। ঠিক চারটে যখন বাজল তখন রাস্তার ওপরকার দরজায় কেউ যেন ধাক্কা দিল। আমার তো ভয় করবার মত কিছুই ছিল না তখন, তাই বেশ হাল্কা মনেই দরজা খুলে দিলাম। তিনজন পুলিশ অফিসার যথেষ্ট ভদ্রভাবে নিজেদের পরিচয় জানিয়ে বললেন যে, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে একটা খবর পেয়ে তারা এসেছেন। প্রতিবেশীরা এই বাড়ী থেকে একটা আর্তনাদ শুনেছিল আর এখানে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই আশঙ্কা করেছিল। এই খবর পেয়েই ওঁরা এখানে তদন্তের জন্যে এসেছেন।
অফিসারেরা খুবই খুশী হয়েছিলেন। অফিসারেরা কিন্তু তখনো বসে রয়েছেন, আর কথা বলেই চলেছেন। কানের মধ্যেকার সেই ধ্বনিটি ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে উঠল। খুব স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তায় অংশ গ্রহণ করে আমি ঐ অস্বস্তি থেকে রক্ষা পেতে চাইলাম। ওতে কোন লাভ হল না। শব্দটা বেড়ে চলল আর শেষ পর্যন্ত বুঝলাম শব্দটা আমার কানের মধ্যে হচ্ছিল না।
একটু চড়া গলায় বেশ স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বললেও আমি কিন্তু পর পর বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিলাম। শব্দ তখনো বাড়ছে। বলুন, আমার তখন কী কর্তব্য? একটা ঘড়িকে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিলে যে ধরণের শব্দ হয়, সেইরকম শব্দ শুনছিলাম আমি। আমার দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অফিসাররা কিন্তু কিছুই শুনছিলেন না। আমি আরও জোরে আর তাড়াতাড়ি কথা বলে চললাম তবু শব্দটা বাড়তেই থাকল। আমি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ছোটখাটো কথার তর্ক জুড়ে দিয়ে উঁচু গলায় কথা বলতে আর নানা রকমের বিকট মুখভঙ্গী করতে আরম্ভ করলাম। অফিসাররা কিন্তু তখনো বসে। এঁদের মন্তব্য শুনে আমি বিরক্ত হয়েছি এই ভাব প্রকাশ করার জন্যে তখন আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে মেঝেতে পায়চারী শুরু করেছি, কিন্তু শব্দটা বাড়ছে তোত বাড়ছেই। আমি ক্রোধে উন্মত্তের মত হয়ে নানা ধরণের শপথ উচ্চারণ করতে লাগলাম। তখনো শব্দটা বাড়ছেবাড়ছেবাড়ছে। আপনি বলতে চান, ওরা শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল না? ঈশ্বর জানেন, আমার মনে হোল ওরা সব শুনে ও আমার ভয়ার্ত অবস্থাটা দেখে বেশ উপভোগ করছিল। এ কথা তখন আমি ভেবেছিলাম, এখনো সেই কথাই ভাবছি। কিন্তু যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা আমি সেই মুহূর্তে ভোগ করছিলাম তার চেয়ে অন্য যে-কোন শাস্তি বোধহয় কাম্য ছিল। এই রকম মর্মান্তিক উপহাসের চেয়ে অন্য সব কিছুই সহ্য করা তখন সহজ মনে হচ্ছিল। আমি ওঁদের ভণ্ডামির হাসি মোটেই সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার মনে হোল হয় আমি ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠব, নয়ত তখনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ব।