বলতে পারবো না কখন ঐ ধারণাটা আমার মনের মধ্যে তৈরী হয়েছিল, তবে একবার তৈরি হওয়া মাত্র ওটা দিন-রাত্রি আমাকে জ্বালিয়েছে। ওর মধ্যে আবেগ বা উদ্দেশ্য কোন কিছুই ছিল না। বৃদ্ধকে আমি ভালোই বাসতাম। কোন দিনই কোন ক্ষতি তিনি আমার করেন নি বা অপমানও করেন নি। আমি তার যে বস্তু নিতে চেয়েছিলাম তা সোনা-দানা নয়, তাঁর একটা চোখ। হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। ওঁর একটা চোখ দেখতে ছিল হালকা নীল রঙের আর তার ওপর পর্দা পড়েছিল। শকুনদের চোখের মতোই দেখতে লাগত ওটাকে। ওই চোখ দিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেই আমার রক্ত হিম হয়ে যেত। বোধ হয় এই জন্যেই একটু একটু করে মন স্থির করে ফেললাম–আমি এই বৃদ্ধকে হত্যা করব আর চিরদিনের মতো ঐ ভয়ঙ্কর চোখের চাউনী থেকে মুক্তি নেবো।
ব্যাপার এইটুকু। এর জন্যে আপনি আমাকে উন্মাদ ভাবছেন। যারা উন্মাদ তারা ত কিছুই জানে না। কিন্তু আমি? আমাকে তো আপনি দেখছেন। বুঝতে পারছেন না আমি কত বুদ্ধিমানের মত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাবধানী মানুষের মত, মনের সমস্ত চিন্তাকে কত নিপুণতার সঙ্গে গোপন করে অগ্রসর হয়েছিলাম। যেদিন বৃদ্ধকে আমি হত্যা করি তার আগের সাতদিন তাকে আমি ভীষণ ভালো। বেসেছি। প্রতিটি রাতেই, প্রায় বারোটার সময় আমি তার ঘরের দরজা খুব সাবধানে খুলেছি। মাথাটা ঢুকোবার মত ফাঁক করেই আমি দরজার ভেতর চারদিক ঢাকা একটা লণ্ঠন ঢুকিয়ে দিয়েছি। ওটা থেকে এক চিলতে আলোেরও বাইরে বেরিয়ে আসার উপায় ছিল না। তারপর আমি মাথা ঢুকিয়েছি ঘরের মধ্যে। কত সাবধানে আমি ঘরে ঢুকতাম, দেখলে আপনি না হেসে পারতেন না। যাতে বৃদ্ধের ঘুম না ভাঙে সেজন্য আমি খুবই আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকতাম। উনি বিছানায় শুয়ে আছেন এইটুকু শুধু দেখবার মতো মাথাটা দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকোতেই আমার প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যেত। বলুন তো, কোন পাগল এত বুদ্ধিমান হয়? ঘরের মধ্যে মাথাটা ঢোকাবার পরেই আমি লণ্ঠনটাকে খুব সাবধানে খুলতে শুরু করতাম। খোলবার সময় লণ্ঠনের কজায় শব্দ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাই আমি বিশেষ সাবধান হতাম। তারপর লণ্ঠন টাকে একটুখানি ফাঁক করে পাতলা ছোট্ট একটা রশ্মি বৃদ্ধের শকুন চোখটার ওপর ফেলতাম। প্রত্যেক বারই রাত দুপুরের দিকে। আমি সাত সাতটি রাত এভাবে লণ্ঠনের আলো ফেলে দেখেছি আর প্রত্যেকবারই চোখটাকে দেখেছি বন্ধ অবস্থায়। আমি তাই আমার কাজ করতে পারি নি। বৃদ্ধও আমাকে বিচলিত করেন নি, করেছিল তার সেই অলক্ষুনে চোখটা। ভোর হলেই আমি তার ঘরে গিয়েছি, যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে কথা বলেছি, নাম ধরে হৃদ্যতার সঙ্গে সম্বোধন করে রাত কেমন কেটেছে তাও জানতে চেয়েছি। তাহলে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই যে বৃদ্ধ কত ভালোমানুষ ছিলেন। রাতের বেলা তিনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন, তখন প্রতি রাতে বারোটা নাগাদ আমি যে তাকে দেখে আসি, এরকম সন্দেহ তিনি একটি বারও করেন নি।
অষ্টম রাতের বেলায়ও আমার সাবধানতার অন্ত ছিল না। দরজা খোলার সময় বরং অন্যান্য রাতের চাইতে বেশী সাবধানীই ছিলাম। আমার কাজের গতি ঘড়ির মিনিটের কার্টার চাইতেও ছিল মন্থর। নিজের শক্তি আর বিচক্ষণতা সম্পর্কে সেই রাতে আমার যে ধারণা হয়েছিল তার আগে কোনদিনই তা আর হয় নি। আমি যে ধীরে ধীরে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছি একটা গোপন চিন্তা আর উদ্দেশ্য নিয়ে তা তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। এই জন্যেই বিশেষ করে আমার মনের মধ্যে জয়ের আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। আমার মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছিল। উনি হয়ত শুনতে পেয়েছিলেন কিছু তাই ভয় পেয়ে বিছানায় নড়ে উঠলেন। হয়ত আপনি ভাবছেন, ঐ মুহূর্তে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, তা কিন্তু মোটেই নয়। চোর ডাকাতের ভয়ে উনি দরজা-জানালা বেশ ভালো করে বন্ধ করে দিতেন, তাই ঘরের মধ্যে ঘন কালো অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠেছিল। আমার তাই জানা ছিল যে দরজা একটুখানি ফাঁক করলে উনি টের পাবেন না। আমি আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকতে লাগলাম।
ঘরের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে আমি যেই লণ্ঠনটাকে ঠিক করে নিতে যাচ্ছি অমনি আমার বুড়ো আঙ্গুলটা পিছলে গিয়ে লণ্ঠনের টিনের বন্ধনীটার ওপর পড়ল। • বৃদ্ধ বিছানার ওপর লাফিয়ে বসে চেঁচিয়ে উঠলেন, কে ওখানে?
কিছু না বলে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো এক ঘণ্টা আমি ওই ভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, শরীরের একটা মাংসপেশীও নড়েনি। উনি যে শুয়ে পড়েছেন এমন কোন শব্দও শুনলাম না কিন্তু। উনি তখনো বিছানার ওপর বসে বসে শুনছিলেন–যেমন আমি রাতের পর রাত ওই ঘরের দেওয়ালে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনেছি।
একটা ভয়বিহ্বল মৃদু আর্তনাদ শুনে বুঝলাম এর উৎস বেদনা ৰা দুঃখ নয়, বরং বিস্ময়-বিমূঢ় আত্মার রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণা। এর সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার। মধ্যরাতের নিস্তব্ধ নির্জনতার মধ্যে নিদ্রিত পৃথিবীর বুকে যখন একমাত্র আমিই জেগে থেকেছি তখনই এই আর্তনাদ আমার গভীর অন্তর থেকে উঠে এসেছে। এরই প্রতিধ্বনি আমাকে মাঝে মাঝে ভীতিগ্রস্ত করে অন্যমনস্ক করেও তুলেছে।
অসীম ধৈর্য নিয়ে দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পরও ওঁর শুয়ে পড়ার কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। স্থির করলাম, আলোর ছোট্ট ফাঁকটাকে খুলে ফেলব। কত সন্তর্পণে, সত্যি বলছি ঠিক কত সন্তর্পণে, আমি কাজ করছিলাম তা আপনি অনুমান করতে পারবেন না। যাই হোক ধীরে ধীরে আমার লণ্ঠন থেকে একটা সূক্ষ্ম আলোর রশ্মি মাকড়শার তৈরী সরু সুতোর মত বৃদ্ধের শকুন চোখের ওপর গিয়ে পড়ল।