এইভাবে আরও ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। বৃষ্টি বাড়ার ও ঠাণ্ডা পড়ার ফলে লোকজন এবার বাড়ী ফিরতে আরম্ভ করেছিল তাই পথে লোকজনের দিক থেকে বাধা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছিল। কিছুটা যেন অসহিষ্ণুতার সঙ্গে পথিকটি অপেক্ষাকৃত নির্জন একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লেন। এই রাস্তায় প্রায় সিকি মাইল পথ উনি যে পরিমাণ দ্রুততার সঙ্গে হেঁটে গেলেন, তার সঙ্গে তাল রেখে চলা আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠল। তারপর উনি একটি ওঁর অতিপরিচিত বাজারে গিয়ে পৌঁছলেন আর অজস্র ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে আগের মতই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
এখানেই প্রায় ঘণ্টাদেড়েক কাটল। এর মধ্যে নিজেকে ওঁর নজর থেকে দূরে রাখতে আমাকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে আমার পায়ে নরম জুতো ছিল আর নিঃশব্দে হাঁটা ফেরা করতে পারছিলাম আমি। আমি যে ওঁর ওপর নজর রেখে চলেছি একটি মুহূর্তের জন্যেও তিনি তা বুঝতে পারেননি। উনি প্রায় প্রতিটি দোকানে ঢুকলেন আর সব জিনিস খুঁটিয়ে দেখলেন কিন্তু কোন জিনিসেরই দাম জানতে চাইলেন না। ওঁর এই সব আচরণে আমি খুবই বিস্মিত হয়ে উঠেছিলাম। মনে মনে স্থির করে ফেললাম ওঁর সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ না-করা পর্যন্ত আমি ওঁকে নজরে রাখবে।
একটা বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে এগারোটা বাজল। বাজারের লোকজন এবার কমতে শুরু করল। একজন দোকানদার তার দরজা বন্ধ করতে গিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পায়ে ধাক্কা খেল। দেখলাম ভদ্রলোক যেন কেঁপে উঠলেন, পরমুহূর্তেই তিনি বড় রাস্তায় পৌঁছে এদিক ওদিক কী যেন দেখে নিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়ে চললেন। বহু ছোট ছোট জনশূন্য গলি,,আর আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে উনি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন ডি– কফিহাউসের সামনে সেই বড় রাস্তায়। এ রাস্তার চেহারা সেই আগের মতোই ছিল। তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে। গ্যাসের আলোয় দেখা যাচ্ছিল লোকজনের যাতায়াত অনেক কমে গিয়েছে। ভদ্রলোকের মুখ তখন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। একদা জনবহুল সেই রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর আবার কতকগুলো রাস্তা পেরিয়ে নদীর দিকে রওনা হলেন। শেষ পর্যন্ত উনি পৌঁছলেন একটা বড় থিয়েটার হলের সামনে। ওটা তখন বন্ধ হবার মুখে। দরজা দিয়ে লোকজন বেরিয়ে আসছিল। দম নেবার জন্যেই যেন উনি দ্রুতবেগে ঐ জনতার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। মনে হচ্ছিল ইতিমধ্যে তাঁর মানসিক উত্তেজনা অনেকখানি কমে এসেছে। মাথা আবার ঝুঁকে পড়ল বুকের দিকে। প্রথম যে অবস্থায় তাকে দেখেছিলাম, এখন আবার সেই রকমই মনে হতে লাগল আমার। লোকজন বেশীর ভাগ যেদিকে চলেছিল উনিও সেইপথে এবার এগিয়ে চললেন। ওঁর ব্যবহার ক্রমশ আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিল।
যেতে যেতে আগের অস্থিরতা আর অস্বস্তি যেন আবার ফিরে এলো। দশবারো জনের একদল লোকের পেছনে পেছনে উনি চলছিলেন। কিছুদূর যাবার পর এক একজন কমে গিয়ে দলটিতে রইল মাত্র তিনজন। ওরা তখন চলেছে প্রায় অন্ধকার একটা নির্জন সরু গলি দিয়ে। পথিক একটু থমকে দাঁড়ালেম হঠাৎ। মনে হোল গভীর চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছেন তিনি, পরক্ষণে আবার দ্রুতবেগে হাঁটতে হাঁটতে শহরের উপকণ্ঠে এমন একটা এলাকায় এসে পৌঁছলেন যেটি এতক্ষণ যে সব এলাকায় আমরা ঘোরাঘুরি করছিলাম তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। চরম দারিদ্র্য আর অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য কুখ্যাত বিশ্রী দুর্গন্ধপূর্ণ লণ্ডনের এই এলাকায় আলোও বেশী ছিল না। মাঝে মধ্যে এক আধটা আলোয় বড় বড় ঘুনে ধরা নড়বড়ে পুরোনো দিনের কাঠের বাড়ী নজরে পড়ছিল। বাড়ীগুলোর মাঝখান দিয়ে রাস্তাটাও ভালো করে চোখে পড়ছিল না। পাথরগুলো খুলে গিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল আর রাস্তার সেই ফাঁকগুলোতে ঘাস গজিয়ে উঠেছিল। চারদিকে আবর্জনার ভয়ঙ্কর ভূপ। এলাকাটাকে ভীষণ নির্জন মনে হচ্ছিল। যাই হোক কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে তারপর মানুষের সাড়া পাওয়া গেল। লণ্ডন শহর থেকে বহিষ্কৃত জনসমষ্টির একটা অংশকে ঘোরা ফেরা করতে দেখা গেল। নির্বাণোম্মুখ প্রদীপের মত ভদ্রলোকের প্রাণশক্তি যেন শেষবারের মত উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। আবার তিনি এগিয়ে চললেন, একটা মোড় ফিরেই পৌঁছলেন শহরতলীর কুখ্যাত মদচোলাইয়ের আঁটিগুলোর সামনে। সুরাসক্তির সেই প্রাসাদগুলির সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম।
তখন ভোর হয়ে আসছিল। হতচ্ছাড়া মাতালরা তখন ভাটিখানার মধ্যে যাতায়াত করছিল। ভদ্রলোক যেন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তারপর সেই মাতালদের দলে ভিড়ে গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। একটুক্ষণের মধ্যেই যে ভাবে লোকজন বেরুতে লাগল তাতে বোঝা গেল যে সে রাত্রের মত ভাটিখানার মালিক তার দোকান বন্ধ করছে। ভদ্রলোকটির মুখের ওপর দীর্ঘসময় ধরে লক্ষ্য করে চলেছিলাম। এখন মনে হোল হতাশ না হয়ে উনি যেন বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। পাগলের মত আবার ফিরে চললেন তিনি লণ্ডন শহরের দিকে। বেশ দ্রুত বেগেই হেঁটে চললেন তিনি আর আমিও চললাম সমান বেগে পূর্বের মত ঔৎসুক্য নিয়ে। সূর্য উঠেছে। উনিও এগিয়ে চলেছেন। একটু পরে আবার সেই ডি–কফিহাউসের সামনের রাস্তায় তিনি গিয়ে পৌঁছলেন। আগের দিন সন্ধ্যায় যে ভাবে লোকজনের ভিড় দেখেছিলেন তখন প্রায় সেইরকম ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। আগের মতই ভদ্রলোক হাঁটতেই থাকলেন, এদিক ওদিক একেবারে লক্ষ্যহীন ভাবে। সারাদিন ধরে যাত্রীমুখর পথেই হাঁটতে থাকলেন তিনি। আবার যখন সন্ধ্যা হয় হয় তখন ক্লান্তিতে আমি একেবারে ভেঙে পড়ছিলাম। আমি সামনে এসে ওঁর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি কিন্তু থামলেন না, এগিয়ে চললেন। আমি থেমে গিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম। মনে মনে বললাম, এই বৃদ্ধ। ভদ্রলোকটি অপরাধমূলক কাজকর্মের জীবন্ত প্রতীক। উনি কখনো একা থাকতে পারতেন না তাই জনতার মানুষ হয়ে গিয়েছেন তিনি। ভগবানের এইটুকু আশীর্বাদ উনি লাভ করেছেন যে জনতার মধ্যে মিশে থেকে উনি কিছুটা সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন।
মনের খেলা
হ্যাঁ সত্যি! ভীষণ ভীতু প্রকৃতির মানুষ ছিলাম আমি এবং এখনো তাই। মারাত্মক রকমের ভীতু। কিন্তু তাই বলে আপনি আমাকে উন্মাদ বলবেন? অসুখে ভুগে ভুগে আমার ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয় বা নিশ্চিহ্ন তো হয়ইনি, বরং যথেষ্ট পরিমাণে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। আর আমার শ্রবণশক্তির তীক্ষ্ণতা তত অকল্পনীয়। স্বর্গ মর্তের সব কথা এমন কি নরকের কথাও আমি সব শুনতে পাই। এর পর আর আমাকে পাগল ভাবা নিশ্চয়ই উচিত হবে না। শুনুন না, কত শান্ত আর নিশ্চিন্তভাবে আমি পুরো কাহিনীটা আপনাকে বলে যেতে পারি।