ভদ্রসমাজ থেকে একটু নীচের দিকে নেমে এসে একটু ভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। ইহুদী ফিরিওলাদের দেখলাম আমি। ওদের বাজের মত তীক্ষ্ণ চোখজোড়া ছাড়া আকৃতির মধ্যে হীনমন্য তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। দেখলাম শক্ত সমর্থ পেশাদার ভিখিরিদের। জীবন সম্পর্কে হতাশা নিয়ে ওরা রাত্রে ভিক্ষে চেয়ে বেড়াচ্ছে আর সাধুসন্ন্যাসী দেখলে তাদের কাছে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ভিক্ষে চাইছে। ক্ষীণপ্রাণ বিকৃতদর্শন বিকলাঙ্গদের দেখতে পেলাম আমি। নিশ্চিত মৃত্যু ওদের ওপর যেন ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। ওরা পথের পাশ দিয়ে কম্পিত পদক্ষেপে এগোবার চেষ্টা করছিল আর কিছু আশা আর সান্ত্বনা লাভের উদ্দেশ্যে জনতার প্রতিটি লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দেখলাম, কর্মক্লান্ত তরুণীদের নিরানন্দ বাড়ীর পথে ফিরে যেতে। ইতর ছেলে-ছোকরাদের চাউনি থেকে অত্যন্ত সন্তর্পণে নিজেদের বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছিল ওরা। কখনো কখনো ওদের মুখোমুখী হয়ে পড়তে হচ্ছিল মেয়েদের কিন্তু তা থেকে রেহাই পাবার পথ ছিল না। কিছু ছেঁড়া কাপড়জামা পরা কুষ্ঠ রোগীদেরও দেখলাম রাস্তায় আর দেখলাম কুঞ্চিত মুখমণ্ডল কিছু বয়স্ক নারীদের যারা গয়না আর প্রসাধন দ্রব্যের সাহায্য নিয়ে যৌবন ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন। চলেছিল কিছু মাতাল। ছেঁড়া জামা কাপড় পরে টলতে টলতে আর বিড় বিড় করে বতে বকতে ওরা চলেছিল এগিয়ে। ওদেরই একদলকে দেখলাম মোটামুটি ভালো জামাকাপড় পরা, আজও জামা কাপড়ে বুরুশ দেওয়া হয়েছে তাদের কিন্তু ম্লানমুখ বিভ্রান্তদৃষ্টি রক্তচক্ষু এই মানুষগুলি জনতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলবার সময় হাতের নাগালের মধ্যে যা পাচ্ছিল তাই কম্পমান আঙ্গুলে মুঠো করে ধরছিল। এ ছাড়া জনতার সঙ্গে মিশে চলেছিল ক্লান্ত কুলি মজুর, জিনিষপত্রে শানপালিশ দেবার, বাঁদর খেলাধার, গান গেয়ে পয়সা উপার্জন করবার মানুষেরাও। সব মিলিয়ে যে প্রাণবন্যা আর ধনিপ্রবাহ সৃজিত হচ্ছিল তা আমার কানে একটা ছন্দহীন শব্দতরঙ্গ আর চোখে বিসদৃশ দৃশ্যের অবতারণা করছিল।
ক্রমশ রাত গম্ভীর হতে থাকল আর সেই সঙ্গে গভীরতর হয়ে উঠল চলমান দৃশ্যাবলী পর্যবেক্ষণ করবার জন্যে আমার ঔৎসুক্য। এদিকে এই দৃশ্যের পরিবর্তনটিও অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তার মধ্যেকার ভদ্র আর নিয়মানুগ অংশগুলো অন্তর্হিত হয়ে গিয়ে কুখ্যাত আর অশোভন অংশগুলোই ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল। দিনের অপসৃয়মান আলোর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে রাস্তার বাতি গুলো মিটমিট করছিল। এতক্ষণে ওরা উজ্জ্বলতর হয়ে কুৎসিত দৃশ্যগুলোকেই ঝলমলে করে তুলেছিল।
সেই উজ্জ্বল আলোয় জানালা দিয়ে অল্প যেটুকু সময় দেখবার সুযোগ পাচ্ছিলাম তারই মধ্যে প্রতিটি মুখ আরও খুটিয়ে দেখতে লাগলাম আমি। শুধু এক পলক দেখার সুযোগ ছিল আমার তবু মনে হতে লাগল যে ওরই মধ্যে প্রতিটি মুখে বহু বৎসরের ইতিহাস পাঠ করতে পারছিলাম আমি।
জানালার কাঁচে চোখ ঠেকিয়ে জনতার প্রতিটি মুখ দেখে নিতে আমি যখন যথেষ্ট ব্যস্ত, ঠিক তখনই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল জরাজীর্ণ ষাট বা পঁয়ষট্টি বছর বয়সের একটি মুখ। ঐ মুখটির মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল অথচ সামান্যতম লক্ষণের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচিতি ছিলনা। মুখটিকে দেখা মাত্রই মনে হোস রেজ তাঁর বিখ্যাত শয়তানের ছবিটি আঁকবার আগে এই মুখটি অবশ্যই দেখে ছিলেন। ওই মুখটির প্রাথমিক অর্থ বোঝবার জন্যে যে স্বল্পতম সময়
আমি পেয়েছিলাম তারই মধ্যে আমার মনে বিচিত্র বিপরীত চিন্তার উদয় হোল। মনে হোল ওই মুখের রেখায় রেখায় যে বিরাট মানসিক শক্তির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার মধ্যে একাকার হয়ে আছে সাবধানতা আর দৈন্য, শান্তি আর ঘৃণা, প্রতিহিংসা আর সাফল্য, আনন্দ আর অপরিসীম ভীতি আর সেই সঙ্গে নিঃসীম হতাশা। মনে হোল এমন ভয়ঙ্কর আকর্ষণীয় মুখ আমি আর কখনো দেখিনি। কী এক আদিম আর অস্বাভাবিক ইতিহাসই না ঐ মানুষটি তার অন্তরে বহন করে চলেছে’-বলে উঠলাম আমি। হঠাৎ মনে হোল এ মানুষটিকে নজরে রাখা দরকার, ওর কথা অনেক বেশী করেই জানা দরকার । তাড়াতাড়ি ছড়ি আর টুপিটা তুলে নিয়ে ওভার কোটটি গায়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম আর যে দিকে ওই ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন ভিড়ের ভেতর দিয়ে সেদিকে তাড়াতাড়ি এগোতে লাগলাম। একটু পরেই ওঁকে খুঁজে পেলাম আর ওঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেই ওঁর পিছু নিলাম।
এখন ওঁকে ভাল করেই দেখতে পারলাম আমি। ছোটখাটো চেহারার দুর্বল গড়নের এই মানুষটির পরনে ছিল ময়লা আর ছেঁড়া জামা কাপড়। উজ্জ্বল আলোর তলায় আসা মাত্রই বুঝতে পারলাম জামাকাপড় এককালে তৈরী হয়েছিল দামী কাপড়েই। আর যদি আমার চোখের তীক্ষ্ণতা ঠিক থাকে আর তারা আমাকে প্রতারিত না করে থাকে তাহলে এও দেখলাম যে উনি হীরে ব্যবহার করছেন আর পোশাকের তলায় আছে একটা ছোরা। আমার উৎসাহ বেড়ে গেল, স্থির করলাম যে উনি যেখানেই যান না কেন আমি তাকে অনুসরণ করে নেব।
তখন বেশ রাত হয়েছে, সারা শহরের ওপর যে ঘন কুয়াশা জমেছিল তারই পরিণতি তখন ঘটছে বর্ষণে। বর্ষা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে জনতার মধ্যে আলোড়ন লক্ষ্য করা গেল আর পরমুহূর্তেই মানুষের পরিবর্তে দেখা গেল অজস্র ছাতা। জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য আর গুঞ্জন তখন দশগুণ বেড়ে গিয়েছে। বর্ষার জন্যে আমার কিন্তু কোন অসুবিধেই হচ্ছিল না। আমি মুখের ওপর একটা রুমাল জড়িয়ে নিয়ে ভদ্রলোকটিকে পাছে হারিয়ে ফেলি তাই একেবারে তাঁর গা ঘেষে হাঁটছিলাম। ভদ্রলোকটি একবারও পেছন ফেরেননি বা আমাকে লক্ষ্য করেননি। কিছুক্ষণ পরে আমরা অন্য এমন একটা রাস্তায় পৌঁছলাম যেখানে লোকজন খুব কম। এখানে পৌঁছেই ওঁর আচরণে পরিবর্তন দেখা গেল। এখন অনেকখানি সঙ্কোচের সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে চললেন উনি। কিছুটা লক্ষ্যহীনভাবে রাস্তাটায় এদিক ওদিক পায়চারী করলেন। আমি কিন্তু ওঁর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই চললাম। অপ্রশস্ত আর দীর্ঘ পথটায় ঘণ্টাখানেক ধরে চললেন তিনি। ইতিমধ্যে পথের লোকজন আরও কমে এসেছে। পার্কের কাছে ব্রডওয়েতে দুপুরবেলা যে রকম লোকজন দেখা যায়, এখন এ রাস্তায় তার চাইতে বেশী লোক ছিল না। লণ্ডনের জনবহুল শহরের সঙ্গে আমেরিকার কোন শহরের এই পার্থক্যটি সহজেই চোখে পড়ে। আর একটা মোড় ফিরে আমরা অন্য একটা আলোকোজ্জল আর জনবহুল রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের আচরণে পরিবর্তন এসে গেল। ওঁর চিবুকটা বুকের কাছে নেমে এলো কিন্তু আশপাশে লোকজনের ভিড়ের মধ্যে তার চোখ এদিকে ওদিকে কী যেন খুঁজে বেড়াতে লাগলো। বেশ সাবধানতার সঙ্গে তখনো এগিয়ে চলেছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ একবার পেছন ফিরে কিছুটা উল্টোমুখে হেঁটে গিয়ে তিনি আবার ফিরে এলেন। ওঁকে এই ভাবে কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখে খুব বিস্মিত হলাম আমি। মধ্যে একবার আমাকে দেখে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছিল।