খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। শরৎসন্ধ্যায় লণ্ডনের ডি কফিহাউসের বড় জানালার পাশে আমি বসেছিলাম। মধ্যে আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, অবশ্য সম্প্রতি আমি সুস্থ হয়ে উঠছিলাম আর আমার মন মেজাজও ভালোই ছিল। মন আমার বেশ শান্ত ছিল আর সব কিছু সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু বোধ করছিলাম। আমি একটা সিগার ধরিয়ে খবর কাগজ নিয়ে বসেছিলাম। বিকেল বেলাটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠছিল, কখনো কাগজের বিজ্ঞাপন পড়ে, কখনন ঘরের মধ্যে যারা আসছিলেন তাদের সান্নিধ্য পেয়ে আবার কখনো ঘোলাটে কাঁচের জানালা দিয়ে বড় রাস্তাটা দেখতে দেখতে সময় বেশ কেটে যাচ্ছিল।
কফিহাউসের সামনে ঐ রাস্তাটা শহরের অন্যতম প্রধান রাস্তা। সারাদিন লোকজনে ওটা চঞ্চল থাকত। সন্ধ্যার অন্ধকার যতোই ঘনিয়ে আসতে লাগল, লোকের ভিড়ও যেন তত বাড়তে লাগল, রাস্তার আলোগুলো জ্বলে ওঠার পর দেখা গেল কফিহাউসের দরজার
সামনে দিয়ে জনতার দু’টো স্রোত যেন অবিচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলেছে। এই রকম কোন সন্ধ্যা আমি কফিহাউসে বসে কাটাইনি তাই জন সমুদ্রের এই অভিনবত্ব আমার খুবই ভাল লাগছিল। ঘরের ভেতরের কোন জিনিসের ওপর আমার আর তখন নজর ছিলনা। সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে পড়েছিল বাইরের জনস্রোতের ওপর।
গোড়ার দিকে আমার চিন্তাটা ছিল নিতান্তই সাধারণ নির্বস্তুক ধরনের। পথিকদের দেখছিলাম সমষ্টিগতভাবেই। কিন্তু একটু পরেই আমি সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম, তাদের পোষাক আকৃতি চলন-ভঙ্গী এমন কি মুখের ভাবভঙ্গীতেও মনোযোগী হয়ে উঠলাম।
বেশীর ভাগ লোকেদের সুখী আর কাজের মানুষ মনে হচ্ছিল। ওরা সবাই যেন সবার আগেভাগে চলে যাবার চেষ্টা করছিল। ভুরু কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে সবাই এগিয়ে চলেছিল। মজার কথা, পথে অন্য কোন পথিকের সঙ্গে ধাক্কা লাগলেও বিরক্ত হচ্ছিল না কেউই। বিন্দু মাত্রও অধৈর্য না হয়ে জামাকাপড় সামলে নিয়ে আবার হন হন করে হেঁটে চলেছিল। বেশ কিছু লোককে বড় বেশী ব্যস্ত মনে হচ্ছিল। লোকারণ্যের মধ্যেও তারা যেন নিঃসঙ্গ এই ভাবে নিজেরা কথা বলে, অঙ্গভঙ্গী করে খুশী মনে হেঁটে চলেছিল। চলার পথে বাধা পেলে এর কথা বলা বন্ধ করছিল বটে কিন্তু মুখভঙ্গীর মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল ওদের। একটু হেসে ওরা আবার এগিয়ে যাচ্ছিল। কেউ ধাক্কা দিলে ওরা মাথা নীচু করছিল তাদেরই কাছে যারা ওদের ধাক্কা দিচ্ছিল। একটুখানি হতবুদ্ধি অবস্থায়ও পড়ছিল ওরা। দু’ধরনের পথিকদের সম্পর্কে যা বললাম এর চাইতে নতুন কিছু আর দেখা যাচ্ছিল না। সবার পোষাক পরিচ্ছদ ছিল মোটামুটি ভদ্র আর সুন্দর। ওরা নিশ্চয় ব্যবসায়ী, উকিল প্রভৃতি শ্রেণীর সম্মানিত মানুষ। কর্মব্যস্ত আর অবসর উপভোগের জন্যে আগ্রহী মানুষের দল। ওদের দেখে নতুন কোন চিন্তাই আমার মনে এল না।
কেরানীদের দুটো দলকেও পরিষ্কার ভাবে বেছে নিতে পারছিলাম আমি। ওদের মধ্যে একদল ছিল জাঁকালে অফিসের নিম্নপদস্থ কেরাণী। ওই সব যুবকদের আঁটসাট জামাকোট, চকচকে জুতো, তেল চকচকে মাথার চুল আর ঘৃণাব্যঞ্জক ঠোঁটগুলো বেশ চিনতে পারছিলাম। ওদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোষাক দেখে মনে হয় ওগুলো বছর দেড়েকের মধ্যে বরাত দিয়ে করিয়ে নেওয়া। সমাজের আদব-কায়দা-দুরস্ত ভদ্রলোকদের মত এই মানুষগুলিকে নতুন কোন সংজ্ঞা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
পুরোনো বনেদী অফিসের কিছু বয়স্ক কেরানীদের বেছে নিতেও ভুল হোলনা আমার। কালো বা বাদামী রঙের ঢিলে ঢালা জামা প্যান্ট, সাদা ওয়েস্ট কোট, চওড়া-মাথা ভারী বুটজুতো, বেশ মোটা মোজা প্রভৃতি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে অফিসে ওঁষা বেশ আরামে সময় কাটান। ওঁদের প্রত্যেকেরই মাথায় ছিল ছোটখাটো টাক আর ডানকানে কলম গুঁজে রাখার অভ্যাসের দরুন ওটা একটু অন্য রকম হয়ে উঠেছিল। ওঁদের ঘড়ির : চেন ছিল সোনার আর মাথায় টুপীটা পরে নেবার জন্যে বা ঠিক করে বসিয়ে নেবার জন্যে ওঁরা ব্যবহার করছিলেন দু’হাত। ওঁদের ভাবভঙ্গীর মধ্যে বেশ একটা বনেদী ভদ্রলোকের ভাব আনার চেষ্টা ছিল।
খুব চকচকে পোষাক পরা লোকজনও দেখছিলাম আমি। বুঝতে অসুবিধে ছিলনা যে ওরা পকেটমারের দল। আজকের বড় শহর গুলো ওদের বৃত্তিধারী লোকজনে ছেয়ে গেছে। আমার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছিল না কী করে প্রকৃত ভদ্রলোকেরা ওইগুলোকে ভদ্রলোক ভাবেন। ওদের চওড়া মনিবন্ধ, আকৃতি আর বড় বেশী খোলাখুলি আচরণ দেখেই চিনে ফেলা উচিত যে ওরা পকেটমার।
জুয়াড়ীদেরও দেখছিলাম আমি। সংখ্যা তাদের কম ছিলনা। ওদের পোষাক– ছিল নানা রকমের, গুণ্ডাদের পোষাক থেকে ধর্ম যাজকদের পোষাক–ওরা সব কিছুই ব্যবহার করছিল। কিন্তু তাই বলে জুয়াড়ী হিসেবে চিনে নিতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। কালো চোখমুখই ওদের চিনিয়ে দিচ্ছিল। অবশ্য আরও দুটো চিহ্ন দেখে আমি ওদের চিনে নিতে পারছিলাম। ওরা কথা বলছিল খুব সাব
ধানে নীচু গলায় আর বুড়ো আঙুল’ বাড়িয়ে কোন একদিকে ইঙ্গিত করছিল। যাদের সঙ্গে ওরা কথা বলছিল তারা সবাই ভিন্ন শ্রেণীর লোক কিন্তু জুয়ার ব্যাপারে অবশ্যই সমগোত্রীয়। এরা বুদ্ধির জোরে অর্থ উপার্জন করতে অভ্যস্ত ভদ্রলোক। জুয়াড়ীরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে জনসাধারণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদল হলেন ফুলবাবু যাদের মুখে হাসি আর মাথায় লম্বা চুল। অন্য দল হলেন সৈনিক সম্প্রদায় যাদের পরনে সামরিক জামা কাপড় আর চোখমুখ ভ্রুকুটিকুটিল।